ঢাকার খুচরা বাজারে এখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে ২০ টাকা পর্যন্ত। এর পরপরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে- এমন আলোচনাও হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
Advertisement
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে বেশিরভাগ সময় পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। গত বছরও ভরা মৌসুমের এই সময় পেঁয়াজের দাম আরও ১৬ শতাংশ বেশি ছিল বলে তথ্য দিচ্ছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এছাড়া ক্ষমতা ছাড়ার আগে গত জুন-জুলাইয়ে পেঁয়াজের দাম ১২০ টাকায় ঠেকেছিল, যা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার নিয়ন্ত্রণ করেছে।
এছাড়া গত কয়েক বছরে দেশে বেশ কিছুবার পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। ২০১৯ সালে ঘাটতি দেখা দিলে কার্গো বিমানে জরুরিভিত্তিতে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়েছে। তবে ওই সময়ও সেসব পদক্ষেপে খুব বেশি সুফল আসেনি। ২৫০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনে খেতে হয়েছে মানুষকে। পেঁয়াজের দামের চাপে পিষ্ট হয়েছে বেশিরভাগ মানুষ। অনেকে পেঁয়াজ খাওয়া প্রায় বন্ধও করেছিলেন তখন।
আরও পড়ুন
Advertisement
বর্তমান বাজারে যখন পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক কম ছিল, তখন পেঁয়াজ চাষিদের বড় লোকসান হয়েছে। কারণ এ বছর প্রতি কেজি পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। কয়েকদিন আগে দেশের বিভিন্ন খুচরা বাজারেই পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ওই দামে। চাষিদের বিক্রি করতে হয়েছে আরও প্রায় ১০ টাকা কমে।
কিছুদিন আগে পেঁয়াজের দামে চাষিদের খরচ উঠতো না জানিয়ে পাবনার চাষি ইউনুস আলী মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতি বিঘা পেঁয়াজ চাষে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা খরচ। এবার ফলন কম। গড়ে ৩৫ থেকে ৪০ মণ করে ফলন হয়েছে। সর্বোচ্চ হয়েছে ৫০ মণ। ঋণ পরিশোধের জন্য জমি থেকে তুলে দফায় দফায় অর্ধেক পেঁয়াজ বিক্রি করেছি। সেসময় হাজার টাকা মণ দর ছিল।’ শুরুতে কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় এখন দাম বাড়লেও মোট খরচ উঠবে না বলে জানান এ চাষি।
‘এখন যে দাম এটা মোটেও বেশি নয়। এটাই পেঁয়াজের স্বাভাবিক দাম। বরং কিছুদিন দাম অস্বাভাবিক কম ছিল, যে কারণে চাষিদের লোকসান হয়েছে।’- কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম
এখন পেঁয়াজের দাম কি অস্বাভাবিক?দেশের সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ উৎপাদন হয় পাবনা জেলায়। ওই জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রামাণিক জাগো নিউজকে বলেন, পেঁয়াজের দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকা পর্যন্ত স্বাভাবিক ও সহনশীল। এরচেয়ে বেশি হলে সেটা অস্বাভাবিক পর্যায়ে চলে যায়, কমে গেলে কৃষকরা লোকসানে পড়েন।
Advertisement
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন যে দাম এটা মোটেও বেশি নয়। এটাই পেঁয়াজের স্বাভাবিক দাম। বরং কিছুদিন দাম অস্বাভাবিক কম ছিল, যে কারণে চাষিদের লোকসান হয়েছে।’
তিনি বলেন, প্রতি কেজি পেঁয়াজে উৎপাদন খরচ ৪০ টাকা, এরপর কৃষকের ন্যূনতম ৫ টাকা লাভ করা দরকার। গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত পাইকারি-খুচরা পর্যায়ে মুনাফা ও পরিবহন এবং যে পরিমাণ সংগ্রহোত্তর অপচয় হয় সবকিছু হিসাবে নিয়ে এ দাম নিশ্চয় স্বাভাবিক।
