বিনোদন

সাংস্কৃতিক পরিবেশকে সুস্থ ধারায় ফেরাতে সংস্কৃতিকর্মীর দায় রয়েছে

সাংস্কৃতিক পরিবেশকে সুস্থ ধারায় ফেরাতে সংস্কৃতিকর্মীর দায় রয়েছে

২০২৫ সাল সবার কাছেই নতুন স্বাধীনতার স্বাদে উদ্দীপ্ত হওয়ার বছর। এ বছর স্বাধীনতা দিবসটি আমার কাছেও ভিন্ন অর্থ ও বার্তা নিয়ে এসেছে। কারণ বাংলাদেশ এতদিন একটি কারাগারে বন্দি ছিল। সেই জায়গা থেকে মানুষ মুক্ত হয়েছে।

Advertisement

জুলাই অভ্যুত্থানের পর ১৬-১৭ বছরের দুঃশাসন থেকে মানুষ মুক্ত হয়েছে। স্বাধীনতার স্বাদ, মুক্ত পরিবেশে জীবনযাপন, মুক্ত কণ্ঠে কথা বলা, ব্যক্তি স্বাধীনতা – সব কিছুই এখন স্বাধীনভাবে উপভোগ করতে পারছে মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে দেশের সব মানুষ এখন মুক্ত।

আমি একজন সংগীতকর্মী। সংগীত আমার মূল কাজ। যেহেতু আমি একটি রাজনৈতিক দলের মত ও আদর্শে বিশ্বাসী, সে কারণে আমি এতদিন পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছি। সরকারি কোনো গণমাধ্যমে আমাকে কখনই কাজের সুযোগ দেওয়া হয়নি। তিনবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত একজন শিল্পী হয়েও সরকারি কোনো জায়গায় কোনো ধরনের সুবিধা আমি পাইনি। এমনকি সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠানে আমাকে দাওয়াত পর্যন্ত দেওয়া হতো না। এটি আমার জন্য ছিল ভীষণ কষ্টের, কারণ আমি দেশের মানুষের জন্য গান গাই, দেশের জন্য গান গাই, সাধারণ মানুষের জন্য গান গাই।

সংগীত পরিবেশন সুবাদে প্রায়ই আমি দেশের বাইরে যাই। বহু দেশে গান করার সুযোগ আমার হয়েছে। প্রতিটি দেশেই দেখেছি, মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম কত গভীর। সেই তুলনায় বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম খুবই কম, বিশেষ করে আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে। গত ১৬ থেকে ১৭ বছর যারা দেশ শাসন করেছেন, তাদের মধ্যে দেশপ্রেম বলতে কিছু লক্ষ্য করিনি। তাদের সবার মধ্যে দেখেছি কেবলই আত্মপ্রেম। তারা সবসময় নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যস্ত ছিলেন।

Advertisement

এ রকম রাজনীতিবিদদের ভিড়ে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কথাটা বিশেষভাবে বলতে হয়। তিনি একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। দেশ স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, কিংবা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন কিন্তু এত অরাজকতা হয়নি। অন্তত আমার নিজের সেক্টরের কথা বলতে পারি। সেসময় সব ধর্ম, মত, বর্ণের শিল্পীরা গান করেছি সরকারি-বেসরকারি গণমাধ্যমে। সবাই একসঙ্গে কাজ করেছি। তখন কারো টেলিভিশন-রেডিওতে প্রবেশ নিষেধ ছিল না। সবার নিজ নিজ কাজটি করার স্বাধীনতা ছিল। তখন ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের ব্যাপারটি এ রকম ছিল না। সবাই ম‍ুক্তভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেসময় আমাদের সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, তারাই অন্য সরকারের আমলে আমাদের সরকারি গণমাধ্যমে প্রবেশ করতে দেননি। আমার নেতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান, দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের এ রকম মানসিকতা ছিল না, যেটা আমরা বিগত আমলে লক্ষ্য করেছি।

