সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার প্রাণকেন্দ্রের অদূরে শান্ত পরিবেশে দাঁড়িয়ে আছে একটি পুরোনো দোতলা ভবন—রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি। উঁচু ছাদের নিচে ছায়াঘেরা বারান্দা, চুনকাম করা দেওয়াল আর পুরোনো কাঠের দরজা—সবকিছুই যেন নীরব গল্প বলে যায়। এই বাড়ি একসময় জমিদারবাড়ির কাছারি ছিল, কিন্তু ইতিহাসে তার পরিচয় অনেক গৌরবের। এখানেই বারবার এসেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। থেকেছেন, কাজ করেছেন এবং করেছেন অসংখ্য সাহিত্যকর্ম।
Advertisement
রবীন্দ্রনাথ যেভাবে শাহজাদপুরে১৮৪২ সালে কবির দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর এই শাহজাদপুরে জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। পরে জমিদারির তদারকির জন্য রবীন্দ্রনাথ নিজে এখানে বেশ কয়েকবার এসেছেন। বিশেষ করে ১৮৯০ সালে এবং এর পরের কয়েক বছর। তখন তাঁর বয়স মাত্র ঊনত্রিশ। এই সময় তিনি জমিদারির কাজের পাশাপাশি নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন প্রকৃতির সৌন্দর্য ও মানুষের জীবনে। এখানকার গ্রামীণ পরিবেশ, মানুষের মুখের ভাষা, প্রকৃতির রূপ—সবই গভীরভাবে ছুঁয়ে যায় তাঁকে।
জমিদারি অফিস থেকে কবির আশ্রয়রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি মূলত একটি প্রশাসনিক ভবন হিসেবে তৈরি হয়েছিল। নিচতলায় ছিল কর্মচারীদের বসার ঘর, জমিদারির হিসাবের অফিস। ওপরতলায় ছিল বসবাসের ব্যবস্থা। এখানেই কবি থেকেছেন। কক্ষগুলোয় হেঁটে চলতে চলতে এখনো কল্পনায় ভেসে ওঠে তাঁর ছায়া—কখনো একটি চেয়ার টেনে নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন, আবার কখনো পুকুরপাড়ে হেঁটে হেঁটে ভাবছেন কোনো নতুন কবিতা নিয়ে।
যা দেখবেন কাছারিবাড়িতেবর্তমানে ভবনটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। দোতলা ভবনে আছে ১৬টি কক্ষ। ১৬টি কক্ষজুড়েই আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহার্য নানা স্মৃতি। ভেতরে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত জিনিসপত্র—খাট, চেয়ার, লেখার টেবিল, হারমোনিয়াম, ছাতা, কোট, পানদান, কলম ও কালি। কিছু কিছু জিনিস অবশ্য প্রতিলিপি বা সংরক্ষিত নমুনা কিন্তু তা দেখেই বোঝা যায়। কী নিখুঁতভাবে তাঁর স্মৃতি রক্ষা করা হয়েছে। দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে কবির নিজের হাতে লেখা কবিতা ও চিঠির প্রতিলিপি, তোলা কিছু দুর্লভ ছবি এবং জমিদারির খাতার পৃষ্ঠা।
Advertisement
কাছারিবাড়ির সামনে আছে সুউচ্চ বেশ কিছু তালগাছ। দেখে যেন মনে হয় সেগুলো একপায়ে দাঁড়িয়ে। কাছারিবাড়ির পেছন দিকে আছে একটি পুকুর। বাড়িটির চারপাশে ছায়াঘেরা গাছ, শালিকের ডাক, বাতাসের শব্দ। সব মিলিয়ে এক মনোরম পরিবেশ।
আরও পড়ুনবারো আউলিয়ার দরবারে যা দেখবেনরবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়িতে যা যা দেখলামএখানে বসে লেখা চিঠিএই বাড়িতে থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন চিঠি। যা তাঁর সংকলন ‘ছিন্নপত্র’ বইয়ে পাওয়া যায়। এ বইয়ে ১৫১টি চিঠি সংকলিত হয়। যার মধ্যে ১৪৩টি তাঁর ভাইঝি ইন্দিরাকে লেখা এবং এর মধ্যে ৩৪টি চিঠি শাহজাদপুরে বসে লেখা। চিঠিগুলোতে উঠে এসেছে শাহজাদপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং মানুষের জীবন।
জন্ম নেয় কবিতার নদীরবীন্দ্র কাছারিবাড়ির পাশ দিয়েই বয়ে গেছে একটি সরু, শান্ত নদী। তবে বর্তমানে তা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এটি একটি নদী। নদী যেন এক ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নদীটিই হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম বিখ্যাত কবিতা ‘ছোট নদী’র প্রেক্ষাপট। কবির ভাষায়, ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,/ বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।’ এই বিখ্যাত কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে বসেই লিখেছেন।
সাহিত্যে শাহজাদপুরশাহজাদপুরে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু চিঠি নয়, রচনা করেন তার বিখ্যাত সোনার তরী, বৈষ্ণব কবিতা, দুইপাখি, আকাশের চাঁদ, পুরস্কার, হৃদয়, যমুনা, চিত্রা, চৈতালী ইত্যাদি। গীতাঞ্জলি কাব্যের কাজও শুরু করেন শাহজাদপুরেই। পোস্ট মাস্টার গল্পের রতন চরিত্রও শাহজাদপুরে বসেই লেখা। বলা চলে, কাছারিবাড়ি তাঁকে দিয়েছে নির্মল সময়। যেটা প্রয়োজন হয় গভীর মনোনিবেশের জন্য।
Advertisement
কাছারিবাড়িতে উৎসববর্তমানে কাছারিবাড়িটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে আছে। প্রতি বছর ২৫ বৈশাখ এখানে আয়োজন করা হয় রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উৎসব। যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে সাহিত্যানুরাগীরা এসে কবির গান-কবিতায় শ্রদ্ধা জানান। কিন্তু ভবনের কিছু অংশে অবহেলার ছাপ আছে। স্যাঁতসেঁতে ঘর, দরজায় পোকার ক্ষয়, আর তথ্য বোর্ডের জরাজীর্ণতা চোখে পড়ে। সংরক্ষণের দিক থেকে আরও যত্ন প্রয়োজন।
এসইউ/জেআইএম