ফিচার

বাবা নিখোঁজ হলেও সনদের অভাবে হয় না ‘এতিম’

জীবননামা-এক

Advertisement

মারিয়া (১২) ও মো. আব্দুল্লাহ (৯) দুই ভাই-বোন। এই বয়সেই ওদের জীবনচিত্র অমানবিক। একটি শিশুর জীবন যেমন হওয়া উচিত, বাস্তবে তার লেশমাত্র নেই। কারণ বছরখানেক আগে ওদের বাবা মো. আল আমিন নিখোঁজ হন। এরপর শিশু দুটি জেনে গেছে, নিখোঁজ নামক বাস্তবতা কাকে বলে। এই এক বছরে ওরা বুঝে গেছে বাবা নিখোঁজ হলে জীবনের পথ কতটা কঠিন হতে পারে!

বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর এই শিশুদের ঠিকানা হয় ওদের মায়ের মামার বাড়িতে। যেখানে মানুষ থাকা দায়; তেমনই একটা ঘরের বারান্দায় জায়গা হয় মাসহ দুই শিশুর। তবুও মারিয়া থেমে যায়নি। দাখিল মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী সে। আব্দুল্লাহ পড়ে সরকারি প্রাথমিকের দ্বিতীয় শ্রেণিতে। স্কুলের খাতায় এখনো তাদের নাম আছে ঠিকই। তবে কতদিন পড়ালেখা চলবে, তা নিয়ে শঙ্কাও আছে। মারিয়া-আব্দুল্লাহ ভেবেই নিয়েছে, বড় হলে ওদের খেটে খেটে পেট চালাতে হবে। এমন জীবনে কীসের এত পড়ালেখা!

ওদের মা সালমা বেগম (৩৬) এখন পরের ঘরে, ফসলের মাঠে, প্রতিবেশীদের গরুর খামারে কাজ করেন। স্বামীহারা সালমা এসব কাজ নিয়েছেন পেটের দায়ে, সন্তানদের জীবন চালাতে। সালমার হাতে কাজ থাকলেই কেবল ছোট্ট দুই শিশুর মুখে খাবার জোটে। মায়ের হাতে কাজ না থাকলে শিশু দুটোকে অনাহারে কিংবা অর্ধাহারে থাকতে হয়।

Advertisement

জীবননামা-দুই

মো. হিরু মিয়া নিখোঁজ হন সেই ছয় বছর আগে। তিনি রেখে গেছেন তিন সন্তান। বড় ছেলে রাকিব তখন ৮ম শ্রেণিতে পড়তো। বাবা নিখোঁজের সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় তার লেখাপড়া। পরিবারের হাল ধরতে রাকিব বর্তমানে জেলের কাজ করেন।

হিরু মিয়ার মেজ সন্তান ‘রিয়া মনি’। ১৬ বছর বয়সের এই কিশোরী এখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা যখন নিখোঁজ হন, রিয়া তখন চতুর্থ শ্রেণিতে। রিয়ার মাকে জিজ্ঞেস করা হয়, মেয়েকে ঘিরে চিন্তা-ভাবনার কথা। মা বলেন, ‘এসএসসি শেষ হলেই মেয়েকে বিয়ে দেব’। লেখাপড়ার কী করবেন? তিনি বলেন, ‘আর লাগবে না। অনেক হয়েছে। আর পারব না। নিখোঁজ বাবার মেয়েদের ঘরে রেখে আইবুড়ো বানানো যায় না।’

এই নিখোঁজ বাবার সবচেয়ে ছোট সন্তানের নাম আফসানা মিমি। যখন বাবা নিখোঁজ হন; তখন মিমি ৬ মাসের শিশু। এখন ওর বয়স সাত চলছে। স্থানীয় সরকারি প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা যখন শেষ যাত্রায় পা বাড়ান; সেদিন ছোট মেয়েকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে যান। ঘুমন্ত মেয়েটার মুখ দেখেই ঘর থেকে বিদায় নেন বাবা। বাবার স্মৃতি ওর মনে নেই। মিমিকে বাবার ছবি দেখানো হয়। বলা হয়, তিনি একদিন ফিরবেন। বাবা তার জন্য অনেক মজা নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু তিনি আজও ফেরেননি।

Advertisement

জীবননামা-তিন

এমনই আরেক নিখোঁজের নাম হানিফা। বাড়ির প্রবেশপথেই তার ঘর। দরজায় দাঁড়াতেই হানিফার দুই ছেলের সঙ্গে দেখা। তারা আগতদের মুখের দিকে তাকায়। হয়তো তাদের বাবার খবর নিয়ে এসেছে কেউ। ঘর থেকে ছুটে আসেন হানিফার মা। খানিক দূরে ব্যস্ত থাকা হানিফার বাবা, প্রতিবেশী, পথচারী সবার চোখে-মুখে কৌতূহল। কোনো খবর কি এলো এত বছর পর!

