কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, আমরা ফকির কখনোই লালনবাদ প্রচার করি না। এটা পরিষ্কার থাকা উচিত। লালনবাদ বলে কোনো ধর্ম নেই। এটা গুরুবাদী ধর্ম।
Advertisement
বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের স্মরণোৎসব উপলক্ষে বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) বিকেলে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউরিয়ায় লালন একাডেমির মিলনায়তনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় লালন একাডেমি এ স্মরণোৎসবের আয়োজন করেছে।
লালনভক্তদের উদ্দেশে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এই ধারাতে কোনো তথাকথিত চিরন্তন, চিরস্থায়ী, শ্বাশ্বত মতাদর্শে বিশ্বাস করে না। তারা গুরুবাদী। গুরুবাদী মানে তারা শুধু জীবন্ত মানু্ষের ভোজন করে। গুরু আপনাকে যেটা করতে বলেছেন, এটা করবেন। আপনার গুরু আপনাকে যে মন্ত্র দিয়েছেন, সেই মন্ত্রে চলবেন। এটাকে লালনবাদ বানাবেন না।’
এসময় নানান কারণে কুষ্টিয়ায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘লালন আমাদের গঠন করতে চেয়েছিলেন। নতুন ধরনের সমাজ গড়ার কথা বলেছেন। নতুনভাবে রাষ্ট্র বানানোর কথা বলেছেন। সেই রাষ্ট্রে বা সমাজে কোনো পুলিশ লাগে না। এমন একটি সমাজের স্বপ্ন লালন দেখেছেন সেখানে পুলিশ লাগে না। কারণ আপনার মনে যদি পুলিশ থাকে, তাহলে বাইরে পুলিশ লাগবে কেন? তার মানে মনে পুলিশ নেই। আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। আপনি উচ্ছৃঙ্খল।’
Advertisement
জেলা প্রশাসক ও লালন একাডেমির সভাপতি মো. তৌফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে অনু্ষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়া পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান।
অনু্ষ্ঠানে মূখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রশিদুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম।
জানা গেছে, মরমি সাধক লালন শাহ তার জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমার রাতে শিষ্যদের নিয়ে রাতে কালীগঙ্গার ধারে সাধুসংঘে বসতেন। তারই ধারাবাহিকতায় লালন শাহের তিরোধানের পরও প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের শেষদিকে লালনের আখড়াবাড়িতে দোলপূর্ণিমা বা স্মরণোৎসব উদযাপন হয়।
সেই ধারাবাহিকতায় দোলপূর্ণিমা তিথিতে প্রতিবছর ছেঁউড়িয়ায় আখড়াবাড়িতে তিন দিনব্যাপী সাড়ম্বরে উদযাপিত হয় ফকির লালন শাহ স্মরণোৎসব। সাধু-গুরু, লালনভক্তদের সরব উপস্থিতি, গান ও গ্রামীণ মেলায় জমজমাট হয়ে ওঠে আখড়াবাড়ি প্রাঙ্গণ। এবার রমজানের কারণে একদিনই উদযাপিত হয় স্মরণোৎসব। ছিল না সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলা। কেবল আলোচনা অনুষ্ঠান ও বাউলদের আপ্যায়নের মধ্য দিয়েই শুক্রবার (১৪ মার্চ) শেষ হবে আয়োজন। সাধুসঙ্গ চলবে রীতি অনুসারে।
Advertisement
এদিকে এই উৎসব উপলক্ষে কয়েক দিন আগে থেকেই আখড়াবাড়িতে আসতে শুরু করেছেন লালনভক্ত বাউল ফকিররা। কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে লালনের গান। দলে দলে বিভক্ত হয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে গান পরিবেশন করছেন তারা। তবে এবার আখড়াবাড়িতে ভক্তদের উপচেপড়া ভিড় নেই। আখড়াবাড়ির প্রবেশপথের দেওয়াল ঘেরা বিকেলে সরেজমিন এমর দৃশ্য দেখা যায়।
লালনভক্ত রাজ্জাক ফকির বলেন, ‘আয়োজনের দিন কমলেও সাধুসঙ্গের কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। সাধুসঙ্গের জন্য ২৪ ঘণ্টায় অষ্টপ্রহর প্রয়োজন। যা আজ ( বৃহস্পতিবার) সন্ধায় গুরুকার্যের মধ্যদিয়ে শুরু হয়েছে। শুক্রবার ভোরে বাল্যসেবা ও দুপুরে পূর্ণসেবার মাধ্যমে শেষ হবে।’
রমজানের কারণে দর্শনার্থীদের আনাগোনা কম থাকলেও এবার দোল পূর্ণিমাতিথিতে দেখা মিলেছে বিদেশি পর্যটকদের। আখড়াবাড়ির সামনে কথা হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত মারিয়া ভেইল্টের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মতো ফকির লালন শাহের মাজারে এসেছি। সঙ্গে এক বন্ধু ও গাইডম্যান আছে। আসতে পেরে খুব ভালো লাগছে। এদেশে নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই।’
জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান বলেন, প্রতিবছর দোলপূর্ণিমা তিথিতে মরমি সাধক ফকির লালন শাহের তিন দিনব্যাপী স্মরণোৎসব অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও সাড়ম্বরে উদযাপন হয়। তবে এ বছর দোলপূর্ণিমা পবিত্র রমজান মাসে হওয়ায় লালন স্মরণোৎসবে শুধু আলোচনা সভা ও বাউল আপ্যায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। পবিত্র মাহে রমজানের পবিত্রতা ও যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য রক্ষার্থে এ বছর বাউলদের মাগরিবের পরে এবং রাতে সেবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
আল-মামুন সাগর/এসআর/জিকেএস