আরও পড়ুন
১৭ টাকা ৪০ পয়সা কেজিতে পেঁয়াজ বিক্রি করলো কাস্টমস জানা গেলো সেই বৃদ্ধের ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেওয়ার কারণ লাফিয়ে বাড়ছে পেঁয়াজের দাম মিরসরাইয়ে প্রথমবার বাণিজ্যিক পেঁয়াজ চাষে সফল দম্পতিএ অর্থনীতিবিদ বলেন, এখন ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করলেও দাম ৫০ থেকে ৬০ টাকার মধ্যে হবে। বরং ওই দেশের পেঁয়াজের চেয়ে আমাদের পেঁয়াজের মান ভালো, মানুষ বেশি পছন্দ করে। কিন্তু তারপরেও কেউ কেউ ভালো জিনিস ভালো দামে খেতে রাজি নয়।
ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হলে কৃষকের লাভ নিশ্চিত করতে হবে।
‘এরকম দাম হলে কিছু চাষি অন্তত ঋণটা শোধ করতে পারতেন। তারপরেও এ দাম বাড়ায় কিছু মানুষের গায়ে জ্বালা ধরেছে। তারা কৃষকের কথা ভাবেন না।’- কৃষক হারুন শেখ
পেঁয়াজের দাম নিয়ে কী বলছেন কৃষকরাপ্রধান উৎপাদন এলাকা পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ীসহ অন্যান্য জেলায় পেঁয়াজের দাম বাড়ায় এখন কৃষকরা খুশি। তারা বলছেন, শুরুতে লোকসান হলেও এখন তারা কিছুটা লাভ পাচ্ছেন।
এখন ওইসব উৎপাদনস্থলেই প্রতি কেজি পেঁয়াজ (পাইকারি) ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা দাম পাচ্ছেন কৃষক। এই পেঁয়াজ ঢাকার খুচরা বাজারে আসতে আসতে দাম বেড়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় ঠেকেছে।
ফরিদপুরের সালথা উপজেলার কৃষক এনামুল বলেন, ‘অনাবৃষ্টির কারণে এবার তিন দফা সেচ দিতে হয়েছে। ফলে পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এখন দাম বাড়ায় উৎপাদন খরচ উঠছে। আরও কিছুটা বাড়লে আমরা ভালো লাভজনক অবস্থায় যেতে পারব।’
আরও পড়ুন
বোয়ালমারীতে পেঁয়াজ তোলার সময় সংঘর্ষ, আহত ১০ পেঁয়াজ আবাদে অর্ধেক খরচও উঠছে না চাষিদের পেঁয়াজ বীজে লাখোপতি দিনাজপুরের ৫০ চাষি খরচের অর্ধেক দামও পাচ্ছেন না পেঁয়াজ চাষিরাআরেক কৃষক হারুন শেখ বলেন, ‘এরকম দাম হলে কিছু চাষি অন্তত ঋণটা শোধ করতে পারতেন। তারপরেও এ দাম বাড়ায় কিছু মানুষের গায়ে জ্বালা ধরেছে। তারা কৃষকের কথা ভাবেন না।’
কৃষকরা আরও জানিয়েছেন, তারা অনেকে ঘরে বাছাই করা পেঁয়াজ মজুত করেছেন, যা লম্বা সময় ধরে সংরক্ষণ করা যাবে। ফলে পরে বাজার পরিস্থিতি দেখে পেঁয়াজ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেবেন তারা।
ভারত থেকে বেশি পেঁয়াজ আসছে না। যে কারণে এক শ্রেণির মজুতদার ভবিষ্যতে দাম বাড়ার আশায় বেশি বেশি পেঁয়াজ কিনে রাখছেন। যে কারণে এবার পেঁয়াজের দাম হুট করে বেড়েছে।- পেঁয়াজ আমদানিকারক আব্দুল মাজেদ
ব্যবসায়ীরা যা বলছেনএখন পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে ব্যবসায়ী, আড়তদার ও পেঁয়াজের আমদানিকারকরা প্রায় একই রকম তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, মৌসুমের শেষে জমিতে এখন আর খুব বেশি পেঁয়াজ নেই। ভারত থেকেও পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে না। ফলে বেশির ভাগই কৃষক নিজেরা ও মজুতদাররা পেঁয়াজ সংরক্ষণ করছেন। এসব কারণে পেঁয়াজের মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও বাজারে পণ্যটির দাম বেড়ে গেছে।
