মতামত

চিন্তায় এবং কাজে নৈতিক এবং সৎ থাকতে হবে

আমাদের অনেকেই চিন্তায় এবং কাজে সৎ থাকি না। কোন ব্যক্তি কাজে সৎ তখনই হবে যখন সে চিন্তায় সৎ থাকবে, নৈতিক থাকবে। চিন্তায় এবং কাজে সততা থাকা এবং আত্মপরিশুদ্ধির ব্যাপারে বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন, “An unexamined life is not worth living” । তার এই ধারণা প্রকাশ করে যে সত্যিকারের জ্ঞান অর্জন এবং সৎ জীবন যাপন করতে হলে ব্যক্তিকে প্রথমেই চিন্তায় সৎ হতে হবে এবং নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে যে সে আসলেই কতটুকু সৎ। যে চিন্তায় সৎ না সে কাজেও সৎ থাকতে পারে না বরং সে আত্মপ্রতারণার মধ্যে বাস করে।

Advertisement

সততা (Honesty) হল সৎ হওয়া এবং দৃঢ় নৈতিক নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি সুসংগত ও আপসহীন আনুগত্য দেখানোর গুণ । সততাকে একজনের কর্মের সততা এবং সত্যবাদিতা বা আন্তরিকতা হিসাবে বিবেচনা করা হয় । সততা ভণ্ডামির বিপরীত বিষয়।

নৈতিকতা (Ethics) হল মানুষের আচরণ, সিদ্ধান্ত এবং মূল্যবোধে সম্পর্কিত বিধি-নিষেধ। এটি সঠিক এবং ভুল, ভাল এবং খারাপের পার্থক্য নির্ধারণ করে। নৈতিকতা আমাদের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং অন্যদের প্রতি আচরণ নির্ধারণ করে। নৈতিকতা মানুষের আচরণকে চারটি মৌলিক প্রশ্নে-উত্তরের মাধ্যমে গড়ে তোলে-

• সঠিক কী? — এটি নির্ধারণ করে, কোন কাজ বা আচরণটি সঠিক বা ভুল।• ভাল কী? — এর মাধ্যমে জীবনে ন্যায়, সহানুভূতি, এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির গুরুত্ব বোঝায়।• দায়িত্ব কী? — এটি একজন মানুষের কর্তব্য বা দায়িত্ব বোঝায়, যেমন অন্যদের প্রতি সম্মান দেখানো।• ন্যায়বিচার কী? — এটি সমাজের মধ্যে সবার জন্য সমান অধিকার এবং সুযোগের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

Advertisement

নৈতিকতা ধর্ম, দর্শন, আইন এবং সামাজিক মূল্যবোধের মধ্যে বিশ্লেষণ এবং আলোচনার মাধ্যমে গঠিত হয়। এটি শুধু ব্যক্তি বা সমাজের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেই নয়, বরং ব্যবসা, চিকিৎসা, পরিবেশ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একজন মানুষের চিন্তায় এবং কাজে উভয়েই সৎ থাকতে হওয়া উচিত, কারণ সততা মানুষের ব্যক্তিগত উন্নতি এবং সমাজের শৃঙ্খলা ও শান্তির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সততা শুধু আমাদের আচার-ব্যবহারেই নয়, বরং আমাদের চিন্তা-ভাবনা এবং নৈতিক মূল্যের সাথেও সম্পর্কিত। এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও সম্মান বৃদ্ধি করে।

পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক অনুশাসন এবং কার্যকর নীতি ও আইনের মাধ্যমে নৈতিকতা ও সততার চর্চাকে উৎসাহিত করা জরুরি। আমাদের উচিত আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক সাহস বজায় রেখে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ জীবনযাপন করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা একটি আদর্শ সমাজ রেখে যেতে পারি।

চিন্তার সততা কী? চিন্তায় সৎ থাকা মানে হল, আমরা যা ভাবি এবং বিশ্বাস করি, তা যেন সত্য এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে হয়। এভাবে চিন্তা করলে আমরা নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসী এবং শান্তিপূর্ণ থাকি, কারণ অস্থির, অসত্য বা মিথ্যা চিন্তা মানুষকে মানসিকভাবে অবস্থা বিরক্ত এবং অশান্ত করতে পারে।

