খেলাধুলা

‘আমার মনের ভেতরের খবর একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না’

‘আমার মনের ভেতরের খবর একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না’

মুমিনুল হককে এখন শুধুই টেস্ট ক্রিকেটার ধরা হয়। জাতীয় দলের হয়ে তাকে শুধু টেস্ট দলেই ডাকা হয়। ভাবটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মুমিনুল হক হলেন শুধুই টেস্ট ক্রিকেটার। তিনি ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি পারেন না তেমন। এই ছোট-খাট গড়নের সাজানো গোছানো টেকনিক আর দারুণ টেম্পরামেন্টের অধিকারী উইলোবাজও যে সাদা বলে দক্ষ, ৫০ ওভারের ক্রিকেটেও যে তার ট্র্যাক রেকর্ড খারাপ না, তা যেন বেমালুম ভুলে গেছেন অনেকে।

Advertisement

তাই ক্লাব ক্রিকেট আর বিপিএলে মুমিনুলকে সেভাবে মূল্যায়নও করা হয় না। বিপিএলে মুমিনুলের প্রতি আগ্রহ দেখায় না কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি। এবারের প্রিমিয়ার লিগেও মুমিনুলকে শেষ মুহূর্তে দলে টেনেছে আবাহনী। সুযোগ পেয়ে তিনিও প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছেন।

এবার আবাহনীর হয়ে ২টি ম্যাচ জেতানো পারফর্ম করেছেন। এক ম্যাচে পৌঁছে গিয়েছিলেন শতরানের দোরগোড়ায়। মাত্র ৮ রানের জন্য পারেননি। আরেক ম্যাচে ৩৫ রান করার পাশাপাশি বল হাতে ৪ উইকেট দখল করে হয়েছেন ম্যাচ সেরা।

দর্শক ও কর্মকর্তাদের কাছে সাদা বলের পারফরমার মুমিনুলের গুরুত্ব তবুও গেছে কমে। সেটা মেনে নিয়ে কিভাবে নিজেকে ৫০ ওভারের ফরম্যাটের জন্য তৈরি করেন মুমিনুল? ভিতরের লক্ষ্য ও পরিকল্পনা কী? এখনো কি ওয়ানডে খেলার স্বপ্ন দেখেন?

Advertisement

শুনে হয়ত বিশ্বাস হতে চাইবে না, মুমিনুল কিন্তু ভেতরে ভেতরে এখনো ওয়ানডে খেলার ইচ্ছে পোষণ করেন। জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপে অনেক কথার ভীড়ে সে ইচ্ছের কথাই জানিয়েছেন তিনি।

জাগো নিউজ: ঈদ-উল ফিতর, মুসলমানদের সবচেয়ে খুশির দিন। কোথায় করছেন এবারে ঈদ?

মুমিনুল: সাধারণতঃ জাতীয় দলের কোন বিদেশ সফর বা খেলা না থাকলে কক্সবাজার নিজ বাড়িতে বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে একসঙ্গে করা হয়। তবে এবার তা হচ্ছেনা। এবার ঈদ ঢাকাতেই করছি।

জাগো নিউজ: সেটা কি প্রিমিয়ার লিগ এবং জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজের প্রস্তুতির কথা ভেবে?

Advertisement

মুমিনুল: নাহ! ঠিক তা না। আমাদের কক্সবাজারের বাসার কাজ চলছে। সে কারণে এবার কক্সবাজার না গিয়ে ঢাকায় ঈদ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

হ্যাঁ, এর বাইরে প্রিমিয়ার লিগ এর কথাও মাথায় আছে। ৬ এপ্রিল আবার প্রিমিয়ার লিগ শুরু হবে। কাজেই আমি যদি কক্সবাজারে পরিবারের সাথে ঈদ করি, তাহলে তড়িঘড়ি করে যেতে হবে। ফিরতেও হবে খুব তাড়াহুড়ো করে। কারণ খেলার অন্তত ২দিন আগে প্র্যাকটিস। সেক্ষেত্রে তিন এপ্রিলের মধ্যে ফেরার তাড়া থাকবে। সব মিলিয়েই এবার আর যাওয়া হচ্ছে না নিজ বাড়িতে ঈদ করতে।

জাগো নিউজ: তাহলে দেশে থেকে এবারই প্রথম বাড়িতে ঈদ করা হচ্ছে না?

মুমিনুল: হ্যাঁ, এর আগে জাতীয় দল ও যুব দলের হয়ে বিদেশে খেলতে গিয়ে বার কয়েক বিদেশে পরিবার ছাড়া ঈদ করেছি। তবে দেশে থেকে এবারই প্রথম ঈদ, যাতে আমি কক্সবাজার যাইনি। ঢাকায় শুধু স্ত্রী আর আমি মিলে প্রথম ঈদ করবো।

জাগো নিউজ: খারাপ লাগছে না?

