সাহিত্য

বৃদ্ধ ও তার তিনটি আপেল

বৃদ্ধ ও তার তিনটি আপেল

অলৌকিক এক নেশায় আমার আপাদমস্তক জড়োসড়ো হয়ে আসছিল। চৈত্রের খাবলে খাওয়া রোদ প্রকাণ্ড মূর্তিমান শাসকের মতো আমার মাথার ওপর গরল তাপ ঢেলে শাসিয়ে যাচ্ছিল। শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরের পথ। হাঁটতে হাঁটতে কখনো রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো আমাকে ছায়ায় শীতল করেছে। কখনো বৃষ্টিস্নাত হয়ে লুকোচুরি খেলার মতোই কারো বাড়ির টিনসেডে লুকিয়ে পড়েছি। অতি সাধারণ দিন। অনাবৃষ্টিতে আবহাওয়া যেন নিজের দহনে নিজেই পুড়ছে। ঘরে থাকা যাচ্ছে না, বাইরে থাকা যাচ্ছে না। বাতাসে অক্সিজেন কমে উত্তপ্ততার জেল্লা বেরোচ্ছে। একই রাস্তায় সূর্যমামাকে ছাতা বানিয়ে রোজ হাঁটতে হাঁটতে মুখে পিঠে ফোসকা পড়ে গেছে।

Advertisement

ছোটবেলায়ই চোখে উঠেছে চশমা। কী এক জটিল রোগ যে, চোখে পারমানেন্টলি বাসা বাঁধল। বছর বাড়ছে, চশমার পাওয়ার বাড়ছে। বয়স বেড়েছে তবু চোখের পাওয়ার বাড়েনি। বড় হয়ে জেনেছি, আমার চোখের সমস্যাটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। গ্লুকোমা এবং রেটিনাল সমস্যাকে প্রভাবিত করা কয়েকটি অসুস্থতার মধ্যে একটি হচ্ছে ম্যাকুলার ডিজেনারেশন। এই সমস্যার কারণে চোখের ভেতর ম্যাকুলার কোষগুলো ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। ফলে ধীরে ধীরে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়। এই ভয়াবহ সমস্যা নিয়েই এতদিনের পথচলা। জানি না, ভবিষ্যতে হয়তো ধীরে ধীরে চোখের আলো নিভতে নিভতে একেবারেই নিভে যাবে। জীবনের আয়ু থাকলেও হয়তো সুন্দর পৃথিবীকে উপভোগ করার জন্য আমার চোখের আয়ুই থাকলো না! তাই রোদে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। চশমার লেন্স ঘোলাটে হয়ে যায়।

ক্রিকেট আমার প্রিয় খেলা। একসময় খুব ভালো প্লেয়ার ছিলাম। শুধু চোখের কারণে এখন সেসব আমার অতীত স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। বন্ধুদের সাথেও সেভাবে মিশতে বিব্রত হই কখনো-সখনো। অটোরিকশায় উল্টো সিটে বসতে পারি না বলে দু’চারজন খোঁচা মেরে কথা বলে। শাহেনশাহ নবাবজাদা বলে টিটকিরি মারে। ‘রাত যত গভীর হয়; তারাগুলো ততই উজ্জ্বল হয়। তেমনিভাবে দুঃখ যত বেশি হয়; স্রষ্টা ততই নিকটে চলে আসেন।’ রুশ ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক ফিওদর দস্তয়েভস্কির উক্তিটি আমার মন-প্রাণজুড়ে প্রশান্তির ছায়া দেয়। তাই তার কথাটিকে এত ভালোবাসি। কারো কটু কথায় আর দুঃখ পাই না।

প্রচণ্ড গরমে চোখ থেকে বাষ্প বের হয়ে চশমা ঘোলা হলে বার বার মুছতেই হয়। অনেকে আবার এটাকে আমার মুদ্রাদোষ ভেবে ভুল করেন। সে যা-ই হোক, গ্রীষ্মকালে চোখে চশমা পরে রোজ টিউশনির পথ পাড়ি দেওয়া একটু কষ্টকরই বটে। গ্রীষ্মকাল কেন বলছি? বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে, শীতকালে কুয়াশায় ঝাপসা হয়। আসলে চোখের ওপর এক্সট্রা বস্তু নিয়ে চলা ঝামেলার। কী আর করা! অন্ধের যষ্ঠি যে সে আমার। তাকে ছাড়া যে আমার গতি নেই।

