ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে ২ মাস (মার্চ-এপ্রিল) নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে সরকার। এর আওতায় লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ষাটনল পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার মেঘনা নদীতে এ নিষেধাজ্ঞা চলছে। মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে সরকার জেলেদের খাদ্য সহায়তা (চাল) দিচ্ছে। কিন্তু এ সহায়তার বাইরেই থাকছেন লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুর জেলার প্রায় ৫২ হাজার জেলে। এতে বাধ্য হয়ে অনেকেই নদীতে মাছ শিকারে যাচ্ছেন।
Advertisement
১৭ মার্চ দুপুরে চাঁদপুর সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নে জেলেদের মাঝে চাল বিতরণকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে অন্তত ৩৫ জন আহত হয়েছেন। স্থানীয় লোকজন জানান, কিছু জেলে কার্ড ছাড়া চাল নিতে চাইলে উভয়পক্ষের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে কার্ডধারী ও কার্ডছাড়া জেলেরা লাঠিসোঁটা, দেশীয় অস্ত্র ও টেঁটা নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর জেলায় নিবন্ধিত জেলে ৪৬ হাজার ৪৯ জন। সম্প্রতি জেলেদের নিবন্ধিত তালিকা যাচাই-বাছাই করা হয়। সবশেষ তালিকা অনুযায়ী তা দাঁড়ায় ৩৮ হাজার ২৮০ জেলে। এরমধ্যে ২৮ হাজার ২৪৪ জন জেলে চাল পাবেন। তবে বেসরকারি হিসেবে লক্ষ্মীপুরে জেলে রয়েছেন ৬০ হাজার। চাঁদপুরে ৪৫ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। এরমধ্যে খাদ্য সহায়তা পাবেন ৪০ হাজার ৫ জন। সার্বিক প্রেক্ষাপেটে নিষেধাজ্ঞা চলাকালে লক্ষ্মীপুর ও চাঁদপুরে প্রায় ৫২ হাজার জেলে চাল বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রত্যেক জেলের ৪০ কেজি করে ৪ বারে ১৬০ কেজি চাল পাওয়ার কথা রয়েছে।
আরও পড়ুন- নিষেধাজ্ঞার ১০ দিনেও জেলেদের ভাগ্যে জোটেনি সরকারি চাল নেই সেই দস্যুতা, তবুও কাটে না দুর্দশা মধ্যরাত থেকে দুই মাস পদ্মা-মেঘনায় মাছ ধরা বন্ধজেলা মৎস্য বিভাগ সূত্র জানায়, জেলেদের মধ্যে ১৮ বছরের নিচে, যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তাদের নিবন্ধন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাবা-চাচাদের সঙ্গে অনেকে ৮-১০ বছর বয়স থেকেই নদীতে মাছ শিকারে যায়। প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়ায় তারা জেলে সুবিধা পাচ্ছে না।
Advertisement
রায়পুরের উত্তর চরংশী ইউনিয়ন পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইউছুফ মিয়া বলেন, জেলেদের মধ্যে চাল বিতরণ করা হচ্ছে। এ তালিকার বাহিরে অনেক জেলে রয়ে গেছেন। এ কারণে সুবিধাবঞ্চিত জেলেরা ইউপি কার্যালয়ে ধরণা দিচ্ছেন।
চাঁদপুরের হাইমচর মাছঘাট এলাকার জেলে মো. লতিফের চোখে-মুখে রাজ্যের ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘দেশে কীয়ের হস্কার হইতাছে (দেশে কীসের সংস্কার চলছে)? মেম্বার আরতন (আমার কাছে) ৪ হাজার টিয়া (টাকা) চাইছে। দি নো, হিয়ার লাই চাইলও হাই না (না দেওয়াতে চালও পাচ্ছেন না)।’
কোন মেম্বার জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাহি (বাকি) বিপদে হালঅইতেন (ফেলতেন) নাম চান?’
কমলনগর লুধুয়া ঘাটের জেলে শরিফ হোসেন ও রায়পুরের চরবংশীর নাইয়াপাড়ার জেলে মহব্বত আকন জানান, রাজনৈতিক কারণে স্থানীয় মেম্বার নিবন্ধন তালিকা থেকে তাদের নাম বাদ দিয়েছেন। তাদের ছেলে-ভাতিজারা ৮-১০ বছর ধরে নিয়মিত নদীতে মাছ ধরলেও চালের তালিকায় নাম আসেনি। টাকা দিয়ে অন্য পেশার লোকেরা জেলের চাল সুবিধা নিচ্ছেন।
Advertisement
লক্ষ্মীপুর জেলে ফেডারেশনের সভাপতি মোস্তফা বেপারী বলেন, জেলেদের চালের তালিকায় স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ইউপি সদস্যরা প্রকৃত জেলেদের নাম বাদ দিয়ে নিজেদের অনুসারী ও টাকার বিনিময়ে নাম দিয়েছেন। এছাড়া চাল ওজনে কম দেওয়া হয়। প্রতিবাদ করেও কোনো সুফল নেই।
লক্ষ্মীপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, সবশেষ জেলে নিবন্ধন তালিকা করার সময় যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে ছিল, তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। সে হিসেবে অনেকে তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। জেলে নিবন্ধনে কোনো অনিয়ম হয়নি।
চাঁদপুর জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাছান বলেন, নদীতে যাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য চাঁদপুরে ৪০ হাজার ৫ জন জেলেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। ৪০ কেজি করে তারা ৪ বার চাল পাবেন। এছাড়া নিববন্ধিতসহ আরও কিছু জেলে সহায়তা সুবিধা থেকে বাদ পড়ছেন।
২০০৬ সাল থেকে জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশ উৎপাদন বাড়াতে মার্চ-এপ্রিল মাস নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। লক্ষ্মীপুরের চর আলেকজান্ডার থেকে চাঁদপুরের ষাটনল পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার নদীতে এ নিষেধাজ্ঞা চলছে। এসময় ইলিশসহ সব ধরনের মাছ সংরক্ষণ, আহরণ, পরিবহন, বাজারজাতকরণ ও মজুদকরণ নিষিদ্ধ। নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের কমপক্ষে এক থেকে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানাসহ উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা চলবে।
এফএ/এএসএম