মুমিনুল: হ্যাঁ, জাতীয় দল, ‘এ’ দল ও যুব দলের হয়ে খেলতে গিয়ে দেশের বাইরে কয়েকবারই ঈদ করেছি। বাবা-মা ছাড়া একটু খারাপ তো লেগেছেই। কিন্তু আমার তত খারাপ লাগেনি। আমি একজন পেশাদার খেলোয়াড়, আমার দেশ ও জাতীয় দলের কাছে একটা দায়বদ্ধতা আছে।

জাতীয় দলের হয়ে খেলার জন্য দেশের বাইরে পরিবার ছাড়া ঈদ করাতো পার্ট অফ মাই জব। আমিতো দেশের হয়ে খেলার জন্যই দায়বদ্ধ। আমরা আসলে ইমোশনাল জাতি। একটু আবেগ দিয়ে ভাবি আর দেখি। আমার মনে হয় একটু সচেতনভাবে গভীরে গিয়ে চিন্তা করলেই আর খারাপ লাগবে না। খারাপ লাগার প্রশ্নও উঠবে না। প্রফেশনাল কাজে আপনি যত ইমোশনাল হবেন, ততই সাকসেস কমবে।

জাগো নিউজ: জাতীয় টেস্ট দলের প্র্যাকটিস কবে থেকে?

মুমিনুল: ১১ এপ্রিল থেকে সিলেটে জাতীয় দলের হয়ে রিপোর্ট করতে হবে।

জাগো নিউজ: প্রিমিয়ার লিগের শেষ রাউন্ডতো ১৩ এপ্রিল। তাহলে সেই রাউন্ড আর খেলা হবে না আপনাদের?

মুমিনুল: আমি যতদুর জানি প্রিমিয়ার লিগে আমার দল আবাহনীর শেষ ম্যাচ মোহামেডানের সাথে। আমার মনে হয় না শেষ ম্যাচ খেলা হবে। তার দুইদিন আগেই সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট টিমে রিপোর্টিং।

জাগো নিউজ: কেন শেষ রাউন্ড শেষেও তো ক্যাম্প শুরু করা যেত?

মুমিনুল: সেটাতো ন্যাশনাল টিম ম্যানেজমেন্ট জানে। তবে আমার যেটা মনে হয়, যেহেতু আমরা সাদা বলে ৫০ ওভারের প্রিমিয়ার লিগ খেলছি, তাই চর্চাটা সাদা বলেই কেন্দ্রিভুত আছে। লাল বলেও প্র্যাকটিস দরকার। দুই বলের চরিত্রগত পার্থক্য আছে। লাল বলে খেলা একটু ভিন্ন।

টেস্টের আগে অন্তত ৭ থেকে ৮টা প্র্যাকটিস সেশন লাল বলে করলে ভাল হয়। না করলে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়। এর আগে শ্রীলঙ্কার সাথে খেলার আগে একবার এমন হয়েছিল। সাদা বলে গিয়ে অল্প প্রস্তুতিতে টেস্ট খেলতে নেমে আমাদের খুব সমস্যা হয়েছিল। হয়ত সেদিকটা মাথায় রেখেই ১১ এপ্রিল থেকে সিলেটে অনুশীলন শুরুর চিন্তা।

জাগো নিউজ: ধরেই নেয়া হয় যে, মুমিনুল শুধুই টেস্ট প্লেয়ার। তাকে শুধু টেস্টেই বিবেচনায় আনা হয়। হবে। সে আর সাদা বলে জাতীয় দলে খেলবে না। তাই তাকে নিয়ে প্রিমিয়ার লিগ ও বিপিএলে কোন হইচই হয় না। এবারও আপনাকে নিতে শুরুর দিকে তেমন উৎসাহ দেখায়নি কোন দল। পরে আপনি আবাহনীতে খেলছেন এবং ভাল খেলছেন। এভাবে একা একা মনোসংযোগ, মনোযোগ আর উৎসাহ ধরে রাখা কতটা কঠিন? প্রিমিয়ার লিগে খেলার জন্য কিভাবে নিজেকে তৈরি করেন?

মুমিনুল: আমার মনে হয় ব্যাপারটা পুরোপুরি মেন্টাল। মাইন্ড সেটই আসল। মেন্টাল সেটআপ যদি গ্রো না হয় বা আপনি মানসিকভাবে চিন্তা না করলে নিজেকে তৈরি করা সম্ভব না। আমি অত কিছু চিন্তা করি না। আমি নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করি পারফরম করার জন্য। আমি যখন যে লেভেলে খেলি, সেখানে পারফর্ম করার চিন্তাতেই খেলি।

জাগো নিউজ: এই মাইন্ডসেট কিভাবে করছেন। আপনি তো জানেন আপনাকে ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের জন্য ভাবা হচ্ছে না। তারপরও ৫০ ওভারের প্রিমিয়ার লিগ খেলছেন। তাও আবাহনীর মত চ্যাম্পিয়ন দলে। এ আসরে নিজেকে কিভাবে তৈরি করছেন?