নিখোঁজ হানিফার তিন ছেলে। তাদের একজন এখন সাবালক। বাকি দুজনই শিশু। বড় ছেলে ইয়াসিনের বয়স ২২। বাবা নিখোঁজ হওয়ার সময় তার বয়স ছিল ১৬। এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন ইয়াসিন। আর হয়নি। মেজ ছেলে ইসহাকের বয়স ১৬। অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। দ্বিতীয় শ্রেণিতে থাকাকালে বাবার সঙ্গে শেষ দেখা। ছোট ছেলে ইসার বয়স ১০। এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বাবা যখন চলে যান; তখনও স্কুলে যাওয়া শুরু হয়নি ওর।

আজও বাবা হানিফার পথ চেয়ে দাদা-দাদির সঙ্গে ইসহাক ও ইসা। ছবি: খায়রুল বাশার আশিক

হানিফার স্ত্রী আইরিন। বাস্তবতা তাকে সন্তানদের থেকে দূরে ঠেলে দেয়। অন্য এক পুরুষের ঘরে সংসার পাতেন তিনি। পেটের দায়ে আইরিন দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হন। তবে প্রথম ঘরের তিন সন্তানের খোঁজ-খবর রাখেন। মাঝেমধ্যে এসে দেখে যান নারীছেঁড়া তিন রত্নের মুখ। যদিও এমন সাক্ষাতে যে মন ভরে না মা-সন্তান কারোরই। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস—কিছু বলারও নেই, করারও নেই। ইয়াসিন-ইসহাক-ইসা এখন বোঝে—বাবা থাকলে আজ ওরা মাকেও কাছে পেত। তাই তো বারবার ওদের বাবাকে মনে পড়ে। বাবার ওপর ওদের রাগও হয়, কেন নিখোঁজ হতে হলো? কেনইবা এমন দিন দেখতে হলো?

হানিফার আদরের তিন ছেলের আশ্রয় হয় দাদা-দাদির কাছে। অর্থ সংকটে নাতিদের নিয়ে কাটানো বৃদ্ধ দাদা-দাদি ওদের পড়ালেখার ব্যবস্থাটুকুও করতে হিমশিম খাচ্ছেন। এমনকি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-বস্ত্র থেকেও তারা বঞ্চিত। অধিকার-প্রয়োজন-বিনোদন সবকিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে কোনোমতে বেঁচে থাকা যাকে বলে!

জীবননামা-চার

এমন আরেক বাস্তবতা মো. কবির উদ্দিনের ঘরে। কবিরের বড় ছেলে রুম্মানের বয়স এখন ১৭। বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল ১১ বছর বয়সে। তখন সে মাদরাসায় পঞ্চম শ্রেণিতে পড়তো। বাবা নিখোঁজের পর আর লেখাপড়া হয়নি। মেধাবী ছেলেটা এখন সংসারী (কৃষিকাজ) কিংবা রাজমিস্ত্রির হেলপার হিসেবে কাজ করে। কবিরের ছোট ছেলে রবিউল হাসান (১২)। বাবা যখন চলে যান; তখন তার বয়স ছয়। এখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। ওর চোখে-মুখেও বাবার অভাব। এতটুকু ছেলের জীবন নিয়েও চিন্তা করতে হয়। বুঝে-শুনে চলতে হয়। বুঝতে হয়, ওদের বাবা নেই। ওদের কোনো আবদার-চাহিদা-প্রাপ্তি বা স্বাচ্ছন্দ্য থাকতেও নেই।

জীবননামা-পাঁচ

২০১৮ সালের ২১ জুলাই নিখোঁজ হন রিমনের বাবা মো. মাসুম। রিমনের কথা চিন্তা করে দ্বিতীয় বিয়েও করেননি ২৬ বছর বয়সে স্বামীহারা রিনা বেগম। মাসুম-রিনা দম্পতির সেই রিমন এখন ১৬ বছরের কিশোর। দশম শ্রেণির ছাত্র সে। বাবা যখন চলে যান; রিমন তখন চতুর্থ শ্রেণিপড়ুয়া। সেই থেকে আজ অবধি রিমনকে সইতে হচ্ছে নানা ঘাত-প্রতিঘাত। মায়ের পাশাপাশি তাকেও বইতে হচ্ছে কষ্টের ঘানি। বাবা না থাকায় নিরানন্দ আর প্রাপ্তিহীন জীবন কাটাতে হয়েছে ছোটবেলা থেকে। তবুও তার একটু প্রশান্তি—অভাব ও মায়ের অসুস্থতার মধ্যেও লেখাপড়াটা চলেছে। কোনো ভাই-বোন নেই বলেই হয়তো ওকে নিয়ে যুদ্ধে করছেন মা।

