মোহাম্মদ সোহেল রানা
Advertisement
একমাস সিয়াম সাধনার পর মুসলিম উম্মাহ আনন্দ ও উৎসবের মাধ্যমে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করছে। পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে নাড়ির টানে রাজধানী ছেড়েছেন বেশিরভাগ মানুষ। ঈদের ছুটিতে সবাই যখন পরিবার নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন; ঠিক তখনই গণমাধ্যমকর্মীরা দেশের নানাপ্রান্তে ঘটে যাওয়া ঘটনা সবার মাঝে তুলে ধরতে বিশেষ এই দিনেও কাজ করছেন। ‘পরিবার রেখে কর্মস্থলে কেমন কাটছে গণমাধ্যমকর্মীদের ঈদ’- আজকের আয়োজনের মাধ্যমে তা তুলছেন মোহাম্মদ সোহেল রানা-
জাতীয় পত্রিকা ঈদের ছুটিতে তিনদিন প্রকাশ হয় না। তবে তথ্য প্রযক্তির এ যুগে এখন প্রায় প্রতিটি পত্রিকারই অনলাইন সংস্করণ রয়েছে। মুদ্রিত পত্রিকা প্রকাশ না হলেও প্রিন্ট মিডিয়ার অনলাইন ও ডিজিটাল মাধ্যম সক্রিয় থাকে। তাই অনলাইন নিউজ পোর্টাল, টেলিভিশন চ্যানেল, রেডিও স্টেশনগুলোতে ঈদের দিনেও ২৪ ঘণ্টা সংবাদ পরিবেশন চলে। সংবাদকর্মী, ক্যামেরাপার্সন, এডিটর, প্রডিউসার, টেকনিশিয়ানসহ অনেকেই পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারেন না। ভোর থেকেই সংবাদ পরিবেশনে তাদের ব্যস্ত সময় পার করতে হয়।
এফ আই মাসউদ, শিফট ইনচার্জ (অনলাইন), দৈনিক আমার দেশ
Advertisement
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ঈদ আনন্দ একটু ভিন্ন রকমই হয়। এই খুশির সময় পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে না পারলেও অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে করছি। কিছুটা মন খারাপ হলেও যখন দেখি বিভিন্ন যানবাহনের চালক-হেলপার গাড়ি নিয়ে ছুটছেন এবং কাজের জন্য রাস্তায় নেমেছেন পরিছন্ন কর্মীরাও। তখন মনে হয় আমি তো তাদের চেয়ে ভালো আছি। আমি অন্তত পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে না পারলেও ভিডিও কলের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে কথা বলছি, খোঁজ-খবর নিচ্ছি। পরিবারকেও দেখতে হবে আবার দায়িত্বের জায়গা থেকে কর্মকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে।
শেখ নাসির উদ্দিন, মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার, ডেইলি সান
ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে পরিবারকে সময় দেওয়া। কিন্তু সাংবাদিকদের জীবনে তো চাইলেই সেই আনন্দ পাওয়া যায় না। কারণ যাদের জন্য ঈদের আনন্দ তাদের সংবাদ সংগ্রহ করাই আমাদের কাজ। আমি ঈদে পরিবারকে মিস করলেও কাজের মধ্যে ঈদের আনন্দ খুঁজি। মাঠের সহকর্মীরাই আমার পরিবার, প্রতিদিন তাদের সঙ্গে আড্ডা দেই, গল্পে মাতি। ঈদে কাজের ফাঁকে কোলাকুলি, সালামি বিনিময় করি। এভাবেই কেটে যায় ঈদ। গ্রামের জন্য মন খারাপ হয়। বাবা-মায়ের সঙ্গে ঈদ করতে কার না মন চায়। ছোটবেলায় ঈদের দিন নতুন কাপড় পড়ে বন্ধুদের সঙ্গে রেললাইনে ঘুরতে যাওয়া খুব মিস করি, বন্ধুদেরও মিস করি। তবে কাজের চাপে আর কাজের প্রতি ভালবাসায় হয়ে ওঠে না। কয়েক বছর ধরে ঢাকায় ঈদ করা হয়। প্রতিটি ঈদে চাঁদরাতে রান্না করি, সহকর্মীদেরও দাওয়াত দেই। সবাই একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করি। এতেই আনন্দ খুঁজে পাই, আমার কাছে ঈদ মানে কাজের মধ্যে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা।
শৈশবের ঈদ ও বর্তমান বাস্তবতামো. আলাউদ্দিন, ভিডিও এডিটর, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Advertisement