কাজের সততা কী? কাজে সৎ থাকা মানে হল, আমরা যা করি, তা যেন আমাদের নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। এক্ষেত্রে আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে আমরা সমাজের কাছে ভালো উদাহরণ স্থাপন করি। সৎ কাজে অনড় থাকা, মানুষের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে, সম্পর্কের মধ্যে স্বচ্ছতা আনে এবং সবার জন্য একটি ন্যায্য পরিবেশ তৈরি করে।

Advertisement

আমাদের চারিপাশে অনেক কিছুই আছে যা পাওয়ার ইচ্ছা বা লোভের উদ্রেক করে। ধনী-গরীব সমাজে থাকবেই এবং এটাই সৃষ্টির বৈচিত্র্য। আমরা সমাজে অনেক কিছুই দেখব বা শুনব। প্রয়োজন থাকবে তবে সেই প্রয়োজন যেন নিজের সৎ প্রচেষ্টায় অর্জিত হয়। লোভকে সংবরণ করা শিখতে হবে এবং পরিবারের সবাই কে সে শিক্ষা দিতে হবে যেন কিছু দেখেই বা শুনেই যেন লোভে পতিত না হই। মনে এবং কাজে সৎ থাকাই মহত্ত্ব এবং এটা এক প্রকার ইতিবাচক স্মার্টনেস।

অভাবী মানুষ অসৎ হতে পারে। তবে যে ব্যক্তি সৎ পথে তার প্রয়োজন অনুযায়ী আয় করেন এবং তাতেই সে তুষ্ট থাকেন তাহলে সে অসৎ হবে না। লোভ এবং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত চাহিদা,এবং বিলাসিতার জীবন মানুষকে অসৎ করে। পরিবারে এবং সমাজে অভাব থাকলে প্রয়োজন মেটাতে অনেকেই অসৎ হয়- জাতীয় পরিকল্পনায় এবং ব্যবস্থাপনায় অভাব দূর করার পদ্ধতি থাকতে হবে। তবে চিন্তায় এবং কাজে ব্যক্তি সৎ থাকলে অভাবও মানুষকে অসৎ করতে পারে না।

চিন্তায় এবং কাজে সততা এবং নৈতিকতা না থাকার কারণ-

১. স্বল্পকালীন লাভের আকর্ষণ: মানুষের মনের একটি প্রাকৃতিক প্রবণতা হল যে, তারা স্বল্পকালীন এবং সহজ লাভের দিকে ঝুঁকে পড়ে । মন্দ কাজগুলি সাধারণত দ্রুত ফলাফল দেয়, যেমন মিথ্যা বলা, প্রতারণা, বা অসততা; এগুলোর মাধ্যমে কিছুক্ষণের মধ্যে সুবিধা পাওয়া যায়। অন্যদিকে, ভালো কাজের ফলাফল সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি এবং ধীরে ধীরে আসে। মানুষের মধ্যে "নগদে সুবিধা" পাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে, যা তাদের মন্দ কাজের দিকে আগ্রহী করে তোলে।

২. অভ্যস্ততা এবং সংস্কৃতি : সমাজের কিছু অংশে মন্দ কাজ বা অসৎ আচরণকে কখনো কখনো সাধারণ বা গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখা হয়। যখন কিছু ভুল বা অসততা সাধারণভাবে বিদ্যমান থাকে, তখন সে কাজগুলোকে মানুষ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে। যদি এটি সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়, তবে মানুষ সহজে এগুলোর দিকে চলে যেতে পারে। কিছু ব্যবসায়িক বা রাজনৈতিক পরিবেশে দুর্নীতি বা অসৎ কাজকে তেমন একটা সমস্যা হিসেবে দেখা হয় না, বরং এটি "নর্ম" হয়ে যায়, যা মানুষকে এভাবে আচরণ করার দিকে প্ররোচিত করে।