Advertisement

সেদিন কলেজ শেষে ঘেমে-নেয়ে কাকভেজা হয়ে যথাসময়ে উপস্থিত হলাম টিউশন বাড়ি। ছাত্রছাত্রী তিনজন। উঠোন লাগোয়া ঘর। উপরে টিনের চালা। এমন বাধাবিহীন টিনের চালে যখন বৃষ্টি পড়ে কিশোরীর হাঁটতে থাকা পায়ে নূপুরের সংগীতের মতো মনে হয়। সেই সংগীতের অপেক্ষায় যখন চাতক পাখির মতো তাকিয়ে ছিলাম। হঠাৎ মনে হলো বাইরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একটি ছাগল অনবরত ডেকে যাচ্ছে। এই ভরদুপুরে তপ্ত উঠোনে জুতো পায়ে মানুষ দাঁড়িয়ে থাকাই যেখানে কঠিন; সেখানে পশুদের হাঁটার উপস্থিতিটা বেশ অবাক লাগলো। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার মনের ভুল, এভাবে জানালার পাশে ছাগলটি কেন অদ্ভুতভাবে ডেকে যাচ্ছে।

নিজের ওপর একটু সন্দেহ হলো, প্রচণ্ড রোদে অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি, ব্লাড প্রেসারটাও মাঝে মাঝে লো হয়ে যায়। মাথা ঘোরে। সেজন্যই কি ভুল-ভাল শুনছি নাকি! সন্দেহ এড়াতে বাইরে উঁকিঝুকি মারলাম। দেখতে পেলাম না কিছু। তারপর ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা তোমরা কি কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছ?’ একসাথে উত্তর এলো, ‘জ্বি স্যার।’ তার মানে আমি ভুল শুনিনি। ‘কিসের শব্দ?’ ‘ছাগলের ডাক।’ ওকে। পাঁচ মিনিট পর আবার সেই ডাক। এবার রীতিমত আমার অস্বস্তি হতে শুরু করলো। ‘এই যে মমিন পাড়ার অয়ন’ বলে হঠাৎ দেখি এক বৃদ্ধ লোক জানালার পাশে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে। আমি অবাক হলাম। তিনি আমার নাম জানলেন কেমন করে! আর কোথায় থাকি তা-ও!

মুখে একগুচ্ছ দাড়ি আর একহাতে একটি লাঠি ও ছেঁড়া তালি দেওয়া হালকা আকাশি রঙের একটি পাঞ্জাবি পরা আধগুঁজো বৃদ্ধ। দেখে মনে হলো, বয়সের ভারে বেঁকে গেছেন। তবুও আমার দিকে তাকিয়ে অনর্গল বলে যাচ্ছেন আমার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ। তার কথা শুনে শরীরের ভেতরের সমস্ত কোষগুলোর সংকোচন-প্রসারণে আমার শরীরের ভারসাম্য রক্ষাই যেন দায় হয়ে যাচ্ছিল। বৃদ্ধের মুখের স্নিগ্ধ হাসি আর অকল্পনীয় মায়াময় চোখে তাকিয়ে আমি মোহমুগ্ধ হয়ে পড়ি। এ যেন এক তীব্র টানের টানাটানিতে আমার ছাত্রীর মা আর বাবা ভেতর রুম থেকে ছুটে এলেন। ওনাকে ভেতরে এনে বসালেন। তারপর কথা বললেন ছাত্রীর মা-বাবার সাথে। বিশেষ করে মিলন ভাই মানে আমার ছাত্রীর বাবার কাছে অনুমতি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের ভেতরের রুমে যেতে বললেন। ‘আমি বেশি সময় নিব না। আমি এখানে এসেছি অয়ন নামের এই ছেলেটির সাথে কথা বলতে।’ তার কথা ও অদ্ভুত আচরণে আমি লোকটির দিকে আরও মনোযোগী হতে শুরু করলাম।

মিলন ভাইয়ের ব্যবসায়িক অতীত অভিজ্ঞতার কথা, বর্তমান সময়ে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক এবং পেশাগত টানাপোড়েন; সমস্ত কিছু যেন একটি স্মৃতি ডায়েরির মতো পড়ে যাচ্ছিলেন। আমরা তিনজন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম। কিছু অজানা তথ্য এমনভাবে তিনি উপস্থাপন করতে শুরু করলেন, মিলন ভাইয়ের স্ত্রী নিলা আপা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন তার স্বামীর মুখের দিকে। কিছুক্ষণ পর নিলা আপার চোখের পানিতে তার স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার আবেগ প্রবাহমান ঝরনার মতো বইতে লাগলো। সে ঝরনায় কাগজের নৌকায় ভরে মনের দুঃখগুলো যেন এক এক করে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন ওই অতি সাধারণ বৃদ্ধ লোকটি। মিলন ভাই বৃদ্ধের কথা থামাতে চাইলেও পারলেন না। তার অভিনব আর অলৌকিক কিংবা অত্যাশ্চার্য গুণের কারণে বললেও মনে হয় ভুল হবে না।