মুমিনুল: ক্রিকেট খেলাটাই সাদা ও লাল বলে ডিফারেন্স। মাইন্ডসেট তৈরি করতে হয়। আমি জানি কোন বলে কোন ফরম্যাটে কখন কিভাবে নিজেকে তৈরি করতে হবে, স্টো আমি জানি। ফরম্যাট ও বলের ভিন্নতায় নিজেকে মানসিকভাবেও ভিন্নভাবে তৈরি করতে হয়।

জাগো নিউজ: কিন্তু আপনারতো সামনে সে অর্থে ওয়ানডে দলে খেলার হাতছানি নেই। আপাততঃ অদুর ভবিষ্যতে আপনাকে শর্টার ফরম্যাটে জাতীয় দলে বিবেচনায় আনা হচ্ছে না। এরকম অবস্থায় আপনি আবাহনীর মত দলে খেলতে নেমে কিভাবে নিজেকে তৈরি করছেন?

মুমিনুল: আমার মনে কি হচ্ছে, সেটা অন্য কেউ জানবে না। আমার আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আমার মনের ভিতরে কি চলছে। আমার ইচ্ছে ও আকাঙ্খা কি, তা কিন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ দেখে না। একমাত্র আমি জানি আর আল্লাহ জানেন। আমি মানুষের কথা ভাবি না। মানুষ কি ভাবছে, তা আমি চিন্তায়ও আনি না। মানুষতো জানে না যে, আমি কিন্তু ঠিক এখনো ওয়ানডে খেলার কথা ভাবি। আমার কিন্তু মনে হয়, আবারও ন্যাশনাল টিমের হয়ে ওয়ানডে খেলবো। সেটা একান্তই আমার মনের গহীনে সযত্নে লুকায়িত ইচ্ছা। আমি একটা লক্ষ্য নিয়েই খেলতে থাকি। আমি কিন্তু এখনো ওয়ানডে খেলার আশা করি। তবে সেটা আকাশ-কুসুম কল্পনা করে নয়। পারফরম করে। আমি টেস্ট খেলি , প্রিমিয়ার লিগ খেলি সব জায়গায় পারফরম করার চিন্তায় থাকি।

আমার মূল লক্ষ্য হলো, যেখানেই খেলি ভাল খেলবো। ভাল খেললে আবার ওয়ানডে দলে সুযোগ পেতেও পারি। আমার নিজেকে দেখানোর কোন ইচ্ছে নেই। বোর্ড যখন মনে করবে আমার ওয়ানডে দলে দরকার। তখন ডাকবে। কাউকে দেখানোর কিছু নেই। আমার প্রমাণেরও কিছু নেই। আমি জানি ৫০ ওভারের ফরম্যাটে ভাল খেললে আমাকে ডাকা হতেও পারে।

জাগো নিউজ: সামনেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ। জিম্বাবুয়েকে এখন সে অর্থে খুব কমজোরি দূর্বল দল বলে গণ্য করা হয়। আপনি কি ভাবছেন? এমন দূর্বল দলের সাথে ভাল খেলার সদিচ্ছা ও আকাঙ্খা থাকে কতটা?

মুমিনুল: আমি পেশাদার ক্রিকেটার। বাংলাদেশ দলে দীর্ঘদিন ধরে খেলছি এবং টেস্ট দলের অন্যতম সিনিয়র সদস্য। আমি আমার মত ভাবি। কে কিভাবে কাকে কেমন ভাবলো, কি ধরলো না ধরলো- তাতে কিছু যায় আসে না। যে কোন ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচের ‘ট্যাগ’ থাকলে তার একটা ভিন্ন মেজাজ, ধরন ও রূপ থাকে।’

‘পাশাপাশি একটা প্রেশারও তৈরি হয়। একটা ইনটেন্সও তৈরি হয়। একটা ভাইভ জাগে। তাই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট বিশেষ করে টেস্টে কাউকে ছোট ও খাট করে দেখার সুযোগ নাই। একই মেন্টাল সেট আপ থাকা উচিৎ। একই ইনেটেনসিটি ও একই গোল থাকা উচিৎ। জিম্বাবুয়ের সাথে খেলাতেও তাই সব হিসেব নিকেশেই আমাদের সিরিয়াস থাকা উচিৎ। প্রতিপক্ষ হিসেবে জিম্বাবুয়েকে তাই অবহেলার ও ছোট করে দেখার কিছুই নেই। শতভাগ প্রফেশনাল অ্যাপ্রোচ নিয়ে ফুল ইনটেনসিটিতে খেলা উচিত।’

এআরবি/আইএইচএস