আরও পড়ুনপ্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে দিনমজুর জয়নালের পাঠাগার 

তবে মায়ের অবস্থা-খাটুনি দেখলে রিমনের ইচ্ছে হয়, পড়ালেখা ছেড়ে কাজে জড়াতে। তবুও ছেলেটি স্বপ্ন দেখে—সেনাবাহিনী, পুলিশ কিংবা নৌবাহিনীতে চাকরি করার। এই ইচ্ছাশক্তি শেষ অবধি বজায় থাকবে কি না, সেই সংশয়ও আছে। মায়ের দায়িত্ব নিতে হবে, পরিবারের হাল ধরতে হবে, ঋণ পরিশোধ করতে হবে— কত চিন্তা-দুশ্চিন্তা শিশুটির। এমন সময় বাবা পাশে থাকলে হয়তো জীবনটা অন্যরকম হতে পারতো। তবে হয়তো বিধাতা তা চাননি। রিমন বলে, ‘বাবা হারিয়ে যাওয়ার পর অনেকের দান-সহযোগিতায় পড়ালেখা চালিয়েছি। আমাকে পড়াতে মা অনেক কষ্ট করছেন। এসব দেখলে আমারও খুব কষ্ট লাগে। আমি মায়ের জন্য কিছুই করতে পারছি না। শুধু নিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু এভাবে আর কতদিন!’

পাঁচ পরিবারের যে শিশুগুলোর কথা বলা হলো, ওদের সবার বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে। ওদের সবার বাবা ছিলেন ‘সমুদ্রগামী ট্রলারের জেলে’। এসব জেলে বাবারা নিখোঁজ হয়েছেন মাঝসমুদ্রে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট কোনো ঝড়ে ট্রলারডুবি, অতঃপর হারিয়ে যায় এসব শিশুর বাবারা। ওরা ক’জন তো উদাহরণ মাত্র। হামিম, রাসেল, জাহিদ, অলির মতো আরও অনেক শিশুর দেখা মেলে পাথরঘাটায়। যারা প্রত্যেকেই সমুদ্রে ট্রলারডুবির কারণে বাবাহারা হয়েছেন। ট্রলারডুবিতে নিখোঁজের ঘটনাগুলো লন্ডভন্ড করে দেয় অগণিত শিশুর শৈশব। মলিন করে দেয় হাজারো শিশুর রঙিন দিনগুলো।

প্রতিবেদনের শুরুতে যে মারিয়ার কথা বলা হয়, সেই মারিয়ার কাছে বাবা এখন শুধুই স্মৃতি। বাবা যখন শেষ সমুদ্রে যান; তখন মারিয়ার পঞ্চম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। মারিয়ার মনে পড়ে, বাবা সবচেয়ে বেশি বলতেন একটি কথা—‘ভালো করে লেখাপড়া করবি, যা চাস তাই পাবি’। বলেছিলেন, ‘চলমান পরীক্ষায় ফার্স্ট হইতে হবে’। মেয়েটি পঞ্চম শ্রেণিতে ঠিকই প্রথম হয় কিন্তু বাবা আর তা জানলেন না। বাবা সম্পর্কে কথা তুলতেই কান্নাঝরা চোখে মারিয়া বলে, ‘আব্বায় নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিতো। লেখাপড়ার বিষয়ে খুব আগ্রহী ছিল। যখন যা চাইতাম; তা-ই পাইতাম। আব্বার সব কথাই মনে পড়ে। আব্বা নাই, আমার আর কিছু চাওয়ার জায়গা নাই।’

বাবার প্রশ্নে আব্দুল্লাহ নিশ্চুপ, অনুভূতিহীন। কোনো কথাই ওর মুখে এলো না। মিনিটখানেক পর ভিড় ছেড়ে এগিয়ে গেল কয়েক কদম। আব্দুল্লাহর মা জানান—ছেলেটার সামনে কেউ ওর বাবার কথা তুললেই ও দূরে গিয়ে একা একা কাঁদে। বাবা না থাকার কষ্ট কেমন সেটা আব্দুল্লাহ এখন ঢের বোঝে।