Advertisement

মিলন ভাই শুধু একটি কথাই বলেছিলেন যে, ‘কথাগুলো আমি ব্যতীত পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি জানেই না। এতটাকাল ভাইয়ে ভাইয়ে দ্বন্দ্বের কারণ আমি কাউকে জানতেই দেইনি। ভাইয়ের অপরাধের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে পরিবার এবং সমাজের চোখে অপরাধী হয়েছি। বড় হয়ে ছোটদের অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া, তাকে সুযোগ করে দেওয়া—এমন শিক্ষাই তো বাবা দিয়েছিলেন। এই অপরিচিত আগন্তুক কী করে জানলেন আমার ভেতরের সূক্ষ সূক্ষ দুঃখকণাগুলো। নিলার মনে অনেক অভিমান জমেছিল আমার ওপর। সেই বিশাল অভিমানের বরফ তাই চোখের পানি হয়ে গলে গলে পড়ছে।’

লোকটির কাছে যেন আমার আরও আরও জানার আগ্রহ বাড়তে থাকলো। হয় না এমন! হয়তো তিনি জ্যোতিষশাস্ত্র বেশ ভালো বোঝেন! অথবা অন্য কেউ? চোখের দিকে তাকালেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। মিলন ভাইয়ের মনের ভেতর যে তাকে নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছে, তা-ও তিনি বলে দিলেন। আমি শুধু অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। শৈশব, কৈশোর, যুবককাল, নদীর শহরের আকুলি-বিকুলি, কিছু স্মৃতির ব্যঞ্জনায় ভাসিয়ে মিলন ভাইকে শেষ পর্যন্ত হাসালেন। যতই দেখছি অবাক হচ্ছি। এরপর তিনি মিলন ভাইকে এক টাকার একটি কয়েন দিয়ে বললেন, ‘এই নেহ, এটা যত্ন করে রাখবি। এবার তোরা ভেতরে যাহ! তোর সাথে এই জীবনে আমার আর দেখা হবে না! দেখা হবে একদিন; যেদিন সাত কাতার একসাথে দাঁড়াবে। আর কয়েনটি যতকাল তোর কাছে থাকবে, অভাব তোকে ছুঁতে পারবে না। আরও একবার তোর হাতে এই কয়েন তুলে দিয়েছিলাম, রাখতে পারিসনি। মনে করে দেখ।’

মিলন ভাইয়ের চোখ দুটো বড় হয়ে গেল! অবাক হয়ে বললেন, ‘সে তো সিলেট মাজার থেকে বের হওয়ার পর এক ঠুনঠুনে বৃদ্ধ আমাকে দিয়েছিল আরও বিশ বছর আগে। কিন্তু সেটা আপনি হলেন কী করে!’ বৃদ্ধ মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘ও হিসেব তোদের মিলবে না। এবার তোরা ভেতরে যা। এখন আমি এই পাগল ছেলেটার সাথে কথা বলবো।’ আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন। আমি খানিকটা ভয় পেতে শুরু করলাম। কী বলতে কী বলে ফেলবেন! পরে দেখলাম আশেপাশে কেউ নেই। একটু স্বস্তি পেলাম। শুরুতেই আমার চশমার দিকে তার দৃষ্টি। ‘চশমাটা তোকে খুব বিরক্ত করে তাই না! ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিতে? কিন্তু পারিস না। ঠিক বলেছি না!’ ‘হাঁ মানে।’ কথা জড়িয়ে আসছিল আমার। তিনি একপ্রকার ছোঁ মেরে আমার চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিলেন। আমি ধরতে গিয়েও কেন যেন পারলাম না। শুরু থেকেই তার আচরণ অদ্ভুত ছিল! তাই বেশি কিছু না বলে জায়গায় স্থির হয়ে রইলাম। হার্টবিট দ্রুত চলছে বুঝতে পারছি। তিনি বললেন, ‘শান্ত হ! তুই কি ভাবছিস আমি সবটা জানি। ভাবছিস, আমি তোর নাম-ঠিকানা কী করে জানি। তোর চোখের সমস্যা ছাড়াও সাইনোসাইটিস বলে ডাক্তার তোকে যে সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়েছে—সেটার খবরও আমি জানি। কিভাবে হলো বলবো?’ আমি কি বলবো ঠিক বুঝতে পারছি না।

