চাঁদা না পেয়ে তানযীমুল উম্মাহ মাদরাসা মিরপুর শাখার চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী জমজমকে বেধড়ক মারধরের অভিযোগ উঠেছে একই মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির তিন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ওই মাদরাসার প্রিন্সিপাল আলাউদ্দিন ও ভাইস প্রিন্সিপাল ফুরকান জড়িত বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর ভাই কাইফ ইসলাম মিতুল।
Advertisement
গত ৪ মার্চ তানযীমুল উম্মাহ মাদরাসার পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী কাননের কাছ থেকে চার হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে একই মাদরাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়ামিন খান শাহি, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও আহমদ সিয়াম। অভিযুক্তদের হাত থেকে বাঁচাতে কানন তার চতুর্থ শ্রেণির বন্ধু জমজমের কাছে ওই টাকা রেখে দেয়। পরে জমজমের কাছে রাখা টাকা অভিযুক্তরা নেওয়ার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে তাকে বেধড়ক মারধর করা হয়।
এ ঘটনায় শনিবার (৮ মার্চ) রূপনগর থানায় মামলা করার পর জানা যায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী, মাদরাসার প্রিন্সিপাল ও ভাইস প্রিন্সিপাল গাঢাকা দিয়েছেন বলে থানা সূত্রে জানা গেছে।
ভুক্তভোগী জমজমের ভাই কাইফ ইসলাম মিতুল জাগো নিউজকে বলেন, আমার ভাই জমজম চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। তার বন্ধু কানন পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। কানন কোথা থেকে যেন চার হাজার টাকা নিয়ে এসেছে। এই চার হাজার টাকা থেকে সে এক হাজার টাকা খরচ করেছে। আর আমার ভাই জমজমের কাছে দিয়েছে দুই হাজার টাকা। আরেকজনকে এক হাজার টাকা ধার দিয়েছে।
Advertisement
কাইফ ইসলাম আরও বলেন, যারা আমার ভাইকে নির্যাতন করেছে, তারা (ইয়ামিন খান শাহি, আব্দুল্লাহ আল মামুন, আহমদ সিয়াম) যে কোনোভাবে জানতে পেরেছে যে কাননের কাছে টাকা আছে। পরে ওর কাছে গিয়ে টাকা (চাঁদা) চায়। কিন্তু কানন জমজমের কাছে টাকা দিয়েছে, কারণ সে জানে তার কাছে থাকলে সেই টাকা ওরা (অষ্টম শ্রেণির তিন ছাত্র) নিয়ে নেবে। এই কারণে জমজমের কাছে টাকাগুলো রাখতে দিয়েছে কানন। আর জমজমকে বলতে বলেছে যে, টাকাগুলো হারিয়ে গেছে।
তিনি বলেন, এরপর অভিযুক্তরা জমজম ও কানন এই দুইজনকে একে অন্যকে মারার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। একজনকে দিয়ে অন্যজনকে জোরপূর্বক আঘাত করানোর পর তারা নিজেরাও পরে স্টিলের স্কেল ও প্লাস্টিকের ঝাড়ু দিয়ে জমজমকে প্রায় দেড় ঘণ্টা মেরেছে। পাঞ্জাবি খুলেও তারা জমজমকে মেরেছে। জমজমকে সেহরি পর্যন্ত করতে দেয়নি। একজন হুজুর এসেও এই বিষয়ে কোনো খোঁজখবর নেননি।
‘পরে বুধবার (৫ মার্চ) কানন যে কোনোভাবে হুজুরকে এই বিষয়টা জানায়। আমার ভাই হুজুরকে যা সত্য তাই বলেছে। হুজুর জমজমকে ক্লাসে পাঠিয়ে দেয়। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রিন্সিপাল স্যার (আলাউদ্দিন) ও ভাইস প্রিন্সিপাল (ফুরকান) জমজমকে ডেকে ৫ টাকা দামের একটা বিস্কুট আর পানি দিয়ে বলেছে, এবার তুই রোজা ভাঙবি। তা না হলে আরও মাইর খাবি। চাপ দিয়ে রোজা ভাঙানোর পর একটা অ্যান্টিবায়োটিক আর নাপা খাইয়ে ক্লাসে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের একবারও কেউ এই ঘটনার বিষয়ে জানাননি।’