নিখোঁজ হানিফা মাঝির মেজ ছেলে ইসহাককে তার বাবার প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই সে অঝোরে কাঁদা শুরু করে। ইসহাক বলে, ‘বাবা চলে যাওয়ার পর মা দ্বিতীয় বিয়ে করে। আব্বায় নাই, মাও নাই…। দাদা-দাদি বৃদ্ধ। দাদা মাছ ধরে, ক্ষেতে-খামারে কাজ করে যা পায়, তাতে কোনোরকম পেট চলে। ঘরের খাবার জোগানো কষ্ট, এর মধ্যে আমরা তিন ভাই দাদা-দাদির কাছে আরেক কষ্টের কারণ। তাই কোনো কাজ পেলে করি।’

অশ্রুঝরা চোখে ইসহাক বলে, ‘বাবায় যেদিন শেষ গেলেন, তখন আমি ঘুমে ছিলাম। মনে পড়ে—আইয়া (ঘরে ফিরেই) বোলান (ডাক) দিতো। আমাগো তিন ভাইকে খোকা কইয়া (বলে) ডাকতেন। হেরে (তাকে) দেখলেই দৌড়াইয়া যাইয়া (দৌড়ে) কোলো উঠতাম। বাবায় থাকলে এত কষ্ট করা লাগতো না। আব্বারে খুব মনে পড়ে। আমাদের কপালে ছিল এমন…।’

জেলে পরিবারের এমন সন্তানদের সঙ্গে কথা হলে বোঝা যায়, তারা কতটা অসহায়! যেন সব শেষ হয়ে গেছে একটি নিখোঁজে। বরগুনার পাথরঘাটা, তালতলি; পটুয়াখালীর রাঙাবালি, গলাচিপা; ভোলার চরফ্যাশন, মনপুরা; নোয়াখালীর হাতিয়া; লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগরসহ জেলেবহুল ১৬টি জেলার নানা এলাকায় এমন পরিবার অগণিত। প্রতি বছরই সমুদ্রে মাছ ধরার ট্রলার নিখোঁজ হচ্ছে। বাড়ছে নিখোঁজ বাবার নিঃস্ব সন্তানের সংখ্যা।

সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ ট্রলার ও জেলেদের বিষয়ে কিছু পরিসংখ্যান মিললেও এসব পরিবারের শিশুদের নিয়ে সরকারি-বেসরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। এসব পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সংশ্লিষ্ট কোনো দপ্তরেই তথ্য মেলেনি। তবে পাথরঘাটার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু জানান, শুধু পাথরঘাটা উপজেলায় ২০০৬ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১৯২ জন জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। এসব পরিবারে গড়ে কমপক্ষে ২-৩ জন জেলে সন্তান রয়েছে। সেই হিসেবে বরগুনার এই একটি উপজেলায়ই কমবেশি ৪০০ সন্তান বাবাহারা হয়েছেন সমুদ্রে ট্রলার নিখোঁজের ঘটনায়।

তবে বরগুনা ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরীর দেওয়া তথ্যমতে, নিখোঁজের প্রকৃত সংখ্যা সরকারি এই হিসেবের চেয়ে কমপক্ষে পাঁচগুণ বেশি। এই সমিতি ও জেলে সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য অনুযায়ী, এর প্রকৃত কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে গত এক দশকের আনুমানিক হিসেবে অন্তত ৫০০ জেলে নিখোঁজ হয়েছেন। আর এসব পরিবারে কম হলেও এক থেকে দেড় হাজার সন্তান রয়েছে, যার মধ্যে কমবেশি হাজারখানেক শিশু এখনো অসহায়-বিপদগ্রস্ত।

উপকূলীয় প্রতিটি জেলা-উপজেলায় এমন নিখোঁজ পরিসংখ্যান যেন জীবন্ত উপাত্তেই মলাটবদ্ধ। এলাকাভেদে নিখোঁজের সংখ্যাটা শুধু ভিন্ন ভিন্ন। দেড়শ, দুইশ, আড়াইশ বা যা-ই হোক, নিছক কতগুলো সংখ্যা নয়, প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে একেকটি জীবনের উপাখ্যান। জনপদগুলোতে এসব পরিবারের গল্পগুলো একই রকম, কষ্টের ধরনটাও এক, শুধু অশ্রুসিক্ত চোখগুলো ভিন্ন।