৩. অনুভূত চাপ এবং প্ররোচনা : মানুষ অনেক সময় সামাজিক বা পারিবারিক চাপের মুখে পড়ে ভাল কাজ করতে ইচ্ছুক হলেও মন্দ কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই ধরনের চাপের মধ্যে থাকে কম্পিটিশন, নিজেকে অন্যের থেকে এগিয়ে রাখা, বা অন্যদের কাছে সম্মান অর্জন করার তাড়না। এক্ষেত্রে মানুষ মন্দ কাজগুলোকে সোজা, সহজ এবং দ্রুত ফলস্বরূপ মনে করতে পারে। যখন কোনো ব্যক্তি চাকরির ক্ষেত্রে অগ্রগতি করতে চায় এবং দেখে যে তার সহকর্মীরা দুর্নীতির মাধ্যমে দ্রুত লাভ পাচ্ছে, তখন সে এই প্রবণতার দিকে টেনে যেতে পারে, বিশেষত যদি সে মনে করে যে সবাই এই কাজই করছে।

৪. স্বার্থপরতা এবং নিজস্ব লাভের দিকে মনোযোগ : মানুষ অনেক সময় নিজের স্বার্থকে আগে রাখে এবং তখন সে খুব সহজে মন্দ কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমনকি, এর পেছনে নৈতিক বা সাংস্কৃতিক কারণে বিবেকের দংশন না থাকারও একটা ভূমিকা থাকতে পারে। যখন কেউ শুধু নিজের লাভের কথা ভাবেন, তখন তিনি সততার কথা ভুলে যান। ব্যবসায়ী বা ব্যক্তি যদি জানে যে তার ছোট মিথ্যা কিছু লাভ এনে দেবে, তবে সে সেই মিথ্যেটি বলার সাহস পায়, কারণ এতে তার আর্থিক বা সামাজিক সুবিধা হতে পারে।

৫. ভুল সামাজিক আদর্শ এবং রোল মডেল : এখনকার সমাজে অনেক সময় মন্দ কাজ বা অসৎ আচরণকে শো-বিজ, মিডিয়া, বা অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বাহিত রোল মডেল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সামাজিক মিডিয়া বা টেলিভিশন শোতে যখন কোনও চরিত্র খারাপ কাজ করছে এবং তার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করছে, তখন তা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলস্বরূপ, কিছু মানুষ সেই মন্দ আচরণের দিকে আকৃষ্ট হয়ে যায়। অনেক টিভি শো বা সিনেমাতে দেখা যায় যে একটি অপরাধী চরিত্র সমাজে অনেক দ্রুত সফল হয়, যা বাস্তবে সঠিক নয়। কিন্তু কিছু মানুষ মনে করে, "এই চরিত্রটা সফল, এরকম কাজ করলে হয়তো আমি সফল হতে পারি।"

৬. মনোসংযোগের অভাব বা সহজ পথের খোঁজ : মন্দ কাজ কখনও কখনও সহজে বাস্তবায়নযোগ্য হয় এবং এতে মানুষের মধ্যে জটিলতা বা কঠিন পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না। মানুষের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা থাকে যে তারা সহজ ও স্বল্প পরিশ্রমে ফল পেতে চায়, এবং মন্দ কাজগুলো তা সরবরাহ করে। যেমন, কেউ যদি চাকরি পেতে দ্রুত ধনসম্পত্তি অর্জন করতে চায়, তবে সে যদি অবৈধ বা অসৎ পথে কিছু লাভ পায়, তাহলে সে সেটি করতে আগ্রহী হতে পারে কারণ এতে পরিশ্রম বা সময় লাগে না।

৭. সামাজিক প্রভাব এবং বন্ধুদের প্রভাব: মানুষ অন্যদের প্রভাবেও সিদ্ধান্ত নেয়। যদি তার আশেপাশে অনেক বন্ধু বা পরিচিত ব্যক্তি মন্দ কাজ করে থাকে, তবে তারাও সেই পথে চলে যেতে পারে। এটি একটি প্রক্রিয়া যা "সামাজিক প্রভাব" নামে পরিচিত। এই প্রভাব তাদের কাছে একটি নৈতিক মানদণ্ড হিসেবে কাজ করে, যেখানে মন্দ কাজ করা স্বাভাবিক মনে হয়। যদি একটি বন্ধুর গ্রুপে সবাই ধূমপান করে বা মদ্যপান করে, তবে নতুন সদস্যও সেই গ্রুপের সঙ্গে একাত্ম হতে গিয়ে সেগুলি শুরু করে।

দেশের বাস্তব চিত্র-

আমাদের দেশের সাম্প্রতিক দুর্নীতির চিত্র এবং কিছু সাধারণ মানুষের অসৎ মানসিকতার বাস্তব উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ প্রকাশিত শ্বেতপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী আওয়ামী শাসন আমলে গত ১৬ বছরে দেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন বা এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে টাকার অঙ্কে যা প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। এই টাকা আমাদের সাধারণ জনগণের টাকা এবং যা দিয়ে বাংলাদেশের বিরাট একটা অংশের দরিদ্র বিমোচন করা যেত, মানুষের অভাব দূর হলে মানুষ সৎভাবে জীবন যাপন করতে পারত। দুঃখের বিষয় হলো, এই ভয়ংকর আর সর্বগ্রাসী দুর্নীতি এবং লুটপাট প্রকাশ্যেই হয়েছে এবং সমাজের উপরের পর্যায়ের ব্যক্তিরাই এই দুর্নীতির সাথে বেশী জড়িত ছিল।

গত ৬ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে ‘আমার দেশ’ পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল যে, যশোরে ড. মিজানুর রহমান আজহারীর ওয়াজ মাহফিলে প্রচুর পরিমাণে মোবাইল ফোন চুরি হয়েছে এবং প্রায় ৭০/৮০ টি জিডি হয়েছে। এই ওয়াজে অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে নিষেধ বলা হচ্ছিল। তা না হলেও অন্তত খারাপ কিছুই বয়ান করা হয়নি। এটা সম্পূর্ণভাবে একটা ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল- তাহলে এখানে এত চুরি হল কেন? এত চুরি কে করল, কেন করল? ওয়াজ মাহফিলে তো ভাল কাজের উপদেশ দেয়া হয় এবং সেটাই মানুষের শোনার কথা, উপকারে আসার কথা। এখানেই চিন্তায় এবং কাজে সততার ঘাটতি অনেক।

ব্যক্তির চিন্তায় এবং কাজে সততা সৃষ্টির উপায়

১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সততা এবং নৈতিক শিক্ষা প্রদান: প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত, স্কুল এবং কলেজগুলোতে নৈতিক শিক্ষা এবং মানবিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব দেয়া উচিত। শিশুদের শেখানো উচিত কীভাবে সৎ থাকতে হয়, কীভাবে অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হয়, এবং কীভাবে নৈতিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। শিক্ষকরা যদি নিজে সৎ থেকে সৎ থাকার গুরুত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেন এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিকতা এবং সততা শেখান, তবে তারা তাদের ভবিষ্যতে ন্যায্যতা এবং সততা বজায় রাখতে সচেতন হবে।

২. পারিবারিক ভূমিকা: পরিবার হলো বুনিয়াদী শিক্ষার সূতিকাগার। পরিবারে সততা ও নৈতিকতার শিক্ষা ব্যক্তির জীবনে সুদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। বাবা-মা, অভিভাবকরা যদি নিজেদের আচরণে সততা এবং নৈতিকতা প্রদর্শন করেন, তবে সন্তানেরাও তা শিখবে। যদি একজন বাবা বা মা বাড়িতে কোনো বিষয় সম্পর্কে মিথ্যা বলার বদলে সৎ এবং সত্য কথা বলেন, তাহলে সন্তানদের সামনে একটি ভালো উদাহরণ স্থাপন হবে। এভাবে সন্তানদের মধ্যে সততার মূল্যবোধ গড়ে উঠবে।

৩. ধর্মীয় শিক্ষা: ধর্ম মানুষের মধ্যে এক ধরনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অনুভূতি তৈরি করে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস মানুষকে সততার পথে পরিচালিত করতে পারে, কারণ তারা মনে করে যে তাদের প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং নেতৃবৃন্দ ব্যক্তিদের সততা চর্চায় প্রভাব ফেলতে পারে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান, উপদেশ, এবং উপাসনার মাধ্যমে মানুষ সততা ও নৈতিকতার প্রতি অনুপ্রাণিত হয়। তবে এক্ষেত্রে ধর্মীয় উপদেশ প্রদানকারী ব্যক্তিকে সমাজে মনে এবং কাজে সৎ থাকার প্রমাণ থাকতে হবে

