দেশজুড়ে

মার্কেট অন্যের, তবুও ভাড়া চান বিএনপি নেতা

মার্কেট অন্যের, তবুও ভাড়া চান বিএনপি নেতা

সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল নামে এক বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে মার্কেটে থাকা ৫১টি দোকানের মাসিক ভাড়া চাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তার কাছে ভাড়া না দিলে দোকানে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে বলেও হুমকি দেন। এতে বিপাকে পড়েছেন ওই মার্কেটে প্রায় দেড়যুগ ধরে ব্যবসা পরিচালনা করা ৫১ ব্যবসায়ী।

Advertisement

অভিযুক্ত আব্দুল রাজ্জাক মণ্ডল উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও পৌরসভার জিধুরী গ্রামের মৃত মজিবর রহমানের ছেলে। আর তিনি ‘আব্দুল হাই সুপার মার্কেট’ এ থাকা দোকানগুলো থেকে ভাড়া দাবি করছেন বলে অভিযোগ। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিএনপির এই নেতা।

ভুক্তভোগী ও দলিল সূত্রে জানা যায়, উপজেলার চালা মৌজায় ২৬৮ নম্বর দাগের ৭৮ শতক জমির মালিক ওসমান গনি মণ্ডল। ওই সম্পত্তি থেকে ৩০ শতক জমি ১৯৬৫ পানি উন্নয়ন বোর্ড অধিগ্রহণ করে। পরবর্তী ১৯৭৬ সালে ওসমান গনি মণ্ডলের মৃত্যুর পর, বাকি ৪৮ শতক জমির মধ্যে ৪৪ শতক জমিতে আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ওসমান গনি মণ্ডলের চার সন্তান রোস্তম আলী, মজিবর, মতিয়ার রহমান ও আব্দুল হাই মণ্ডলের কাছ থেকে মৌখিক চুক্তিতে নিয়ে নেয় সরকার। এরপর তিন ভাই উক্ত জমির মধ্যে থেকে ৪০ শতক জমি ১৯৭৮ সালের ২৭ নভেম্বর বাটোয়ারা দলিল মূলে (দলিল নং-২২৬৮) আব্দুল হাই মণ্ডলকে হস্তান্তর করেন।

কিন্তু পরবর্তীতে সরকার মৌলিক চুক্তিতে নেওয়া ওই জমিতে বন্যার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ না করায় ৪০ শতক ও বাকি ৪ শতকসহ মোট ৪৪ শতক জমি ফেরত চেয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করেন আব্দুল হাই মণ্ডল। পরে হাইকোর্ট ২০০০ সালের উক্ত জমি ৩০ দিনের মধ্যে আবেদনকারীকে বুঝিয়ে দিতে ভূমি মন্ত্রণালয়কে আদেশ দেন।

Advertisement

এরপর ওসমান গনি মণ্ডলের কন্যা সন্তানের ওয়ারিশ আব্দুল হাকিম গংরা বাটোয়ারা দলিল (মামলা নং ৫৯/২০০৮) বাতিলের দাবিতে আদালতে মামলা করেন। এ মামলায় আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল গংরা অন্তর্ভুক্ত হয়ে জবাব দাখিল করে। পরে মামলাটি ২০১৮ সালের ৪ জুন খারিজ করে দেন আদালত।

এদিকে ২০১৪ সালে মারা যান জমির মালিক আব্দুল হাই মণ্ডল। ফলে বর্তমানে তার ছেলে ইকবাল রানা ওই মার্কেটের দায়িত্ব নেন।

এলাকায় গেলে অভিযোগ পাওয়া যায়, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ইকবাল রানার ৪০ শতক জায়গাসহ মার্কেট দখলের চেষ্টা করেন আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল। এমনকি দেড় মাসে আগে ওই মার্কেটের ওপর জোরপূর্বক একটি সাইনবোর্ডও টাঙ্গিয়ে ছিলেন তিনি।

বিএনপি নেতা আব্দুল রাজ্জাক মণ্ডলের ভাড়া চাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে ওই মার্কেটের চাল ব্যবসায়ী শহীদ আলী মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, মার্কেটটি আব্দুল হাই মণ্ডলের। তার অবর্তমানে আমরা প্রত্যেক মাসে তার ছেলে ইকবাল রানাকে ভাড়া দিয়ে আসছি। কিন্তু হঠাৎ অন্য কেউ ভাড়া চাওয়ায় বিব্রত হয়ে পড়েছি।