‘সাত বছর বয়সে দুপুরে বন্ধুদের সাথে গাছে উঠে নিচে পড়ে গিয়ে নাকে ব্যথা পেয়েছিলি মনে পড়ছে?’ কিছুক্ষণের জন্য শৈশবের সেই দুঃসহ দিনটি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো। নাক ফুলে গিয়ে কী ভয়াবহ কাণ্ড! মা-বাবার অসহায় কান্নার শব্দ কী করে ভুলব। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলাম। মা-তো ভেবেছিল এই বুঝি তার একমাত্র ছেলে শেষ! বৃদ্ধের কথা শুনে আমার মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু মাথা নাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। তখনো আমার চশমাটা তার হাতে। কিছু বলতেও পারছি না! হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘তোর মানিব্যাগে টাকা আছে?’ বললাম, ‘হ্যাঁ আছে। তবে কত টাকা জানি না।’ ‘সবগুলো টাকা আমায় দিবি? খুব ক্ষুধা লেগেছে। এই টাকা দিয়ে আমি খাবো।’ ‘আচ্ছা, দেখছি কত আছে।’ গুনে দেখলাম তিনশ পঞ্চাশ টাকা। ছাত্রজীবনে তিনশ পঞ্চাশ টাকা অনেক টাকা কিন্তু তার ক্ষুধার কাছে বড় কিছু আছে বলে ওই মুহূর্তে মনে হলো না।

আমি মানিব্যাগ শূন্য করে তাকে সব টাকা হাতে তুলে দিলাম। তিনি টাকাগুলো নিয়ে মুচকি হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোর মন তো অনেক বড় রে! সেই মনের ঘরে অনেকে উঁকিঝুকি মারে বুঝি! মন এত চঞ্চল কেন! খালি এঘর-ওঘর দৌঁড়াতে চায়! হুম, সে না হয় বুঝলাম। তবে ভুলটা করলি কেন?’ আমার শরীর হিম হয়ে আসছিল। কিছু বলার শক্তি একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি মনে হচ্ছিল। আস্তে করে বললাম, ‘মানে।’ ‘কোন ভুল... বুঝলি না! বৃষ্টিভেজা দিনে কারো সাথে বৃষ্টিতে ভেজার কথা মনে নেই? সর্বনাশ!’

সেদিন অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছিল। কলেজ করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি আর প্রভা বাগানের পেছন সিঁড়িতে বসে বৃষ্টি দেখছিলাম। হঠাৎ ওর চোখে কী একটা পড়ল। চিৎকার করছিল যন্ত্রণায়। হঠাৎ ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছিলাম। তারপর চুপ হয়ে গেল। ব্যাস ওইটুকুই তো! সে কথা বলছে না তো! ‘যা ভাবছিস তাই।’ আরে আশ্চর্য! তিনি কি ভাবনাগুলোও পড়তে পারেন নাকি? ‘শোন একটা কথা, তোর জীবনে অনেক নারী আসবে-যাবে। তবে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা তোর নিজের পছন্দমতোই হবে। সৎ এবং ভালো মানুষের জীবনে অনেক কাঁটাছেড়া থাকে, তোর জীবনেও আছে। তবে সৎ এবং নিরহংকারী ব্যক্তির ওপর আল্লাহর আশীর্বাদও থাকে। এই নেহ মিলন সাহেবের মতো তোকেও একটি কয়েন দিলাম-যত্ন করে রাখিস। এটা যতকাল তোর সাথে থাকবে, অভাবে পড়বি না। তোর জন্য আমার কাছে আরও তিনটি জিনিস সুরক্ষিত আছে। ওই জিনিস পৌঁছাতেই আমি এসেছি।’

কৌতূহল এবং হার্টবিট—দুটোই প্লেনের গতিতে ছুটছে। অনেকটা কৌতূহলী মনে প্রশ্ন করলাম, ‘কী সেই অমূল্য জিনিস। যা আপনি আমাকে দিতে এসেছেন?’ তিনি পাঞ্জাবির ডানপকেটে হাত গুঁজে দিলেন। পকেট থেকে সতেজ একটি সবুজ রঙের আপেল আমার দিকে বাড়িয়ে ছিলেন। বললেন, ‘এটা খা।’ কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ যে মনের ভেতর কাজ করছিল না। তা কিন্তু নয়। হঠাৎ করে কোথা থেকে এলেন আবার তার দেওয়া আপেলও খেতে বলছেন। অ্যাস্ট্রোলজি বা জ্যোতিষশাস্ত্র বলতেই আমি একটু দুর্বল ছিলাম সব সময়। তবে তাকে আমার ঠিক একজন অ্যাস্ট্রোলজার মনে হয়নি। মনে হয়েছিল ভিন্ন ধরনের ক্ষমতাসম্পন্ন একজন আধ্যাত্মিক মানুষ। যদিও আমি বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। তবুও এরকম আধ্যাত্মিকতার ফেরারি জীবনের প্রতি একটি লোভনীয় আকর্ষণ ছিল। ভালো লাগতো তাদের বৈবাহিক নিষেধাজ্ঞা মানা নির্ভেজাল জীবন। বিশ্বাস আর আস্থা রাখতে মন চাইছিল তার প্রতি। খেয়েই নিলাম আপেলটি। যা হবার হবে।

তিনি আবারও মুচকি হাসলেন। বললেন, ‘এমন দিন আসবে যখন চাইলেও মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবি না। তবে জীবনে সবাইকে অবিশ্বাস করেও বাঁচা যায় না। তাই বিশ্বাস রাখতে হবে সাথে বিচক্ষণ বুদ্ধিমত্তা থাকলে জীবনে ঠকবি না। আর একটা বড় বিষয় হচ্ছে—নিজের বাবা-মায়ের মনে কখনোই আঘাত দেওয়া যাবে না। তোর চশমাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। একদিন স্বইচ্ছায় তুই এই চশমাটা আমাকে দিয়ে দিবি। নেহ তোর চশমা।’ বলে চোখে পরিয়ে দিলেন। ‘ভাবিস না, এই জীবনে তোর সাথে আবার আমার দেখা হবে। বারবার দেখা হবে যদি আমার কথা তোর মনে থাকে। তোর জন্য মোট তিনটি আপেল আমার কাছে সুরক্ষিত আছে। একটি তোকে আজ দিলাম। আর দুটো আপেল থাকল আমার কাছে। আমি বেঁচে থাকলে আর যদি তুই আমাকে স্মরণে রাখিস তবে নিশ্চয়ই দেখা হবে। তখন আপেল দুটো আবার দিব।’

চলে গেলেন তিনি। এক মায়াময় জীবনের ছড়ি বিছিয়ে দিয়ে গেলেন মনে। বুকের ভেতর শান্তি অনুভব হতে লাগলো। যত বড়ই হই না কেন, কখনো যেন অহংকারী না হই। এই কথার গাঁথুনী ছিল বেশ জোড়ালো। কী যুক্তি আর মায়া ছড়ানো কথা! মিগেল দে থের্ভান্তেস সাভেদ্রার লেখা অমর সাহিত্যকর্ম ডন কিহোটে। সপ্তদশ শতকে লেখা বইটিকে প্রথম আধুনিক উপন্যাস ও স্পেনীয় ভাষায় রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে অভিহিত করা হয়। পাগলাটে স্বভাবের এক ভদ্রলোক। নাম তার ডন কইক্সোট। সবার কল্পনাশক্তি যেখানে শেষ, তার ভাবনা সেখানে শুরু। ঔপন্যাসিকের এই চরিত্রের মিল খুঁজে পাচ্ছিলাম আমি বৃদ্ধের এই দুরন্ত অভিযানে।

ঠিক একবছর পর শুরু হয় ইউনিভার্সিটিতে ভর্তিযুদ্ধ। ফজরের নামাজ আদায় করে কিছুক্ষণ কোরআন পড়ার অভ্যাস সেই কিশোর বয়স থেকেই। আব্বাকে দেখে দেখে নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। স্বস্তিও পেতাম। নামাজ শেষ করে কোরআন খুলে চশমাটা পরে নিলাম। হঠাৎ চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করলাম। বারবার চশমার গ্লাস মুছেও কোনো লাভ হচ্ছিল না। এত ঝাপসা দেখছিলাম যে, আমি আমার সামনের কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। শীতকালে কুয়াশার ভেতর দিয়ে হেঁটে গেলে যেমন হতো; ঠিক তেমন। ভয় পেয়ে গেলাম। এই বুঝি চিরতরে অন্ধ হয়ে গেলাম। আতঙ্কে কাঁদতে লাগলাম। ছুটে এলেন আব্বা-আম্মা। আম্মাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলাম, ‘আমি মনে হয় চিরতরে অন্ধ হয়ে গেলাম আম্মা।’ মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন। আব্বা খুব পরহেজগার মানুষ ছিলেন। বললেন, ‘আমি আর তোর মা সারাজীবন কারো কোনো ক্ষতি করিনি। অন্যায়ভাবে রোজগার করিনি, মিথ্যা কথা বলিনি। আল্লাহ্ আমাদের এত বড় শাস্তি দিবেন না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ বাবা।’

আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কষ্টে, ক্ষোভে চোখ থেকে চশমাটা ছুঁড়ে বাইরে ফেলে দিলাম। কী আশ্চর্য আর অদ্ভুত ব্যাপার আমার সাথে ঘটছে বুঝতে পারলাম; যখন আমার রুমের দেওয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারের ছোট ছোট সংখ্যাগুলো অতদূর থেকে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ছুটে গিয়ে কোরআনের দিকে দৃষ্টি রাখলাম, কী অবাক কাণ্ড! আমি খালি চোখেই অনর্গল পড়ছিলাম। আব্বা-আম্মাও অবাক। একটু আগেই যে অন্ধ হয়ে গেছি বলে চিৎকার করতে করতে বাড়ি মাথায় করলো; এখন সে চশমা ছাড়াই নাকি সব দেখতে পাচ্ছে। এটি আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া আর কী! আব্বার বিশ্বাসটুকু মনে দোলা দিয়ে গেলেও ওই মুহূর্তে সেই বৃদ্ধের কথা মনের ভেতর সুভাসিত ফুলের ঘ্রাণের মতো আমাকে অত্যাশ্চার্য অনুভব দিয়ে গেল। মনে পড়ে গেল তিনি বলেছিলেন, ‘একদিন তুই নিজেই আমাকে তোর চশমাটা দিয়ে দিবি।’ সত্যিই সেই যে ফেলেছিলাম আজও চশমা লাগেনি! এখন আর বন্ধুদের সাথে গাড়িতে চড়তে, রোদে, বৃষ্টিতে, পড়াশোনা কোনো কিছুতেই সমস্যা হয় না। মনের গহীনে বৃদ্ধ লোকটির হাসিমাখা মুখ একবিন্দু জায়গা করে নেয় অনায়াসে।

ধীরে ধীরে নিজের ভেতর কিছু অলৌকিক বিষয় কিংবা বৈশিষ্ট্যের দ্যুতি ছড়াতে দেখি। আমার ভেতর ভালো লাগার অনুভব যেমন কাজ করছিল; তেমনি অদ্ভুত আর ভয়ও লাগছিল। হরর মুভি আর সাইকোলজিক্যাল মুভি আমার খুব ফেভারেট সব সময়ই। তাই বিশ্বের সারা জাগানো মুভিগুলো দেখতে আমার ভুল হতো না কখনো। ইউনিভার্সিটিতে থাকাকালীন সপ্তাহান্তে একটি মুভি দেখাই হতো। এর মধ্যে মনে দাগ কেটে গেছে, অ্যালফ্রেড হিচককের বিখ্যাত ছবি সাইকো, দি হাউজ দ্যাট জ্যাক বিল্ট, দ্য সাইলেন্স অব দ্য ল্যাম্বস এবং পারফিউম। আরও দেখেছি পাই, মেমেন্টো, শাটার আইল্যান্ড, গন গার্ল, কিউব ইত্যাদি। ভালো লাগতো, এখনো এরকম মুভি এলে চাকরির চাপ এড়িয়ে সময় বের করে স্ত্রী মিলিকে নিয়ে বসে যাই। যদিও সে আমার পুরো বিপরীত। এসব সাইকোলজিক্যাল কিংবা থ্রিলার টাইপ তার একদমই অপছন্দের। দিনে দিনে লক্ষ্য করছিলাম নিজের ভেতর এক দ্বিতীয় সত্তার উপস্থিতি অথবা নিজেরই ভেতর বাড়তি একটি ইন্দ্রিয়ের সরব বিচরণ কিংবা সিক্সথ সেন্স অ্যাকটিভেটেড ম্যান আমি।

অদ্ভুত তো। আমার আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবের বিষয়ে অনেক অনেক ঘটনা আছে, যা ঘটার আগে থেকেই আমি টের পেতাম। সব কিছু আমার কল্পনা হয়ে চোখের সামনে ভেসে আসতো। এক-দুদিন পর ঠিক তাই তাই ঘটতো, যা আমি দেখতে পেতাম কিন্তু নিজের বিষয়ে কখনোই কিছু জানতাম না। আমার এই আশ্চর্য ঘটনার কথা মিলি ছাড়া আর কেউ জানতো না। ওর মনের ভেতর কিছু চাপা কষ্ট আর হতাশা ছিল। আমি যখন অফিসে চলে যাই ওর তখন সময় কাটে না। দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিল একা একা। আমাদের বিবাহিত জীবনের ষষ্ঠ বছর চলছে অথচ আমরা নিঃসন্তান। মিলিও মাঝে মাঝে রাগে দুঃখে আমাকে বলে, ‘এত মানুষের ভালো-মন্দের খবর জানো, নিজের খবর জানো না?’

