‘গত সপ্তাহে ঢাকার গরমে মাথা ব্যথায় রাস্তার পাশে অনেকক্ষণ ঝিমিয়ে ছিলাম। মনে হচ্ছিল উঠে দাঁড়াতে পারবো না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে আবার সাইকেল নিয়ে ছুটে চলি। কারণ থামলেই আয় বন্ধ।’
Advertisement
কথাগুলো জাগো নিউজকে বলছিলেন অনলাইনভিত্তিক খাবার ও মুদিপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ফুডপান্ডার ২৩ বছর বয়সী রাইডার মেজবাহ আলম।
তিন মাস ধরে ঢাকার রাস্তায় খাবার পৌঁছে দিচ্ছেন মেজবাহ। সকাল ৯টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত রাস্তায় ছুটতে হয় তাকে। দিনে গড়ে ১৫ থেকে ২০টি অর্ডার বা ফরমায়েশ পেয়ে খাবার পৌঁছে দেন। শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে কখনো বেশি, কখনো বা কম। সব খরচ বাদ দিয়ে হাতে ৫০০ টাকা রাখতে কষ্ট হয় বলে জানান মেজবাহ।
তিনি বলেন, ‘ডেলিভারি মিস হলে অ্যাপে রেটিং কমে যায়, আয় কমে যায়। তাই অসুস্থ থাকলেও রাস্তায় নামতেই হয়।’
Advertisement
শুধু মেজবাহ আলম নন, রাজধানীর অলিগলি আর ব্যস্ত সড়কে ছুটে চলেছেন হাজারো রাইডার বা ডেলিভারিম্যান। কেউ ‘পাঠাও’, কেউ ‘ফুডপান্ডা’, আবার কেউ ‘ফুডি’র ব্যাগ পিঠে নিয়ে ছুটছেন এক ঠিকানা থেকে আরেক ঠিকানায়।
রাজধানীর শান্তিনগরে ফাস্ট ফুড চেইনশপ বিএফসির সামনে কথা হয় ফুডপান্ডার আরেক রাইডার আশরাফুল আমিন রাহাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজটা এমন পর্যায়ে গেছে যে কোনো অফিসিয়াল নীতিমালা নেই। কোনো ছুটি নেই। ছুটি নিলে আয় বন্ধ, আর আয় না হলে খাওয়া বন্ধ।’
জীবন মানেই দৌড়খাবার সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকজন রাইডারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ রাইডারের দিন শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে। চলতে থাকে রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত। এই দীর্ঘ সময়ে রোদ, ধুলা, বৃষ্টি কিছুতেই থামার কোনো সুযোগ নেই। ফরমায়েশের ওপর ভিত্তি করে কেউ প্রতিদিন ১০টি, কেউ ১৫টি, কেউবা আবার ২৫টি ফরমায়েশও গ্রহণ করে খাবার পৌঁছে দেন। অধিকাংশের দৈনিক আয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। কেউ কেউ দৈনিক ৭০০ থেকে ৮০০ টাকাও আয় করেন।
আরও পড়ুনঘরে বসেই মেলে খাবার-নিত্যপণ্য, আছে নগদ ছাড় ফুডপান্ডার ডেলিভারিম্যানকে মারধর, এমপির সাবেক পিএ গ্রেফতার ফুডপান্ডার সাড়ে ৩ কোটি টাকা ভ্যাট ফাঁকি নতুন ফিচার নিয়ে ফুডপান্ডাতারা বলেন, দু-একটি কোম্পানি ছাড়া কেউ মাসিক প্রণোদনা দেয় না। প্রত্যেকের আয় নির্ভর করে ফরমায়েশের সংখ্যার ওপর। নেই কোনো স্বাস্থ্যবিমা, দুর্ঘটনা সহায়তা বা ছুটি। দুর্ঘটনায় পড়লে চিকিৎসা খরচ নিজেকেই বহন করতে হয়।
Advertisement
রাজধানীর বেইলি রোড-মগবাজার এরিয়ায় ফুড ডেলিভারি প্ল্যাটফর্ম ‘ফুডি’র ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করেন সামাদ। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘প্রতি ডেলিভারিতে ৫০ টাকা পাই। কিন্তু অর্ডার সব সময় বেশি থাকে না। এছাড়া সাপ্তাহিক কিছু টার্গেট পূরণ করতে পারলে টাকা আছে, না হলে বাড়তি কোনো আয় নেই।’
জাহিদ হোসেন নামের ফুডপান্ডার ডেলিভারিম্যান বলেন, ‘প্রতি ডেলিভারিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা থাকে। কোনো সময় কম বেশিও হয়। আমাদের আগে থেকেই শিডিউল নেওয়া লাগে। তাই ওই সময় যত ঝড়ঝাপটা আসুক, খাবার পৌঁছাতে হয়। না পৌঁছাতে পারলে আমাদের আইডি বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, আবার লেভেল কমে যায়। অনেক কষ্ট। দৈনিক ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করলেও পোষায় না। এভাবেই চলছে।’
আরও পড়ুনবিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে ফুডপান্ডা বয়কটে ব্যবসায় ধস, মামলা করলো ম্যাকডোনাল্ডস বিরিয়ানিতে মাংস না পেয়ে রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে মামলা‘অনেকের সাইকেল চুরি হয়ে যায়। দুর্ঘটনা হয়, কোনো ক্ষতিপূরণ নেই। যতক্ষণ শ্রম দেওয়া যায়, ততক্ষণই টাকা।’ যোগ করেন জাহিদ হোসেন।