Advertisement

মুদি ব্যবসায়ী নূরনবী আক্তার বলেন, আব্দুল হাই মণ্ডলকে দোকানের পজিশন বাবদ দুই লাখ টাকা দিয়ে ২০০৮ সাল থেকে এই মার্কেটে ব্যবসা করছি। পরবর্তী ২০১৪ সালে তিনি মারা যাওয়ায় তার সন্তানদের ভাড়া দিচ্ছি। কিন্তু বিএনপি নেতা আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল গত এক দুই মাস ধরে ভাড়া চাচ্ছেন। তাকে ভাড়া না দিলে দোকানে তালা ঝুলিয়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন।

ভুক্তভোগী ইকবাল রানা বলেন, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া ওই জায়গায় আমরা ২০০৭ সালে একটি মার্কেট ও একটি সেড নির্মাণ করেছি। নির্মাণের পর থেকেই সেগুলো ভাড়া দেওয়া হয়। যথারীতি ভাড়া আদায় করে আসছি। আমরা কোনো রাজনীতি করি না। কিন্তু গত দেড় মাস আগে হঠাৎ মার্কেটের মালিক দাবি করে আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল দলের প্রভাব খাটিয়ে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দেন। পরে সেটি সরিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু এখন আবার মার্কেটের প্রত্যেক দোকানদারের কাছ থেকে তিনি ভাড়া চাচ্ছেন। তাকে এই ভাড়া না দিলে ব্যবসা বন্ধ করে দেবেন বলে হুমকি দিয়েছেন। তার সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে মার্কেট দখলের চেষ্টায় থানায় লিখিত অভিযোগও করেছিলাম।

তাড়াশ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি খন্দকার সেলিম জাহাঙ্গীর বলেন, বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আমাকে ওই জমির কাগজপত্র যাচাই করার জন্য বলেছিলেন। আমি জমির সব কাগজ নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে বসেছিলাম। তারা বলেছেন, আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডলের বাবা ও তার চাচারা বাটোয়ারা দলিল মূলে ওই জমি আব্দুল হাই মণ্ডলের নামে হস্তান্তর করেছেন। সুতরাং ওই জমির মালিক আব্দুল হাই মণ্ডল।

সম্পত্তির মালিক দাবি করে ভাড়া চাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে অভিযুক্ত আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল জাগো নিউজকে বলেন, এতদিন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় ওই জায়গায় আমরা অবস্থান নিতে পারিনি। মূলত হাইকোর্ট ওই জমি আমার বাবা-চাচাদের ফেরত দিয়েছেন। জমিতে আমার বাবার অংশ থাকায় মার্কেটে থাকা দোকানদারদের কাছে ভাড়া চাওয়া হয়েছে।

মার্কেটের ৪৪ শতক জমির মধ্যে ৪০ শতক জমি বাটোয়ারা দলিল মূল্যে আব্দুল হাই মণ্ডল মালিক- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ওই দলিলের কোনো মূল্য নেই। জমি যদি তাদের হয়ে থাকে তাহলে তারা আদালত থেকে আদেশ নিয়ে আসুক।

সিরাজগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবী বিষ্ণুপদ সাহা বলেন, ওই জমির কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উচ্চ আদালতের আদেশ ও বাটোয়ারা দলিল মূল্যে ৪০ শতক জমির প্রকৃত মালিক আব্দুল হাই মণ্ডল। তবে তিনি প্রয়াত হওয়ায় বর্তমান মালিক তার সন্তানরা। আর অবশিষ্ট ৪ শতক জমির অংশীদার ওসমান গণি মণ্ডলের ওয়ারিশরা।

এ প্রসঙ্গে বেলকুচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাকারিয়া হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বিষয়টি মূলত জমির মালিকানা সংক্রান্ত। এজন্য আমরা উভয়পক্ষকে কাগজপত্র দেখে সমাধান করে নিতে বলেছি।

এম এ মালেক/জেডএইচ/জেআইএম