আবার বহু বছর পর মনে পড়ল সেই বৃদ্ধের কথা! ইট-পাথরের শহরে থাকতে থাকতে মানুষের মনও একসময় কঠিন হয়ে যায়। জীবনের চলন্ত ট্রেনে চলতে চলতে মানুষ হাপিয়ে উঠে কোথাও না কোথাও তার গন্তব্যে পৌঁছায়। ভালো না লাগা এক বিকেলে অফিস ফেরত ক্লান্ত পথিক আমি। অসুস্থ মিলি বাসায় একা। জ্বরে কাতরাচ্ছে দুইদিন। পাড়ার মোড়ে ভ্যানওয়ালা দাঁড়িয়ে আছে। ভ্যানভর্তি ফল। দেখেই থামলাম। ভাবলাম কিছু ফল কিনে নেই ওর জন্য। দুটো আনারস আর এক কেজি আপেল মাপতে বললাম। হঠাৎ কোথা থেকে দৌড়ে এসে এক পাগল ভ্যানের ওপর অসচেতন ভাবে ধাক্কা খেল। মাটিতে পড়ে গেল অনেকগুলো আপেল। দোকানদার রেগে মেগে পাগল লোকটিকে মারতে যাওয়ার উপক্রম হলে তাকে থামিয়ে আমিই মাটি থেকে আপেলগুলো তুলতে শুরু করলাম।

কালো চুল-দাড়িতে আপাদমস্তক ঢাকা। অপরিচ্ছন্ন, অল্প কাপড়ে শরীর ঢাকা। লোকে তাকে পাগলই বলবে। তিনিও আমার সাথে আপেল কুড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তাকে একটি আপেল আর পাঁচ টাকা হাতে তুলে দিলাম কিছু না বুঝেই। আপেলটি তার ব্যাগে নিলেন। পরক্ষণেই আবার সেটা আমাকে ফেরত দিয়ে বললেন, ‘আপেল লাগবে না। তোকে দোয়া করে দিলাম। তুই পুত্রসন্তানের বাবা হবি। সেই সন্তান বড় হয়ে একদিন মস্ত অফিসার হবে কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে এক প্রিয়জন হারাবি।’ অদ্ভুতভাবে কথাগুলো বলতে বলতে চলে গেলেন তিনি।

বাসায় ফিরে এলাম কিন্তু মনের ভেতর অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছিল। মিলির জন্য টেনশন হচ্ছিল। ওয়াশরুম থেকে ফিরে খাটে হেলান দিয়ে বসে আছি; মিলি অসুস্থ শরীর নিয়েই আপেল কেটে আনলো। দেখেই অবাক হলাম! ‘কী ব্যাপার মিলি, আমি তো লাল রঙের আপেল এনেছি। তুমি সবুজ আপেল কোথায় পেলে? আশ্চর্য তো! আমি নিজেই তো অবাক!’ সবগুলো লাল আপেলের মধ্যে এই একটাই মাত্র সবুজ আপেল, সেটাই কেটে আনলাম। আপেল খেতে খেতে ভাবছিলাম পাগল লোকটির কথাগুলো। কী বলে গেলেন; দুশ্চিন্তা হচ্ছিল খুব।

রাতে বারান্দায় পায়চারি করে মাথা ব্যথায় প্রায় ভোরের দিকে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে এলো সেই বৃদ্ধের মুখ। এত বছর পর আজ তাকে কেন বার বার মনে পড়ছে? সবুজ আপেলটি দেখে কেন আমার কাছে এতটা অবাক লাগছে? এটাও তো সত্যি, দোকানদার সবুজ আপেল বিক্রি করছিলেন না। পাগল লোকটিকে তো আমি লাল রঙের আপেল দিয়েছিলাম। তিনি তা আমাকে ফেরত দিলেন। কোনোভাবেই কেন মনে করতে পারছি না আপেলটি কী রঙের ছিল। লাল না সবুজ। সবুজ! মাথা ঘুরছে। সব এলোমেলো লাগছে। সব যেন অলৌকিকভাবে মিলে যাচ্ছে। তবে কি কোনোভাবে সেই বৃদ্ধ পাগলের রূপে আমাকে দ্বিতীয় আপেলটি দিয়ে গেলেন? জানি না। জানি না কিন্তু তা-ই যদি হয়, তবে এত বছর পর তিনি তো আরও বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা! তেমন তো মনে হলো না!

