হাতে-কলমে শিক্ষার সুযোগ কম। ল্যাব ও শিক্ষক সংকট। নেই নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাস। আবাসন সংকটও প্রকট। এসব নিয়েই চলছে দেশের ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজ। এগুলোর মান নিয়ে নতুন করে ভাবছে সরকার। মেডিকেল শিক্ষার মানের বিষয়ে কোনো আপস নয়। মান নিশ্চিত না করতে পারলে বন্ধ করে দেবে সরকার।
Advertisement
দেশে মোট ১১০টি মেডিকেল কলেজের মধ্যে ৩৭টি সরকারি। এর মধ্যে নেত্রকোনা, চাঁদপুর, হবিগঞ্জ, নওগাঁ, মাগুরা ও নীলফামারী সরকারি মেডিকেল ন্যূনতম মান নিশ্চিত করতে পারছে না। সম্প্রতি এই ছয় মেডিকেল কলেজ বন্ধ হওয়ার খবর রটে। এতে নড়েচড়ে বসেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। পাশাপাশি এলাকার রাজনৈতিক ও প্রভাবশালীরাও হয়েছেন সক্রিয়। সংকট দূর করে প্রতিষ্ঠান টেকানোর পক্ষে কাজ করছেন তারা। সরকারও বলছে, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করলে বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন তারা।
জানা যায়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনে নানা নিয়মনীতি বা শর্ত থাকলেও সরকারিতে নেই। যার কারণে নিছক রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণে বিগত সরকারের আমলে বেশ কয়েকটি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করা হয়। এগুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাস, পর্যাপ্ত ক্লাসরুম ও শিক্ষক, এমনকি ল্যাবও নেই। নামে মেডিকেল কলেজ হলেও মানহীন শিক্ষা নিয়ে বের হচ্ছেন চিকিৎসক হিসেবে। নতুন সরকার এমন ছয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজের বিষয়ে কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বলছেন, মানহীন মেডিকেল শিক্ষা রাখা যাবে না। মান নিশ্চিত করার জন্য যা যা করার দরকার, করতে হবে। অন্যথায় বন্ধ করে দেওয়া হবে।
৮৪ পদের ৩৪টিই শূন্য নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজেরজাগো নিউজের নেত্রকোনা প্রতিনিধি এইচএম কামাল জানান, নেত্রকোনা মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী ৩০৯ জন। অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক ও কিউরেটর মিলে অনুমোদিত পদ ৮৪টি। কর্মরত ৫০ জন। অধ্যাপকের ১২টি পদের মধ্যে অধ্যক্ষ ছাড়া বাকি ১১টি পদই শূন্য। ১৩টি ফ্লোরে কার্যক্রম চলে মেডিকেল কলেজের। এর মধ্যে ১২টিতে শ্রেণি কার্যক্রম চলে। একটিতে প্রশাসনিক কার্যক্রম। প্রতিটি ফ্লোর ১৬০০-৩০০০ স্কয়ার ফুটের। নেত্রকোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০০ একর জায়গা থেকে ৫০ একর জায়গা মেডিকেল কলেজকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভূমি মন্ত্রণালয়ে জমির নামজারির জন্য ফাইল রয়েছে। সেটি অনুমোদন হলে নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের দরকার পড়বে না মেডিকেল কলেজের।
Advertisement
ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান। ধীরে ধীরে অবকাঠামোগত ও শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এখন শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ বন্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যা ছড়িয়েছে তা গুজব।-চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মো. হারুন অর রশিদ
সদর হাসপাতালের ওয়ার্ড-কেবিনে চলছে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজচাঁদপুর প্রতিনিধি শরীফুল ইসলাম জানান, চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজের নিজস্ব কোনো ভবন নেই। চিকিৎসা শিক্ষায় পাঠদানের জন্য নেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক। ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে-কলমে শেখার জন্য নেই প্রয়োজনীয় ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরি। পাশাপাশি থাকার জন্যে আবাসিক সংকট তো আছেই। চাঁদপুর সদর জেনারেল হাসপাতালে কেবিন ও ওয়ার্ডের ছোট ছোট ১১টি কক্ষ নিয়ে গত সাত বছর ধরে চলছে চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম।
আরও পড়ুন
‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগে’ সায় নেই নেতাদের২০১৯ সালের ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের একাডেমিক যাত্রা শুরু। বর্তমানে ৪০০ শিক্ষার্থী মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত। যদিও সাত বছরেও চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ পায়নি স্থায়ী ক্যাম্পাস। ভূমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত না হওয়ায় চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চলছে মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম। এ নিয়ে ক্ষোভ আর দুর্ভোগের অন্ত নেই শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে ৫৫ জন শিক্ষক আছেন। তবে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক ২৩ জন শিক্ষকের পদ খালি।
Advertisement
