লকডাউনের ছায়ায়
Advertisement
করোনার সেই অচেনা দিনগুলোতে ঢাকা শহর যেন নিজেই এক বন্দিশালায় পরিণত হয়েছিল। রাস্তাঘাট সুনসান, দোকানপাট বন্ধ, ঘরের জানালায় কেবল ঘরবন্দি মানুষের আতঙ্কিত চোখ। চারদিকে এক অজানা ভয় আর তার মাঝেই মানুষের ভেতর জন্ম নিতে থাকে এক অস্বস্তিকর একাকিত্ব। একদিকে যেন বাঁচার জন্য ঘরে থাকা, আরেকদিকে সেই ঘরেই যেন হারিয়ে যাচ্ছিল জীবনের স্বাভাবিকতা। সড়কের কোলাহল থেমে গিয়েছিল, থেমে গিয়েছিল মানুষ। রাস্তাঘাটে মানুষের বদলে দেখা মিলতো কেবল হাওয়া দোলানো পলিথিন কিংবা ধূলিধূসর কোনা দিয়ে হেঁটে যাওয়া এক-আধটা বিড়ালের। দোকানপাটের ঝাঁপ নেমে যাওয়া তালায় যেন বন্দি হয়ে গিয়েছিল পুরো জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিতো শুধু আতঙ্কিত কিছু চোখ—যারা জানে না, কবে আবার সব খুলে যাবে, কবে মানুষ আবার হাসবে।
অপুর পরিবারও এই বন্দিদশার ব্যতিক্রম ছিল না। অপুর বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান এবং সবচেয়ে বড় কথা—তিনি ছিলেন এক স্বপ্নবাজ মানুষ। তিনি এমন একজন মানুষ, যিনি ছুটির দিনেও অফিসের ফাইল হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে থাকতেন—কিন্তু সেই মানুষটিই ধীরে ধীরে হয়ে উঠছিলেন এক নিঃশব্দ যোদ্ধা, যার হৃদয়ে জমছিল চাপা কষ্ট, অভিমান আর আত্মীয়-স্বজনের অসহ্য হিংসার বিষ। দিনের পর দিন কাজ করে একটু একটু করে নিজের স্বপ্নের বাড়ি বানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন একদিন তার নিজের কাছেই ফিকে হয়ে উঠেছিল। কারণ আত্মীয়দের হিংসা, লোভ আর অভিমান।
অপুর দাদা রেখে গেছেন একটি পুরোনো বাড়ি—একদিকে ইতিহাসের ছোঁয়া, অন্যদিকে গভীর পারিবারিক জটিলতা। একসময় সেই বাড়িতে ছোট ছোট পায়ে হেঁটেছিলেন অপুর বাবা। আজ তিনি নিজেই ফিরে এলেন, অতীতের ছায়া মেখে।
Advertisement
অপুর মা ঘরে ছিলেন রান্না, সংসার আর সন্তানদের নিয়ে। আর অপু তখনো বুঝে উঠতে পারেনি, তার বাবার চোখে লুকিয়ে থাকা এক গভীর বিষণ্নতা।
এক বাড়ি, দুই বাস্তবতা
সেই পুরোনো বাড়ির প্রতিটি দরজায়, প্রতিটি দেওয়ালে যেন জমে ছিল স্মৃতি। কিন্তু পাশাপাশি জমেছিল হিংসা, সন্দেহ আর অবিশ্বাস। ‘এই বাড়িতে এখন সে কী করতে এসেছে?’—চাচা জোর গলায় বলে উঠলেন। ‘পুরোটা আমরা দেখভাল করি, এখন সে ভাগ বসাতে এসেছে!’—চাচি চোখ রাঙিয়ে বললেন।
অপুর বাবার চোখে তখন ভেসে উঠছিল শৈশবের দিনগুলো। দাদির হাতে লাগানো আম গাছের ছায়া, মায়ের কোলে বসে রাতের গল্প শোনা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা গোনা। এসব স্মৃতি আজ যেন দংশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু তিনি চুপচাপ থাকলেন। ভাবলেন, হয়তো সময়ই সব কিছু বুঝিয়ে দেবে। কিন্তু সময় তো কারো পক্ষে নয়, বিশেষত যখন মানুষ নিজের হৃদয়টাকে তালাবদ্ধ করে ফেলে।
Advertisement
একদিন পাড়ার কয়েকজন প্রবীণ এসে তাকে বললেন, ‘এই বাড়ি তো আপনি নিজের হাতে গড়েছেন। কাগজপত্র কিছু আছে?’ তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘কাগজের চেয়ে বড় সাক্ষ্য তো আমি নিজেই। এই ইট আর কাঠের নিচে কত স্বপ্ন কেটেছি জানেন?’ সে কথা তারা বুঝলেও অপুর বাবা চোখ নামিয়ে থাকেন। যেন কিছু বলাও নিষ্প্রয়োজন। তার স্মৃতিতে তখন একেকটি ঝাপসা মুখ—মা, যিনি আজ নেই। আর বাবা, যিনি মৃত্যুর আগেও সন্তানদের একসাথে রাখতে চেয়েছিলেন। অথচ কী নিঃসঙ্গভাবে এই বাড়ির চৌকাঠ পার করছেন তিনি! ঘরের দেওয়ালে আজ শুধুই ধূলা জমে না, জমে অতৃপ্তি, জমে অসহায়ত্ব।
একদিন সন্ধ্যায় ঘরের ভেতরে অপু লক্ষ্য করে, বাবার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত নিষ্পত্তি। যেন অনেক লড়াই শেষে কেউ অস্ত্র নামিয়ে দিয়েছে। অপু জিজ্ঞেস করে, ‘বাবা, কেমন আছেন?’ বাবা একটু হেসে বলেন, ‘ভালো আছি। তবে জানিস, ভালো থাকা আর মেনে নেওয়ার মাঝে পার্থক্যটা আর বুঝি না।’
অপু বোঝে, বাবা আসলে ভালো নেই। কিন্তু কী করবে? সে তো এখনো অনেক কিছু বুঝে ওঠার বয়সে নেই। শুধু জানে, বাবার চেহারায় যেন এক বিষণ্ন নদী বয়ে যাচ্ছে, যেখানে আনন্দের কোনো ঢেউ নেই। সেই রাতেই অপু দেখে, বাবা অনেকক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছিল, তিনি তাকিয়ে ছিলেন ছাদের কার্নিশ থেকে টপ টপ করে পড়া জলের দিকে। যেন কোনো পুরোনো স্মৃতি খুঁজি বের করতে চাইছেন সেই ফোঁটার শব্দে।
বিসর্জনের সন্ধ্যা
এক সন্ধ্যায় সবকিছু সয়ে নিয়ে অপুর বাবা নামাজে বের হলেন। অথচ কে জানতো—এই ছিল তাঁর জীবনের শেষ প্রস্থান?
নামাজের মাঝখানেই হঠাৎ করে খবর আসে—‘মসজিদে অপুর বাবা পড়ে গেছেন!’ মুহূর্তেই চারপাশ অস্থির হয়ে ওঠে। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক জানান—হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। অপু ছুটে যায় বাবার পাশে, দেখার জন্য শেষবার। কিন্তু সে চোখে তখন আর কোনো চাওয়া নেই, কেবল এক শীতল নিস্তব্ধতা।
মা ছুটে এসে বাবার নিথর দেহ ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। যিনি এত বছর শক্ত হয়ে সংসার সামলে গেছেন, আজ যেন তার ভেতর ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো। মুখে প্রশান্তি, অথচ বুকের গভীরে ছিল অনাহুত অশান্তি। কয়েক ঘণ্টা পর অপুর জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি সামনে এলো—তার বাবা আর নেই।
অপুর মা নির্বাক হয়ে পড়লেন। যিনি এত বছর স্বামী-সংসার আগলে রেখেছেন, হঠাৎ তার অভাব যেন সবকিছুকে ঠুনকো করে দিলো। অপুর ছোট ভাই চুপচাপ জানালার পাশে বসে থাকল—একটা প্রশ্ন তার মনে, ‘বাবা হঠাৎ করে কোথায় চলে গেলেন?’
বাড়িটা এখনো দাঁড়িয়ে
দিন যায়, মাস পেরোয়, বছরও গড়িয়ে যায়। কিন্তু বাড়ির কোনায় আজও অপুর বাবার রেখে যাওয়া স্পর্শ টের পাওয়া যায়। তার ব্যবহৃত চেয়ার, তার হাতের গন্ধমাখা পাঞ্জাবি কিংবা বারান্দার ছায়া—সবই আজ স্মৃতির বৃত্তে ঘোরে। কিন্তু তার না থাকা মানে কেবল একজন মানুষ কমে যাওয়া নয় বরং একটি আদর্শ, একটি নীরব যুদ্ধ, একটি ভালোবাসার দেওয়াল হঠাৎ ভেঙে পড়া। অপুর বাবার ব্যবহৃত চেয়ারটা এখনো বারান্দায় রাখা। তার পাঞ্জাবির হালকা গন্ধ এখনো বালিশের খাপে লেগে থাকে। তিনি চলে যাওয়ার পরেও যেন এই বাড়ি তাকে ভুলে যেতে পারেনি।
মানুষ তো ভুলে যায়—চাচার ঝগড়া, চাচির রাগ, সব যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু অপুর মনে বাবার সেই কথাটা আজও গেঁথে আছে—‘বাড়ি তো শুধু ইটের দেওয়াল নয়, এটা হলো ভালোবাসার, সময়ের আর আত্মত্যাগের ঘনীভবন।’ কোনো উত্তর নেই। শুধু একটাই সত্য—একটি মানুষ নেই কিন্তু তার অস্তিত্ব পুরো বাড়ির প্রতিটি ইট-পাথরে লেগে আছে।
লেখক: কলেজ রোড, চকবাজার, চট্টগ্রাম।
এসইউ/এএসএম