দুদিন পর হঠাৎ বাড়ি থেকে খবর এলো—আব্বা ভীষণ অসুস্থ, শয্যাশায়ী। অফিস থেকে দু’দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলাম। ডাক্তার দেখালাম। জানি না বাবা কেন এত উদ্বিগ্নতায় ভুগছিলেন। আম্মার হাত আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘অয়ন বাবা আমার, যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তোর মাকে দেখিস। তুই আর বৌমা ছাড়া ওর এই দুনিয়ায় কেউ নেই।’ বাবার হাতের ছোঁয়ায় শুধু চোখের পানি অঝোরে ঝরতে লাগলো।

চাকরির কারণে ফিরে যাওয়া কর্মস্থলে। আমার মনের ভেতরে সুঁই বেঁধার মতোই খচখচ করছিল পাগল লোকটির কথা। এগারো দিন পর হঠাৎ খবর এলো বাবা আর নেই। আমার মাথার ওপর ছাতা হয়ে শান্তি দিয়ে গেছেন যিনি, কালান্তরী বৃক্ষ হয়ে বুকের জমিনে আগলে রেখে বড় করেছেন যিনি; তিনি আর নেই। কী যে কষ্ট! এ ব্যথার ভার বইবো কেমন করে প্রভু! শক্তি দাও।

পাঁচদিন পর মাকে নিয়ে এলাম আমাদের কাছে। তারপর এক মাসের মধ্যে আম্মার মুখে একদিনও হাসি দেখিনি। সেদিন অফিস থেকে ফিরে আম্মার মুখে হাসি দেখে আমার বুক ভরে গেল। মিলিকে বললাম, ‘দেখেছো আজ আম্মাকে বেশ হাসিখুশি লাগছে।’ মিলি আমাকে সজোরে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আজ শুধু মা কেন, তুমিও খুশি হবে শুনলে। তুমি বাবা হতে যাচ্ছো।’ ‘হ্যাঁ, খুশি হয়েছি বটে। আরও খুশি হতাম যদি আব্বা বেঁচে থাকতেন। না জানি তিনি কত খুশি হতেন? তার বংশ প্রদীপ দেখার যে বড় সাধ ছিল মিলি।’ ‘দুঃখ করো না। দোয়া করো। যেন আল্লাহ আমাদের একটা সুস্থ সন্তান দেন।’

আম্মা নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বংশের প্রদীপ মানে একজন নাতির জন্য প্রার্থনা করতো। মনের ভেতর বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা ছিল না যে, আমি পুত্রসন্তানের বাবা হবো। পাগল বেশে সেই বৃদ্ধই যে আমার অতটা কাছে এসেছিলেন, তা আমি বুঝতে দেরী করলেও আমার ভাগ্য আমাকে পদে পদে অনুভব করিয়েছে তাকে। তিনি নানাভাবে আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছেন, অকৃতজ্ঞ হয়তো আমিই। হুইসেলবিহীন ট্রেনের মতো আমার জীবনের বাহনে চড়ে তিনি নিজেই হুইসেল বাজিয়ে আমাকে থামিয়েছেন। কেটে গেছে একুশ বছর। তার দেওয়া কয়েনটি আজও আমার সাথে স্মৃতির কয়েন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। টাকা কড়ি সম্পদও আমি এমন যত্নে আগলে রাখিনি। যতটা আগলে রেখেছি তার স্মৃতি। এরপর সত্যিই আর কোনোদিন অভাব আমাকে ছুঁতে পারেনি।

সত্য-মিথ্যের শহরে একদিন আমার বিশ্বাস হারিয়ে গেলে কিংবা সাম্রাজ্যবাদী পৃথিবীতে অন্যায়ের ছিটেফোঁটা চোখে পড়লে অথবা অহংকারী মানুষের আগ্রাসী মনোভাব বেশি দেখলে শুধু আপনাকে আমার চোখ খুঁজে বেড়ায়। একটি আপেলের অপেক্ষায়। আপনার কাছে আছে জানি। আজ আমার ছেলে বড় হচ্ছে। বয়সের আধিক্যে ধীরে ধীরে আমিও এগিয়ে চলেছি। জানি না বেঁচে আছেন কি না। নাকি আছেন আমাদের আশেপাশে! একদিন আপনি আমাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন। আজ আমি খুঁজে বেড়াচ্ছি আপনাকে? কই পাই না তো! নাকি আমার মতো হাজারো অয়নের সাথে মিশতে মিশতে এভাবেই মিশে গেছেন। আমি আর একটি আপেল পেতে বাকি জীবনটা সৎ এবং নিরহংকারী হয়েই কাটিয়ে দিচ্ছি আপনার অপেক্ষায়।

এসইউ/জিকেএস