মালিবাগ এলাকায় পাঠাও সার্ভিসে কাজ করেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাজের কোনো নীতিমালা নেই। যতক্ষণ শরীরে সায় দেয়, ততক্ষণ করি। মাসে তো প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা করে সাইকেল চালানো যায় না। কিন্তু ঘরে শুয়ে থাকলে পরিবার চলবে কীভাবে? সেই চিন্তা থাকে।’
স্টিডফার্স্ট কুরিয়ারের কর্মী রাকিবুল বলেন, ‘কাস্টমারের কথা মতো ছুটে যাই। গরমে পুড়ি, বৃষ্টিতে ভিজি। কিন্তু আমাদের জন্য কোনো স্বীকৃতি নেই। আর আমরা বলব কার কাছে? বলে কী লাভ হবে? উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি, আর পার্ট-টাইম হিসেবে এখানে কাজ করছি।’
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রথম ফুড ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে ফুডপান্ডা। এরপর পাঠাও, সহজের মতো বেশ কিছু অ্যাপ এই সেবা দিয়ে যাচ্ছে, যাদের মূল সেবা খাবার সরবরাহ ছিল না। পাঠাও, সহজ নামগুলোর সঙ্গে মানুষের মূল পরিচয় ছিল রাইড শেয়ারিং অ্যাপ হিসেবে। মানুষের চাহিদা পাল্টে যাওয়ায় এবং অনলাইনে পণ্য কেনা-বেচা বাড়ায় এখন পণ্য সরবরাহে যুক্ত হয়েছে অ্যাপভিত্তিক বেশ কিছু কুরিয়ার প্রতিষ্ঠান। স্টিডফার্স্ট, রেডেক্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করছে হাজারো মানুষ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ খাতে এখন হাজার হাজার মানুষ ডেলিভারিম্যান হিসেবে কাজ করছেন। কারও কাছে এটা পার্ট-টাইম, কারও কাছে একমাত্র জীবিকা। কিন্তু অধিকাংশের জীবনেই নেই মাসিক বেতন, ছুটি, স্বাস্থ্যসেবা বা দুর্ঘটনা সহায়তা। তারা ‘ফ্রিল্যান্স পার্টনার’ হিসেবে কাজ করলেও বাস্তবে পেশাগত নিরাপত্তা থেকে বঞ্চিত এক শ্রেণির শ্রমিক।
আরও পড়ুন৮০০ টাকার খাবার কিনতে গিয়ে ৮ লাখ টাকা গায়েব! ‘সাবেককে খাবার পাঠানো বন্ধ করুন’, তরুণীকে ডেলিভারি কোম্পানির ধমক বাংলাদেশি খাবারের স্বাদ পাবে কলকাতাবাসীবাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘের যুগ্ম সম্পাদক প্রকাশ দত্ত জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডেলিভারি বয় বা চুক্তিহীন এসব শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এসব শ্রমিকের সুরক্ষার জায়গা খুবই দুর্বল। কারণ শ্রম আইনে তারা শ্রমিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত নন। এসব শ্রমিকের নিয়োগপত্র নেই, পরিচয়পত্র নেই। তাদের ডেইলি লেবার হিসেবে ট্রিট করে প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে তাদের কোনো দায় না থাকে।’
‘এই লোকগুলো যে সাইকেল নিয়ে ঘুরে সেটা তো তাদের নিজেদের কেনা। তাদের সাইকেলের ক্ষতি হলেও সেই ক্ষতিপূরণ তারা পান না। অল্প বয়সে যে পিঠে এত ভার বহন করে, যে জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে,সেটার দায় তাদের নেই। মালিকপক্ষ তাদের লাভটাই দেখে। আর দেশে বেকারত্বের কারণে এই সুযোগটাই তারা লুফে নেয়। এজন্য শ্রম আইনে এদের শ্রমিক হিসেবে যুক্ত করতে হবে। শ্রম আইনের সব সুবিধা যেন তারা পান সে বিষয়টা নিশ্চিত করতে হবে।’
ই-কুরিয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিপ্লব ঘোষ রাহুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনলাইন ব্যবসার ৯০ শতাংশ ডেলিভারি বয় বা হিরোদের ওপর নির্ভরশীল। এরা ঈদ ছাড়া খুব বেশি ছুটি পায় না। এদের প্রায় ৫০ শতাংশ স্টুডেন্ট, পাশাপাশি আয়ও করেন। কোম্পানিতে এদের জন্য স্যালারি কম, কিন্তু কমিশন বেশি। অনেকে পরিবারও চালাচ্ছে। ট্রেনিং নিয়ে দক্ষ হচ্ছে। এটা খুবই ভালো দিক।’
‘আরেকটি বিষয় হলো এখন শ্রমিকদের সুরক্ষাটা নির্ভর করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওপর। যেমন: আমাদের কোম্পানিতে প্রতিটা লোকের বিমা করা আছে, যাতে তারা অসুস্থ হলে সুবিধা পায়।’ যোগ করেন বিপ্লব ঘোষ।
আরএএস/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম