ঢাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে শহীদ আব্দুল্লাহর পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। শোক ও পুরোনো স্মৃতিতে ডুবে আছেন পরিবারের সদস্যরা। চারপাশের ঈদের ডামাডোল যেন আব্দুল্লাহহীন এ পরিবারের কাছে বিষাদের সুর। যশোরের শার্শা উপজেলার বেনাপোল পোর্টথানার বড় আঁচড়া গ্রামের ছোট্ট বাড়িটিতে আনন্দ আনেনি এবারের ঈদ।
Advertisement
ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন আব্দুল্লাহ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট বংশাল থানার পাশে তাঁতী বাজার এলাকায় দুপুর ২টার দিকে পুলিশের গুলিতে আহত হন তিনি। মাথায় গুলি লাগে তার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ঢাকার সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিন মাস ১০ দিন চিকিৎসার পর গত ১৪ নভেম্বর ভোরে মারা যান তিনি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ঈদসহ অন্যান্য ছুটির সময় বাড়িতে আসতেন আব্দুল্লাহ। সারাদিন ভাগ্নি-ভাতিজাদের সঙ্গে আনন্দে দিন কাটতো তার। আব্দুল্লাহর বাড়িতে আসার খবর শুনে ছুটে আসতেন বন্ধুরা। তাদের সঙ্গে দিনভর খেলাধূলা ও গল্প-আড্ডায় সময় কাটাতেন। প্রতিবেশী স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কেউ বাড়িতে এলে তার লেখাপড়ার খোঁজখবর নিতেন আব্দুল্লাহ। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সময় দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন নিজের লেখাপড়াও করতেন। আজ এগুলো শুধুই স্মৃতি।
আব্দুল্লাহর বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভাইকে ছাড়া এবার প্রথম ঈদ করছি। ভাই বাড়িতে আসতো, আনন্দ-উল্লাসে দিন কাটতো। কিন্তু এবারের দিন আমাদের দুঃখ-বেদনার, কান্নার। ছোট ভাই নানা-নানির কবরের পাশে চিরনিন্দ্রায় শায়িত। ভাইয়ের কবর দেখলেই চোখে পানি চলে আসে। কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন জাহাঙ্গীর আলম।
Advertisement
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, প্রতিবছর রমজানে কলেজ ছুটি হলে ভাই বাসায় চলে আসতো। আব্দুল্লাহসহ পরিবারের সব সদস্য মিলে ইফতার করতাম। আজ সকালে ঈদের নামাজের পর আমি, বাবা, মেজো ভাইসহ আব্দুল্লাহর কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। আব্দুল্লাহসহ চব্বিশের অভ্যুত্থানে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের যেন আল্লাহ জান্নাত নসিব করেন। যেসব আহত ভাই রয়েছেন তারা যেন সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসেন দেশবাসীর কাছে এই দোয়া কামনা করছি।
আব্দুল্লাহর মেজো ভাই নুর আলম মিঠু বলেন, ঈদের ছুটিতে আব্দুল্লাহ আমাদের একমাত্র বোনের বাসায় যেত। ভাগ্নি-ভাতিজাদের নিয়ে তার ভালো সময় কাটতো। তাদের আদর করতো, ঘুরাফেরা করতো, কেনাকাটা করতো। আব্দুল্লাহর ক্রিকেট খেলা ছিল খুব পছন্দের। ঈদের ছুটিতে আব্দুল্লাহ বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতো। কলেজ ছুটি থাকলেও সে লেখাপড়ায় সময় দিতো। কীভাবে লেখাপড়া করছে, আগামীতে কীভাবে করবে এসব নিয়ে বাড়িতে বেশি আলাপ-আলোচনা করতো। সেই সঙ্গে বাড়িতে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া কেউ এলে তাকে লেখাপড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতো। কীভাবে লেখাপড়া করলে ভালো রেজাল্ট করা যাবে সেই পরামর্শ দিত। ঈদের সময় নামাজ পড়া হতো বাড়ির পাশে বায়তুল মামুর জামে মসজিদে। আমি, বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম, বাবা, আব্দুল্লাহ এক সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যেতাম।
নুর আলম মিঠু আরও বলেন, আমাদের সংসারে সব সময় অভাব থাকায় শ্রমিকের কাজ করে বাবা পড়াশুনার খরচ বহন করতেন। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে সে চলতে পারতো না। সেজন্য কলেজের আশপাশে টিউশনি করতো। টিউশনির টাকা কিছু বাঁচিয়ে ভাগ্নি-ভাতিজাদের জন্য ঈদে নতুন জামা কিনে আনতো।
শহিদ আব্দুল্লাহর মা মাবিয়া খাতুন বলেন, আব্দুল্লাহ ঈদের সময় গরুর মাংস ও খিচুড়ি খেতে পছন্দ করতো। আমার হাতের রান্না তার অত্যন্ত পছন্দের ছিল। ঈদের সময় আব্দুল্লাহসহ তার ভাই-বোনদের নিয়ে আনন্দে সময় কাটতো। আজ আমার বুকের ধন নেই। একজন মা বোঝে তার সন্তান হারানোর কষ্ট। আমার ছেলেকে আল্লাহ যেন শহীদী মর্যাদা দান করেন।
Advertisement
আব্দুল্লাহর বাবা আব্দুল জব্বার বলেন, আব্দুল্লাহর জন্য কবরের পাশে শুধু কাঁদি আর আল্লাহর কাছে দোয়া করি। এখন সবাই আমার খোঁজখবর রাখে। সবাই আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন। আরও যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সকলের জন্য দোয়া করবেন। আমার ছেলে জীবন দিয়ে নতুন স্বাধীনতা এনেছে। একজন বাবার জন্য এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কী হতে পারে?
মো. জামাল হোসেন/এমএন/এএসএম