আমার শৈশবের ঈদ ছিল আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে ভরা। আজও চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট দেখতে পাই সেই দিনগুলোর স্মৃতি। চাঁদ উঠলেই শুরু হতো আমাদের মিছিল, বন্ধুরা মিলে চিৎকার করে সবাইকে জানিয়ে দিতাম- আগামীকাল ঈদ! এরপর শুরু হতো পটকা ফাটানোর আয়োজন। এ জন্য আমরা বেশ কিছুদিন আগেই প্রস্তুতি নিতাম, মফস্বলের দোকান থেকে পটকা আর খেলনা পিস্তল কিনতাম।
ফজরের আজানে ঘুম ভাঙত, দল বেঁধে গোসল সেরে নামাজে যেতাম। নামাজ শেষে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় ও কবর জিয়ারত করতাম। এরপর শুরু হতো বাড়ি বাড়ি ঘোরা, আপ্যায়ন আর আনন্দের মুহূর্তগুলো উপভোগ করা। বিকেল থাকত খেলাধুলার জন্য। ক্রিকেট-ফুটবলের জমজমাট প্রতিযোগিতা হতো, যা ছিল ঈদের বিশেষ আকর্ষণ। সেই আনন্দ যেন আজ কোথায় হারিয়ে গেছে।
এখন জীবনের প্রয়োজনে শহরে। ঈদের দিন এলেও মায়ের হাতের রান্না খাওয়া হয় না, পরিচিত আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি শুভেচ্ছা বিনিময়ের সুযোগও নেই। তবুও জীবন চলে নিজের গতিতে। অফিস, সহকর্মী, বন্ধু- সব মিলিয়ে শহরেও একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে। তবে হৃদয়ের গভীরে রয়ে গেছে শৈশবের ঈদের উচ্ছ্বাস, যা আর ফিরে পাওয়া যায় না।
পরিবার ছাড়া প্রথমবার ঈদজুবায়ের দুখু, নিউজরুম এডিটর, দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ
ঈদ সব সময় আনন্দের। দীর্ঘ একমাস রোজা শেষে এই উদযাপন যেন আরও আবেগময় হয়ে ওঠে। আমার কাছে মনে হয় ঈদ যেমন রোজার, তেমনই বাড়ি ফেরাও। ঈদ এলেই বাড়ি ফেরার একটা তাগাদা থাকে। মায়ের কাছে, গ্রামের কাছে, পথের কাছে, মাঠের কাছে। কিন্তু এ ঈদে আমার ভাগ্যে বাড়ি যাওয়া হলো না। হলো না বলতে এবারই প্রথম গ্রাম ও মাকে ছেড়ে শহরে একা একা ঈদ করা। আর এই একাকীত্বেই ভেতরে একটা আবেগ কাজ করছে। মাকে মনে পড়ছে, গ্রামকে। আসলে আগে কখনো একা ঈদ করা হয়নি। মায়ের হাতের রান্না খুবই মিস করি। ঈদ বলতে আমিতো ছোট থেকে মাকেই চিনি। আমার নাস্তা সেমাই প্রিয়। ঈদের সকালে মা প্রথম সেটাই রান্না করে খাওয়াতো। এখনতো ফোনের যুগ, গতকাল দেখলাম বন্ধুরা যারা শহর থেকে বাড়ি গিয়েছে এবং গ্রামে যারা থাকে তারা সবাই একসঙ্গে আনন্দ করছে।
মুস্তাফিজ আবির, মাল্টিমিডিয়া রিপোর্টার, দৈনিক রুপালী বাংলাদেশ
পরিবারসহ গত ২৪ বছর যাবত ঢাকায় থাকি। সে সুবাদে প্রায় প্রতিবছরের ঈদ আমার কাটে পরিবারের সাথেই। তবে মাঝে মধ্যেই নাড়ির টানে স্বপ্ন বাড়ির পথে রওয়ানা হয়। এ বছর ঈদে সবাই বাড়িতে গেলেও কাজের কারণে আমার যাওয়া হলো না। স্বাভাবিকভাবেই বাসায় ফিরে ফাঁকা বাসায় নানা গল্প মাথায় বাসা বাধবে। ঈদের আনন্দের ঝাপটা লাগা মনে বাসা বাধবে বিষন্নতা। এ সবই স্বাভাবিক এবং নিয়ম। বাবা-মা ছাড়া ফাঁকা বাসা এবং ঈদ বিষয়টি উপভোগ্য নয় একদমই। তবে কর্মব্যস্ততার মাধ্যমে এই বিষন্নতাকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করি। এই শহরের মানুষদের ঈদের আনন্দ দেখেও আনন্দ পাই। আনন্দ খুঁজে বেড়াই, দুঃখও খুঁজে বেড়াই। প্রাপ্তি খুঁজে বেড়াই, হতাশাও খুঁজে বেড়াই। এই এসবের মাঝেই কেটে যায় সময়। দিনশেষে কাজ, গল্প এবং দায়িত্ব মনোবল বাড়িয়ে দেয়।
লেখক- শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যমকর্মী
এমআইএইচ/এএসএম