জেলে জনপদে এমন কষ্ট বয়ে বেড়ানো শিশুদের সংখ্যা হাজার হাজার। ওদের কষ্ট দেখারও কেউ থাকে না। রাষ্ট্রের উদ্যোগও অনুপস্থিত। ছোট্ট বয়সেই ওরা প্রত্যেকেই বুঝে যায় জীবনের বাস্তবতা। ওদের সবার ভাষ্য প্রায় একই। স্বাভাবিক অর্থে ট্রলার নিখোঁজ, জেলে নিখোঁজ সংবাদমাধ্যমের জন্য ছোট খবর। কিন্তু ওই ছোট খবরের আড়ালে পরিবারের অসহায়ত্বের বড় খবরগুলো অন্তরালেই থেকে যায়। অন্তরালেই কষ্ট বয়ে বেড়ায় শিশুগুলো।

শিশু হলেও শিশু অধিকার সম্পর্কে জানে না তারা। জানার প্রয়োজনও পড়ে না। অধিকারে ওদের হয়তো কোনো আবদারও নেই। ওদের জন্মই যেন কষ্ট বয়ে বেড়াতে। শিশু অধিকার পরের কথা, পরনের কাপড়, চিকিৎসার মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলোর দেখা নেই ওদের জীবনে। এমনকি পর্যাপ্ত সুষম খাবারও পায় না নিখোঁজ জেলের সন্তানরা। এই শিশুদের চেহারা-শরীরে পুষ্টিহীনতার ছাপ স্পষ্ট। খাদ্য চাহিদা পূরণ না হওয়া, অস্বাস্থ্যকর বসবাস ও পয়ঃনিষ্কাশন শূন্যতা, চিকিৎসাহীন জীবনব্যবস্থা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচরণসহ আরও নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি এসব শিশু। অথচ শিশু আইন-২০১৩, জাতীয় শিশু নীতিমালা-২০১১, জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা-২০১০ এবং শিশু অধিকারসংক্রান্ত অন্য বিধিমালা অনুযায়ী ওদের সুরক্ষার দায়িত্বভার সরকারের। তবে বাস্তবে এসব আইন ও নীতিমালা কাগজে-কলমেই আবদ্ধ।

কীভাবে পড়ালেখা করবে ওরা! ওদের লেখাপড়া চলে নামমাত্র। পড়ালেখায় ওরা পারিবারিক কোনো সাহায্য-উৎসাহ পায় না। ফলে এই শিশুদের ঝরে পড়ার হারও বেশি। এ ছাড়াও বাবা না থাকায় অনেক শিশুর জীবনব্যবস্থা শাসন-বারণহীন হয়ে ওঠে। বাধাহীন চলাফেরার কারণে আস্তে আস্তে তারা পড়ালেখা থেকে মনোযোগ হারায়। শিশুগুলো পরিবারের সান্নিধ্য হারিয়ে একাকিত্বে ভোগে। শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দেয় লেখাপড়া। তথ্য অনুসন্ধান বলছে, এমনসব পরিবারের শিশু প্রাথমিক স্তরে কোনোমতে লেখাপড়া করলেও মাধ্যমিক স্তরে ভর্তির আগেই ঝরে যায়। আবার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঝরে যায় মাধ্যমিক স্তরে অধ্যয়নকালে। ফলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অনেকেই পদার্পণ করতে পারে না।

বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নাগরিক অধিকারের কার্যনির্বাহী সদস্য অ্যাডভোকেট সায়মুল ইসলাম রাব্বি বলেন, ‘ওদের জীবনযুদ্ধ সমাজের অন্য শিশুদের মতো নয়। মায়ের স্নেহ, বাবার আদর ওদের জোটে না। ফলে ওরা স্বাভাবিক জীবনযাপন ও সামাজিক মেলামেশা থেকেও বঞ্চিত হয়। ফলে তারা অপরাধ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। সহজে কাউকে বিশ্বাস করতে চায় না। ধ্বংসাত্মক কাজে আগ্রহী ও নেতিবাচক আচরণে তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ওপর যে কোনো নেশায় তারা আসক্ত হয়ে ওঠে। অর্থাভাব তাদের চুরি-ছিনতাইয়ের পথে নিয়ে যায়। শেষ পরিণতি, এসব শিশু শিক্ষার গণ্ডি থেকে ছিটকে পড়ে।’