চাঁদপুর সরকারি মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মো. হারুন অর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান। ধীরে ধীরে অবকাঠামোগত ও শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের অনেক সমস্যার সমাধান হবে। এখন শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। চাঁদপুর মেডিকেল কলেজ বন্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে যা ছড়িয়েছে তা গুজব।’
স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত চরবেষ্টিত ৭ ইউনিয়নের লাখো মানুষচাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, ‘চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের জায়গা অধিগ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায় চলে এসেছে। তবে কতদিনের মধ্যে হবে তা এখনো বলা যাচ্ছে না। বিশেষ করে চাঁদপুর মেডিকেল কলেজের কোনো জটিলতা নেই। বন্ধ হয়ে যাবে এমন কোনো তথ্য কিংবা নোটিশ আমরা পাইনি।’
স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজেরহবিগঞ্জ প্রতিনিধি সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন জানান, হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপকসহ ৫১ জন শিক্ষক কর্মরত। ২৮ হাজার বর্গফুট ক্লাসরুম। মেডিকেল প্রতিষ্ঠার পর থেকে গড়ে জেলা সদর হাসপাতালটিতে দৈনিক প্রায় ৮শ থেকে এক হাজার রোগী চিকিৎসা সুবিধা নেন।
হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ জাবেদ জিল্লুল বারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘হবিগঞ্জ মেডিকেল কলেজে একটিই বড় সমস্যা, তা হচ্ছে কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস নেই। এ সমস্যার সমাধান হলেই সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে বলে আমি আশা করছি। তাছাড়া আমাদের এখানে অন্য অনেক মেডিকেল কলেজের তুলনায় সুযোগ অনেক বেশি। শিক্ষার্থীরা পাশেই হাসপাতাল থাকায় প্রচুর রোগী দেখার সুযোগ পাচ্ছে।
প্রথমে চেষ্টা করা হবে মান উন্নীত করার জন্য। না হলে কলেজগুলোর বর্তমান ক্যাপাসিটি কমিয়ে দেওয়া হবে। যেমন ৭৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর অনুমতি আছে, পরের বছর থেকে ৫০ জন করে দেওয়া হবে। সেটাতেও কাজ না হলে শেষ অপশন বন্ধ করা। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে বন্ধ না করার।-স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন
তিনি বলেন, ‘স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য আসলে সরকার চাইলে সদর আধুনিক হাসপাতালের যে জমি রয়েছে তাতেই বড় বড় কয়েকটি বিল্ডিং করে সেখানেই ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে পারে। এর চেয়ে কম জমিতেও অনেক মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এটি করা হলে জমি অধিগ্রহণ করা লাগবে না। যাতায়াত সুবিধাও ভালো। খরচ অনেক কমে যাবে। এছাড়া শহরের আশপাশে অনেক সরকারি জমি রয়েছে। সরকার চাইলে সেসব জমিতেও করতে পারে। এতে সাশ্রয় হবে।’
পুরোনো ভবনে নওগাঁ মেডিকেল কলেজ২৫০ শয্যার নওগাঁ জেনারেল হাসপাতালের পুরোনো ভবনে চলছে নওগাঁ মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম। দ্বিতীয় তলার একটি অংশ বিশেষ মেডিকেল কলেজের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই কলেজের ৩২০ শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম সাতটি লেকচার হল (শ্রেণিকক্ষ) দরকার হলেও আছে চারটি।
ম্যাটসের ভবনে নীলফামারী মেডিকেলনীলফামারীতে ম্যাটসের কার্যক্রম না থাকায় ম্যাটসের জন্য নির্মিত বিভিন্ন ভবনে মেডিকেল কলেজের কার্যক্রম চলছে। পাশেই স্বাস্থ্য বিভাগের প্রায় ৩৫ একর জায়গায় ভবন নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন বলে জানান অধ্যক্ষ জিম্মা হোসেন।
মাগুরা হাসপাতালের পুরোনো ভবনে মেডিকেল কলেজের জন্য তিনটি লেকচার হল, আটটি টিউটোরিয়াল ক্লাসরুম, দুটি গবেষণাগার, কনফারেন্স রুম, লাইব্রেরি, শিক্ষকদের বসার কক্ষ, শিক্ষার্থীদের কমন রুম করা হয়েছে। ছাত্র ও ছাত্রীদের জন্য আলাদা আবাসন সুবিধাও নিশ্চিত করা হয়েছে।
‘বন্ধ নয়, মেডিকেল শিক্ষার মান নিশ্চিতের সিদ্ধান্ত হয়েছে’মেডিকেল কলেজ বন্ধের সিদ্ধান্তের বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছয়টি মেডিকেল কলেজের সমস্যা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। কীভাবে এ সমস্যাগুলো সমাধান করা যায়, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নিশ্চয়ই একটা অপশন হলো- বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হয়েছে, দুর্বলতাগুলো কীভাবে দূর করা যায়!’
কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়ে চলছে ‘নেতৃত্বহীন’ বিএমএতিনি বলেন, ‘একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত যে, মানহীন মেডিকেল শিক্ষা রাখা যাবে না। এটা সরকারি হোক বা বেসরকারি। অবশ্যই এটার ন্যূনতম মান নিশ্চিত করতেই হবে। আর এই মানের জন্য যা করার দরকার করা হবে। প্রথমে চেষ্টা করা হবে মান উন্নীত করার জন্য। না হলে কলেজগুলোর বর্তমান ক্যাপাসিটি কমিয়ে দেওয়া হবে। যেমন ৭৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর অনুমতি আছে, পরের বছর থেকে ৫০ জন করে দেওয়া হবে। সেটাতেও কাজ না হলে শেষ অপশন বন্ধ করা। তবে আমাদের চেষ্টা থাকবে বন্ধ না করার।’
এসইউজে/এএসএ/এমএস