৪. নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন: সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সততা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর নীতিমালা এবং আইন প্রণয়ন করে এবং তা বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ় পদক্ষেপ নেয় তবে কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের সততার দিকে নেয়া যেতে পারে। যখন আইন ভঙ্গের শাস্তি বা সুফল পরিষ্কার হয়, তখন মানুষ সততা বজায় রাখার প্রতি আরো মনোযোগী হয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং তার বাস্তবায়ন একটি ভালো উদাহরণ। সরকারি কর্মকর্তাদের সৎ ও নৈতিক আচরণ বাধ্যতামূলক রাখতে হবে।

৫. সমাজে সততার মূল্যায়ন ও পুরস্কৃত করা: যারা সমাজে সৎভাবে কাজ করে, তাদের সম্মানিত ও পুরস্কৃত করা গেলে সততার চর্চা আরও বৃদ্ধি পাবে। যদি সৎ ব্যক্তিদের সম্মান ও পুরস্কৃত করা হয়, তাহলে অন্যদেরও সেই পথ অনুসরণ করার আগ্রহ বাড়বে। সমাজের মধ্যে সততার পুরস্কার বা ন্যায় বিচারের জন্য সম্মাননা প্রদান করা হতে পারে।

৬. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রচারণা: সততা এবং নৈতিকতা সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে প্রচারণা চালানো যেতে পারে। গণমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন সেমিনার/কর্মশালার মাধ্যমে মানুষকে সততার গুরুত্ব ও উপকারিতা সম্পর্কে জানানো যেতে পারে। সরকার বা এনজিওগুলো সততার প্রচারণা চালাতে পারে যেখানে তারা সাধারণ জনগণকে মিথ্যা, প্রতারণা, দুর্নীতি এবং অন্যায় আচরণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে শিক্ষিত করবে। এই প্রচারণার মাধ্যমে মানুষের মাঝে সততার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে।

৭. সাংবাদিকতা এবং মিডিয়া: মিডিয়া, বিশেষত সাংবাদিকতা, সততার প্রচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যদি সাংবাদিকরা সমাজে সৎতা ও ন্যায়ের পক্ষে কাজ করে, তাহলে তারা জনগণকে সততার গুরুত্ব সম্পর্কে জানাতে সহায়তা করবে। যদি কোনো সাংবাদিক দুর্নীতি বা অন্যায় কর্মকাণ্ড প্রকাশ করেন, তাহলে তিনি সততা এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার দিকে সহায়তা করেন।

৮. নেতৃত্বের উদাহরণ এবং প্রেরণা: নেতৃত্ব, বিশেষ করে রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক বা সামাজিক নেতাদের সততা দেখানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি নিজেদের কর্মকাণ্ডে সততা ও নৈতিকতার প্রতিফলন ঘটান, তবে সাধারণ মানুষও তাদের অনুসরণ করবে। একজন দেশ বা অঞ্চলের নেতা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন এবং ব্যক্তিগতভাবে সততা প্রদর্শন করেন, তবে জনগণ সেই নেতার উদাহরণ অনুসরণ করবে।

চিন্তা ও কর্মে নৈতিকতা ও সততা কেবল আদর্শ নয়, এটি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সুস্থ ও টেকসই উন্নয়নের প্রধান ভিত্তি। একজন নীতিবান ও সৎ ব্যক্তি শুধু নিজেকে নয়, বরং চারপাশের মানুষকেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেন। নৈতিকতা ও সততার অভাব সমাজে দুর্নীতি, অন্যায় ও অবিচারকে বাড়িয়ে তোলে, যা সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে। এজন্য পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক অনুশাসন এবং কার্যকর নীতি ও আইনের মাধ্যমে নৈতিকতা ও সততার চর্চাকে উৎসাহিত করা জরুরি। আমাদের উচিত আত্মবিশ্বাস ও নৈতিক সাহস বজায় রেখে সৎ ও ন্যায়পরায়ণ জীবনযাপন করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা একটি আদর্শ সমাজ রেখে যেতে পারি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা।

এইচআর/এএসএম