নিখোঁজ হিরু মিয়ার স্ত্রী সারমিন ও মেয়ে আফসানা মিমি। ছবি: খায়রুল বাশার আশিক

শিশুকালেই বাবাহীন পরিবারের শিশুরা শরীরের পাশাপাশি মানসিকভাবেও শক্তি হারায়। ওদের মনে জাগে ভয়-সংশয়। শিশু বিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, পিতামাতা না থাকা অথবা যত্নশীল মানুষের অভাবে শিশুদের শারীরিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানসিক বিপর্যয়েও সমান প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া অভিভাবকহীন সন্তানদের মনস্তাত্ত্বিক দুর্বলতা সৃষ্টি হয়। এই শিশুদের সামাজিক অবহেলা-দুর্ব্যবহার মেনে নিতে হয়। অনেকের মনেই মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে সমাজ-সভ্যতার প্রতি তাদের বিরূপ ধারণা জন্মায়। সমাজের প্রতি মমত্ববোধ না থাকলে সেসব শিশুকে দিয়ে নানা অপকর্মও সংগঠিত হতে পারে। এ ছাড়া অভাবের কারণে কোনো কিছু চেয়ে না পাওয়া, বিনোদন প্রাপ্তির সুযোগ না থাকা ও একাকিত্ববোধ একেকটি শিশুকে সমাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়। এমন শিশুদের নানা বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করতেও দেখা যায়।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রেজওয়ানা করিম স্নিগ্ধা বলেন, ‘একটি পরিবার থেকে কেউ নিখোঁজ হলে এর প্রভাব পুরো পরিবারের ওপরই পড়ে। সাধারণত কেউ মারা গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। কিন্তু কেউ যদি নিখোঁজ হন, তাহলে পরিবারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন। মনস্তাত্ত্বিকভাবে শিশুরা এর মাধ্যমে এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। আবার ছেলে ও মেয়েদের ক্ষেত্রে এই মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব আলাদা। এমনকি বাবা নিখোঁজ হওয়ার পর যদি কোনো মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়, আমাদের সমাজে সেই শিশুটিকে হেয় করার প্রচলন রয়েছে। এর মাধ্যমে মেয়ে শিশুটি এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগে। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ ধরনের শিশুরা বিচ্ছিন্নতাবোধ, নিরাপত্তাহীনতা, সংকোচবোধ, কে তাকে শেখাবে, অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তা, অভিভাবকত্বহীনতায় ভোগে। ফলে তারা অধিকাংশ সময় বিষণ্নতার মধ্যে অবস্থান করে। এসব শিশুর মধ্যে এক ধরনের আত্মবিশ্বাসহীনতার জন্ম নেয়, যা তার সমগ্র জীবনবোধে প্রভাব ফেলে।’

আরও পড়ুনরঙের ক্যানভাসে জিয়াউরের স্বপ্নের সংগ্রাম 

সরেজমিন অনুসন্ধান ও শিশুদের নিয়ে কাজ করা একাধিক ব্যক্তি-সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাবা নিখোঁজ হলেই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ে কন্যাশিশুরা। মেয়েদের নিয়ে বিপাকে পড়েন মায়েরা। অনেকটা বাধ্য হয়ে এমন পরিবারের মায়েরা গৃহকর্মীর কাজ করেন, ছোটখাটো ব্যবসায় জড়ান, কেউ কেউ দিনমজুরির কাজও করেন। আর অবহেলার অন্ধকারে বেড়ে ওঠে ঘরের মেয়েটি। হিরু মিয়ার সেই দশম শ্রেণিপড়ুয়া মেয়ে রিয়া মনির মতোই ওদের প্রস্তুত করা হয় বিয়ের জন্য। মেয়েকে বিয়ে দিতে পারলেই যেন চিন্তামুক্ত হয় পরিবারগুলো। শেষমেশ বাল্যবিয়ের করুণ পরিণতি বয়ে বেড়াতে হয় শিশুগুলোর। এ ছাড়া বাবা নিখোঁজ হলে বেশিরভাগ মেয়ের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। অনেকেরই মেধা ও ইচ্ছাশক্তিকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। জড়াতে হয় নানা কাজে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হলে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ওয়ারকার ফোরামের (এসডিওএফ) নারী উন্নয়ন সমন্বয়কারী নূরে রোকসানা সুমি বলেন, ‘বাবার প্রত্যাশায় থাকা শিশুগুলোর মৌলিক চাহিদা কখনোই পূরণ হয় না। পরিবারে প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি না থাকায় অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে কন্যাশিশুরা চাহিদা পূরণে নানাজনের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়। এতে সমাজের কিছু অসাধু মানুষের লালসার শিকারও হতে হয় তাদের। অন্যদিকে বাবা না থাকার অভিজ্ঞতা কোমল বয়সী শিশুদের যেন বয়স বাড়িয়ে তোলে। প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই কিশোরী বয়সেই নিজেকে ধরে রাখা শিখে যায়। জীবনে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হওয়ার কারণে তাদের মনোজগৎ থেকে শিশুকাল হারিয়ে যায়। শিশুকালকে উপভোগের বদলে ওরা দ্রুতই মানসিকভাবে প্রাপ্তবয়স্কে পরিণত হয়। এক কথায় শিশু বয়সেই এই কন্যাশিশুরা হয়ে ওঠে ‘নারী’।’

এমন পরিবারের মেয়ে শিশুদের স্বাস্থ্যগত বিষয়ে জানতে চাইলে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের অভিজ্ঞতার বরাতে তিনি বলেন, ‘পারিবারিক অভাব থাকলে মেয়েরা শারীরিক রোগের বিষয়গুলো উপস্থাপন করতে পারে না। এসব পরিবারের মেয়ে শিশুরা ঋতুস্রাবজনিত সৃষ্ট রোগঝুঁকিতে পড়ে। ন্যাপকিন, টিস্যুপ্যাড দূরের কথা, ঋতুস্রাব চলাকালে ওরা কারো সাহায্য-সহায়তাও নিতে পারে না। পিরিয়ডের সময়ে অসতর্কভাবে চলাচল ও কাজকর্মের ফলে নানারকম রোগ হয় তাদের। ব্যাকটেরিয়া থেকে ত্বকে ফুসকুড়ি ও টিএসএস (টক্সিক শক সিনড্রোম) ছড়ায়। অনেকের প্রস্রাবে ইনফেকশন, প্রস্রাবের রাস্তার চুলকানি হয়। এসব শিশু এ ধরনের রোগ শরীরে নিয়েই মরে যায়। ওরা এসব রোগের খবরও জানে না, রোগে ধরলে বোঝেও না। আবার বুঝলেও তা নিয়ে চিন্তিত হয় না।’

সমুদ্র থেকে ফিরে আসা মাছ ধরার ট্রলার। ছবি: খায়রুল বাশার আশিক

এমন গল্পের ভিড়ে চাপা পড়ে যায় আরেকটি গল্প। সেটি মৃতদের বেঁচে থাকার গল্প। প্রাণ হারিয়েও তারা কাগুজে নিখোঁজ। মৃতদের মৃত্যু হলেও তবু কিছু অনুদান পেয়ে কিছুদিন পেট চলতো। কিন্তু তারা নিখোঁজ। ‘স্বামীর নাম মুখে আনতে নেই’ প্রবাদের মতো তাদেরও মৃত হিসেবে মানতে মানা। অনুদান-সহায়তা পেতে হলে আগে তাদের মরতে হবে! লাশ খুঁজে পেতে হবে।

অবশেষে নিখোঁজরা নিখোঁজ থেকে আর মৃত্যুর তালিকায় আসেন না। মরেও তারা মরেন না। ফলে নিখোঁজ বাবার কোনো সন্তান চাইলেও ভর্তি হতে পারে না সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পরিচালিত শিশু পরিবার বা এতিমখানাগুলোয়। কারণ ওদের বাবাদের মৃত্যু সনদ থাকে না। ওরা এমনই অভাগা, বাবার মৃত্যু সনদ না থাকায় ওরা এতিম হিসেবেও সুবিধা নিতে পারে না।

এ বিষয়ে বরগুনা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক সহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির ডেথ সার্টিফিকেট থাকলেই কেবল তার সন্তান এতিম হিসেবে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সুবিধাদি পেয়ে থাকে, বিষয়টা সত্য। কিন্তু নিখোঁজ ব্যক্তির সন্তানরা এই সুবিধা পায় না। আসলে এটি সরকারের নীতিনির্ধারণী বিষয়। সরকারের নীতিমালায় নিখোঁজের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নেই। একটি ডেথ সার্টিফিকেট নেই বলে একটি এতিম হয়েও এতিমের সুবিধাদি তারা পায় না। এটি এক ধরনের বৈষম্য। সরকারের উচিত এই বৈষম্য নিরসনে উদ্যোগ নেওয়া। এরই মধ্যে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মিটিংয়ে একাধিকবার উত্থাপন করা হয়েছে।’

সার্বিক বিষয়ে কথা হলে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও শিশু বিষয়ক গবেষক ড. মু. ইব্রাহীম খলিল বলেন, ‘জেলে পরিবারের শিশুদের নিরাপদ জীবন চাইলে আগে নিরাপদ করতে হবে জেলে জনগোষ্ঠীকে। মাছ ধরে বাবা নিরাপদে ফিরতে পারলেই কেবল শিশুগুলোর জীবন নিরাপদ থাকবে। এককথায় সমুদ্রে নিরাপদ মৎস্য আহরণ নিশ্চিত হলেই কেবল নিরাপদ হয়ে উঠবে জেলে পরিবারের শিশুরা। তাই জেলেদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি বহন করতে হবে। মাছ ধরার জন্য সমুদ্র কখন নিরাপদ হবে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের সঙ্গে জেলেদের যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। তারপরও সমুদ্র উত্তাল হতে পারে এবং যে কোনো সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। উত্তাল সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার কারণটা যেহেতু অর্থনৈতিক, সে কারণে সমুদ্র উত্তাল থাকাকালে জেলেদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান কিংবা সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘নিখোঁজ জেলে পরিবারের শিশুসন্তানদের বিশেষ প্রকল্পের আওতায় এনে শিক্ষাদান, আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। এসব পরিবারের শিশু ও তাদের নিকটাত্মীয়দের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে কাউন্সিলিং করতে হবে। এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা ও সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তর, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসতে পারে।’