দেশে সারা বছর সংরক্ষণ করা যায়, ওই ধরনের পেঁয়াজ ওঠেই এ সময়, যা প্রায় পরের মৌসুম পর্যন্ত সারা বছরের চাহিদা মেটায়। ফলে কৃষক পর্যায়ে পেঁয়াজের সংরক্ষণ অস্বাভাবিক নয়। তবে সেই সুযোগে মজুতদাররাও বেশি বেশি পেঁয়াজ মজুত করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
ঢাকার সবচেয়ে বড় বাজার শ্যামবাজারের পেঁয়াজ আমদানিকারক আব্দুল মাজেদ জাগো নিউজকে বলেন, ভারত থেকে বেশি পেঁয়াজ আসছে না। যে কারণে এক শ্রেণির মজুতদার ভবিষ্যতে দাম বাড়ার আশায় বেশি বেশি পেঁয়াজ কিনে রাখছেন। যে কারণে এবার পেঁয়াজের দাম হুট করে বেড়েছে।
আরও পড়ুন
রাজবাড়ীতে ন্যায্যমূল্যের দাবিতে পেঁয়াজ চাষিদের মানববন্ধন পেঁয়াজের দামে হতাশ চাষিরা, গুনতে হচ্ছে লোকসান মুজিবনগরে পেঁয়াজ চাষিদের মানববন্ধন আড়ত ছাপিয়ে ফুটপাতে পেঁয়াজ, দাম গত বছরের অর্ধেকওসমান গণি ও আবদুর রব— দুজনই পেঁয়াজ ব্যবসায়ী। তারা জানান, গত তিন মাসে মেহেরপুরের পেঁয়াজের একটা বাজার ছিল। ওই পেঁয়াজটা এখন নেই। তাছাড়া এখন কিছু মানুষ মজুত করছেন। আবার আমদানিও বন্ধ, সরকার পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিচ্ছে না। সে কারণে দাম বাড়বে বলে ধারণা বেশিরভাগ ব্যবসায়ীর।
দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ লাখ টন। প্রতি বছর উত্তোলন ও সংরক্ষণের সময়ই নষ্ট হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ টন। ফলে চাহিদা মেটাতে ৯ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে প্রতি বছর।
পেঁয়াজের উৎপাদন ও চাহিদা নিয়ে ধোঁয়াশাকৃষি বিভাগের ভাষ্যমতে, দেশে বছরে ৩৬ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়। তবে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, উৎপাদন ২৫ লাখ টনের বেশি নয়। দেশে পেঁয়াজের চাহিদা ২৬ লাখ টন। প্রতি বছর উত্তোলন ও সংরক্ষণের সময়ই নষ্ট হচ্ছে প্রায় ১০ লাখ টন। ফলে চাহিদা মেটাতে ৯ থেকে ১১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হচ্ছে প্রতি বছর। আমদানির বড় অংশই আসে ভারত থেকে। বলা চলে, পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল।
আর এ সুযোগে কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশের পেঁয়াজের মৌসুম শেষ হলে ভারত পেঁয়াজ আমদানিতে চড়া শুল্ক আরোপ করেছে। আবার ভরা মৌসুমে দাম কমিয়েছে, যা দাম বাড়া ও ভরা মৌসুমে কমার একটি বড় কারণ ছিল। এ বছরও গত মার্চে ভরা মৌসুমে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক তুলে নিয়েছে ভারত। দেশটির রপ্তানিকারকরা ১ এপ্রিল থেকে বিনা শুল্কে পেঁয়াজ রপ্তানি করতে পারছেন। তবে দেশে পেঁয়াজের দাম খুব কম থাকায় সেভাবে আমদানি হয়নি।
আরও পড়ুন
আমদানিগত ত্রুটির কারণে নিম্নমানের পেঁয়াজও কেনা হয়েছে উচ্চমূল্যে আমদানির কারণে লোকসান, সড়কে পেঁয়াজ ফেলে কৃষকদের বিক্ষোভ পেঁয়াজ বীজে সমস্যা: ১৬ হাজার কৃষকের মাঝে নতুন বীজ বিতরণ কুষ্টিয়ায় পেঁয়াজ চাষিদের সড়ক অবরোধ এখন আমদানিতে ঝুঁকবেন ব্যবসায়ীরাপেঁয়াজের দাম কিছুটা বাড়ায় আমদানির সুযোগ তৈরি হয়েছে। অনেকে আমদানিতে ঝুঁকবেন বলে জানিয়ে আমদানিকারক আব্দুল মাজেদ বলেন, আগে দেশে দাম কম ছিল, আমদানি করেও মুনাফা হতো না। এখন দেশে যে দাম সেজন্য ভারত থেকে আমদানি করে লাভ হবে। আবার সামনে ঈদুল আজহায় পেঁয়াজের চাহিদা প্রচুর বাড়বে। সেটা মাথায় রেখে সবাই আমদানি করবে।
আরেক আমদানিকারক রনি হোসেন বলেন, ভারতেও এখন ভরা মৌসুম চলছে। স্বাভাবিকভাবেই দাম কম। ফলে সবাই আমদানির দিকে নজর দিচ্ছে, যা বেশ কয়েক মাস প্রয়োজন হয়নি।
এনএইচ/এমএমএআর/এমএস