বিগত সরকারের আমলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল না। কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না। অবাধে কাজ করার স্বাধীনতা ছিল না। তাহলে দেশপ্রেমের কথা, সুস্থ সংস্কৃতির কথা আমি বলবো কোথায়? এ জন্য স্লোগানটা দেবো কোথায়? সত্য ও ন্যায়ের কথা কীভাবে বলবে মানুষ? যেখানে আমাদের সব ধরনের অধিকারই হরণ করে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে আমরা কীভাবে কথা বলবো? দেশের এসব পরিস্থিতি দেখে সবসময় আমার ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়েছে। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারিনি।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে একটা গানের অনুষ্ঠান করেছিলাম। সেটির নাম ছিল ‘সবার আগে বাংলাদেশ’। আমাদের নেতা, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, এ আয়োজনের নাম দিয়েছেন। তখন আমাদের পক্ষ থেকে তাকে প্রশ্ন করা হলো, অনুষ্ঠানটি কীভাবে করা হবে? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘সবার অংশগ্রহণে করা হবে। সবশ্রেণির শিল্পীরা এতে অংশ নেবেন। যারা এ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চান, আপনারা সবাইকে দাওয়াত দিন। এখানে এসে সবাই গান করুক। তিনি তার বক্তব্যে একাধিকবার বলেছেন, বাংলাদেশের বাউল থেকে শুরু করে সব শ্রেণির শিল্পীরা এখানে অংশগ্রহণ করবেন। কারো অংশগ্রহণে কোনো বিধিনিষেধ নেই।’ এ অনুষ্ঠান তিনি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আমরাও তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করিনি। আমরা কেউ বলিনি, অমুক শিল্পী এলে আমরা থাকবো না।

ঈদের পর আরও চার বিভাগে সারা দেশের শিল্পীদের নিয়ে গানের অনুষ্ঠান হবে। এ অনুষ্ঠানগুলো হবে একই নামে। তারেক রহমান বলেছেন, ‘সবার জন্য মঞ্চ উন্মুক্ত থাকবে। সংস্কৃতির উন্নতির জন্য সবার সহযোগিতা লাগবে।’ তিনি বলেননি, ‘অমুক গেলে অনুষ্ঠান হবে না, তমুক গেলে অনুষ্ঠান হবে না।’ তিনি বরাবরই বলেছেন, ‘সংস্কৃতি একটি বিশাল ব্যাপার। সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করতে হলে সবার সহোযোগিতা কাম্য।’ গত ১৬ বছরের নিষ্পেষিত জীবনে বাধ্য হয়ে তিনি দেশের বাইরে থেকেছেন। তারপরও বলেছেন, ‘সবাইকে নিয়ে কাজ করতে হবে।’ এভাবেই আমাদের সবার মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে।

Advertisement

আরও পড়ুন: মান ভেঙেছে, রাজনীতিতে ফিরছেন মনির খান গানের সেই ‘অঞ্জনা’ আসলে কার প্রেমিকা

আমি আশাবাদী মানুষ। আমরা একটি স্বাধীন দেশের মানুষ। কেন আমরা সব দিক থেকে উন্নতি করতে পারবো না! এ দেশের মানুষ জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারও প্রমাণ করেছে, এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য সব করতে পারে। আমার ধারণা, বিশ্বে বাঙালিই একমাত্র জাতি, যারা বিপদের মুহূর্তে তাৎক্ষণিকভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, দেশরক্ষার জন্য যুদ্ধ করতে পারে। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, স্বাধীনভাবে থাকার জন্যই এ দেশের মানুষ সবসময় যুদ্ধ করেছে। এ জন্য আমি আশাবাদী যে, আগামীতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার স্বাদ ও মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারবো।

“দেশের সংস্কৃতি সুস্থ নয় বলে দেশটিও সুস্থ নয়। দেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশকে একটা সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে সংস্কৃতিকর্মীর দায় রয়েছে। এটি কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়”

শিল্প হচ্ছে মানুষের যৌথ কাজ। সবার সম্মিলিত প্রয়াসে এগিয়ে যেতে হবে। দেশের সংস্কৃতি সুস্থ নয় বলে দেশটিও সুস্থ নয়। দেশের সাংস্কৃতিক পরিবেশকে একটা সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে সংস্কৃতিকর্মীর দায় রয়েছে। এটি কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের এ বিষয়ক কোনো ইনস্টিটিউট নেই যে, যেখানে থেকে আমরা দেশপ্রেমের কথা বলবো। সংস্কৃতি অঙ্গনে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করছে। পরিবেশ স্থিতিশীল করতে হলে সময় দরকার। আমরা আশাবাদী সেই সময়টা আমাদের কাছে ধীরে ধীরে আসবে। সেই স্থিতিশীলতা আমাদের অর্জন করতে হবে। সুসময় আনতে হলে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যেতে হবে। তাহলেই আমরা জাতিকে সুস্থ সংস্কৃতি ও সুন্দর রাজনীতি উপহার দিতে পারবো। তাহলেই এই স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে।

অনুলিখন: মিজানুর রহমান মিথুন

এমএমএফ/আরএমডি/এএসএম