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রেজাউল করিম বলেন, ‘একটি শিশু বেড়ে উঠতে প্যারেন্টিং (সন্তানকে লালন-পালনের পদ্ধতি) প্রয়োজন। বাবা যদি নিখোঁজ হন, এই প্যারেন্টিংয়ে বাবার যে ভূমিকা, সেটির অনুপস্থিতিতেই সন্তান বেড়ে ওঠে। এ ছাড়া বাবাহীন একটি শিশু যখন অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে বাবাদের দেখবে; তখন তার মধ্যে মানসিকভাবে নেতিবাচক চেতনা সৃষ্টি হয়, যা তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করতে পারে।’

আরও পড়ুননকল চাবি তৈরি করে মাসে আয় ৬০ হাজার টাকা

এই শিক্ষক যোগ করেন, ‘বাবাহীন শিশুটির পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বেড়ে ওঠা (অ্যাটাচমেন্ট ডেভেলপমেন্ট), মানসিকভাবে সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেড়ে ওঠা (ইমোশনাল ডেভেলপমেন্ট) ও বন্ধুভাবাপন্ন অবস্থা (ফ্রেন্ডশিপ ডেভেলপমেন্ট) ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এমনকি পড়াশোনায়ও তারা পিছিয়ে পড়তে পারে। কেননা সব সময় না পাওয়ার কষ্ট তার মধ্যে কাজ করে। যে কোনো সময় তারা বিষণ্ন হয়ে যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি শিশুর বেড়ে ওঠার পেছনে বাবা-মা সমানভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। এমন শিশুদের মা যদি স্বাবলম্বী হয়েও থাকে, তবুও বাবার বিকল্প কেউ হয় না। এই অভাব পূরণ হওয়ার নয়। সে ক্ষেত্রে মা, মামা-চাচারা সেই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে শিশুটিকে সহায়তা করতে পারে, যেন শিশুটি বেড়ে উঠতে গিয়ে কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

সমস্যা সমাধানের নানা আলোচনার পরও একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। এমন সমস্যার স্থায়ী সমাধান কোথায়? পারিবারিক প্রয়োজন বা জীবিকার তাগিদে সব ধরনের ঝুঁকিকে তুচ্ছজ্ঞান করে জেলে বাবারা সমুদ্রে ছুটে যান। অথচ এখনো যখন-তখন সমুদ্রের প্রকৃতি রুষ্ট হওয়া কিন্তু থামছে না। সমুদ্রের সেই আগ্রাসী আচরণে-ঝড়ে জেলেদের প্রাণ হারানোর তালিকায় নতুন নতুন নাম যোগ হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দিন দিন এ সমস্যা বেড়েই চলেছে। শেষমেশ বিধাতার বিধান ভেবে অবজ্ঞা-অবহেলার জীবন মেনে নেয় এসব পরিবারের শিশুরা। তাদের দায়িত্ব নেবে কে? কোনো সংগঠন, সমাজ, রাষ্ট্র নাকি বিধাতা? তবে সহজেই অনুমেয়, বঞ্চিত শৈশবের চোরাবালিতে তলিয়ে যাওয়া জীবনগুলো রক্ষায় এখনই প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সমন্বিত একটি শিশু পুনর্বাসন প্ল্যাটফর্ম গঠন এখন সময়ের দাবি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যতদিন সমুদ্রগামী ট্রলারের জেলেদের সুরক্ষিত করা না যাবে; ততদিনে এসব পরিবারের অসহায়ত্ব কমানোর সুযোগ নেই। নতুন করে কোনো জেলে যেন নিখোঁজ না হয়, তার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে বাবাহারা শিশুদের নিয়ে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে এসব পরিবারকে খুঁজে খুঁজে সামাজিক সুরক্ষার (সোশ্যাল সেফটিনেশন) আওতায় আনতে হবে। বিশেষ করে পরিবারের শিশুদের সুরক্ষা অবশ্যই দিতে হবে।

এসইউ/এএসএম