প্রবাস

মায়ের সংগ্রামী জীবন এবং এক অশ্রুসিক্ত ইতিহাস

মায়ের সংগ্রামী জীবন এবং এক অশ্রুসিক্ত ইতিহাস

যুদ্ধ শুরুর আগেই আমার ভাই ঢাকায় ছিলেন। আমরা ছয় বোন, এক ভাই সবার বড় আর আমি সবার ছোট। বাবা তখন কলকাতায় ব্যবসা করতেন। হরতালের কারণে বাবার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। একদিন বাবা ছেলেকে দেখতে ঢাকায় যান, কিন্তু সেই যাত্রায় তিনি আর ফিরে আসতে পারেননি।

Advertisement

ঢাকায় পৌঁছে বাবার চোখে পড়ে সবুর খানের বিল্ডিংয়ে জ্বলা দাউ দাউ আগুন। বাবা ধরে নিয়েছিলেন, তার একমাত্র ছেলে সেই আগুনের মধ্যে আটকা পড়েছে। একমাত্র সন্তানের শোকে বাবার হৃদয় ভেঙে যায়। মেহেরপুর ফিরে এসে আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরবিদায় নেন।

কিছুদিন পর ভাই বাড়ি ফিরলেন। তখন দুই বোন শ্বশুরবাড়িতে, আর আমরা চার বোন আর মা বাড়িতে। ভাই আমাকে আর মধু বোনকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। আমি তখন মাত্র এক বছরের শিশু। গুলিস্তানে একটা হোটেলে প্রথমে উঠেছিলাম। ১৫ মার্চ, ১৯৭১—চারদিকে শুধুই হরতাল আর কারফিউ। আমরা বাইরে বের হতে পারতাম না। পরে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী রহিমা খালার সহযোগিতায় খিলগাঁওতে ১৫০ টাকা ভাড়ায় বিশাল এক বাড়ি পেলাম। ভাই কাজে যেতেন, আর রহিমা খালা আমাদের দেখাশোনা করতেন।

২৬ মার্চ: মৃত্যুর ছায়া নেমে এলো

২৬ মার্চ রাতে গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। ভাই সবাইকে খাটের নিচে লুকিয়ে রাখলেন। কাঁচের জানালা ভেঙে গুলি আসছিল ঘরের ভেতরে। সকাল হলে ভাই আমাদের সঙ্গে নিয়ে শরণার্থীদের সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বের হলেন। টঙ্গীর জঙ্গলের মধ্যে এক নির্জন বাড়িতে আমাদের রেখে ভাই যুদ্ধে ট্রেনিং নিতে গেলেন। মা বলতেন, সেই বাড়ি ছিল ঘন গাছপালায় ঢাকা, একেবারে জনমানবহীন।

Advertisement

অন্য প্রান্তে শোক আর অনিশ্চয়তা

ভাই ট্রেনিং শেষে ফিরে এসে বললেন, আমাদের কুমিল্লা যেতে হবে। অন্যদিকে ভাবিরা তিন সন্তান নিয়ে গাংনীতে তার বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। মা ছিলেন দুই বোনের জন্য আতঙ্কে। খবর পেলেন, মিলিটারিরা মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বাবা হারানোর শোক আর দুই বোনের নিরাপত্তা নিয়ে মায়ের মনে দুঃসহ যন্ত্রণা!

কিছুদিন পর খবর এলো, আমাদের ফুফাতো ভাই দুই বোনের বিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু চার নম্বর বোনের স্বামী, একজন কলেজ ছাত্র, বিয়ে করেই যুদ্ধে চলে গেলেন। মায়ের দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেলো। খাবারের অভাবে আমাদের অবস্থা তখন ভয়াবহ। ভাই একেক দিন একেক এলাকায় যুদ্ধে যেতেন। আমি তখন ক্ষুধার জ্বালায় কান্না করতাম, আর মধু ছিল চুপচাপ—আজও সে তেমনি।

ভাইয়ের বন্দিত্ব আর মৃত্যুর হাতছানি

কুমিল্লা থেকে আবার খিলগাঁওতে ফিরে এলাম। রহিমা খালা মাঝেমধ্যে খাবার এনে দিতেন। একদিন ভাই আর বাসায় ফিরলেন না। খবর এলো, মিলিটারিরা তাকে ধরে নিয়ে গেছে। মা জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। কিছুদিন পর জানা গেলো, মিলিটারিরা ভাইকে বেত দিয়ে মেরে শরীর ক্ষত-বিক্ষত করেছে। এরপর একদিন খবর এলো, ভাইকে গুলি করে হত্যা করা হবে, তার শেষ ইচ্ছা মা আর ছোট দুই বোনকে একবার দেখা।

ভাইয়ের ফিরে আসা: জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ

একজন লোক এসে মাকে খবর দিলো। মা চিনতে পারলেন—এ লোকটাই ভাইকে ধরিয়ে দিয়েছে শান্তি কমিটির মাধ্যমে। মা বললেন, ‘আমাদেরও গুলি করে মেরে ফেলুক, তবু ছেলেকে দেখতে যাব।’ মা পাথরের মতো নিথর হয়ে বসে রইলেন। কিছুক্ষণ পর শান্তি কমিটির সেই লোক আর দুই-তিনজন মিলিটারি ঠেলাগাড়িতে সাদা কাপড়ে ঢাকা ভাইকে নিয়ে এলো। মা ধরে নিলেন, বাবার মতো ভাইয়েরও লাশ ফিরে এলো।

Advertisement

কাপড় সরানোর পর ভাইয়ের চোখে সামান্য নড়াচড়া দেখলেন মা। চিৎকার করে কান্না শুরু করলেন। মিলিটারিরা সেই দৃশ্য দেখে বোধহয় কেঁদে ফেলেছিল। হয়তো তাদেরও মা-বোনের কথা মনে পড়েছিল। তারা ভাইকে আমাদের কাছে রেখে চলে গেলো। কিন্তু ভাই তখনও কথা বলতে পারছিল না, শরীর নিথর, মনে হচ্ছিল যে কোনো সময় প্রাণ চলে যাবে।

মায়ের লড়াই: যুদ্ধের পরে বেঁচে থাকার সংগ্রাম

মা তখন পাগলিনীর মতো ছুটছিলেন, কোথায় যাবেন বুঝতে পারছিলেন না। শান্তি কমিটির একজন লোক এসে বলল, ‘বের হবেন না, মিলিটারিরা জানলে গুলি করবে।’ মা সেই ভয়ংকর জীবন পার করে আমাদের মানুষ করলেন। যুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো, কিন্তু আমাদের জীবনে স্বাধীনতার স্বাদ আসেনি।

স্বাধীনতা পেলাম, তবুও…

মায়ের মুখে শোনা সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা এখনো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। এই সংগ্রামী মা-ই আমাদের টিকিয়ে রেখেছিলেন। নিজের সবকিছু বিসর্জন দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পরও যুদ্ধের ক্ষত আমাদের পরিবারে রয়ে গেছে। আমার ভাই, যার সাহসিকতায় আমরা বেঁচে ছিলাম, সেই ভাইয়ের দুঃসহ স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে।

এই গল্প শুধু আমার মায়ের সংগ্রামের নয়, বরং লাখো মায়ের আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি।

এমআরএম/জেআইএম