জমজমের ভাই অভিযোগ করে বলেন, ‘আঘাতের কারণে জমজমের শরীরে দাগ থাকায় পরিবারের সদস্যদের না জানানোর জন্য তাকে ভয় দেখান প্রিন্সিপাল। তবে শুক্রবার তাওহীদ নামে একই মাদরাসার পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী আমাকে ফোন দিয়ে পুরো বিষয়টি জানায়। জমজম একটা কাগজে লিখে ওকে দিয়ে আমাকে সব জানাতে বলেছিল। এটা জমজম একটা কাগজে লিখে ওকে দিয়ে আমাকে সব জানাতে বলেছে। পরে সে ভয়ে ভয়ে জমজমের বিষয়ে আমাকে সব বলে। আমাকে পরের দিন ১২টার দিকে যেতে বলে। কিন্তু আমি আমার দুই বন্ধুকে নিয়ে ওই রাতেই চলে গেছি। এরপর আমি ওর খারাপ অবস্থা দেখে ওর কাছে জিজ্ঞেস করি, তোমাকে কে মেরেছে? যারা মেরেছে তাদের খুঁজেছি, কিন্তু কাউকে পাইনি। হুজুর এটা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আগেই ওদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। আমি আমার ভাইকে জিজ্ঞেস করি সে আমাকে বিষয়টি জানায়নি কেন। সে বলে হুজুর তাকে জানাতে নিষেধ করছে, বলতে দেয়নি। এরপর আমি রাগে হুজুরকে একটা ঘুষি দিয়েছি। এখন হুজুর এটা নিয়ে আমার নামে মিথ্যা প্রচার করছে। বিভিন্ন অপবাদ দিচ্ছে,ষড়যন্ত্র করছে, মামলা করার হুমকি দিচ্ছে।’
Advertisement
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর ভাই বলেন, পরে আমি মামলা করব বলে হুমকি দেওয়ার পর মাদরাসার একজন হুজুর আমাকে বললেন, আজকে মামলা কইরেন না, আমরা একটু সামাজিকভাবে বসি। আমিও ভাবলাম তাহলে আমরা সামাজিকভাবে বসেই সমাধান করি। আমি আর মামলা না করে ভাইকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। পরদিন শুক্রবার (৭ মার্চ) আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজনকে নিয়ে সবাই মিলে বসলাম। কিন্তু মাদরাসা কর্তৃপক্ষ বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।
এরপর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন মিরপুর জোনের তানযীমুল উম্মাহ মাদরাসার চেয়ারম্যান সায়েম হুজুরকে লাউডস্পিকারে ফোন দেন। তখন তিনি বলেন, ‘এখন আমার আসা সম্ভব না। কয়েকদিন পরে এই জিনিসটা আমরা দেখব।’ মানে কালক্ষেপণের চেষ্টা করা হচ্ছে। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন তাকে বলেন, ‘তাহলে আপনি যতদিন না আসবেন ততদিন মাদরাসা বন্ধ থাকলো।’ তখন হুজুর বলেন, ‘আমাদের ১০৫টা ব্রাঞ্চের যদি একটা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তেমন কিছু যায় আসবে না। আপনারা যা পারেন করেন।’ এই বলে ফোন কেটে দিয়েছে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে তানযীমুল উম্মাহ মাদ্রাসা মিরপুর শাখার প্রিন্সিপাল আলাউদ্দিনকে ফোন দিলেও রিসিভ করেননি তিনি।
রূপনগর থানার পরিদর্শক (অপারেশন) মো. জুয়েল রানা জাগো নিউজকে বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামিদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। যারা জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, অভিযুক্ত ছেলেদের মাদরাসা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা পালিয়ে আছে। এই কারণে এখনও তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে যেখানেই থাকুক ধরে ফেলব।
প্রিন্সিপাল আলাউদ্দিন ও ভাইস প্রিন্সিপাল ফুরকানের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে ওসি বলেন, কাল তাদের খোঁজে মাদরাসায় গিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের পাইনি। তারাও পালিয়ে আছেন।
বিবৃতিতে যা বললো মাদরাসা কর্তৃপক্ষঅভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গত ৪ মার্চ দুপুর ৩টায় হোস্টেলের পাঁচতলায় জমজমের সঙ্গে কানন নামে আরেকটি ছেলের টাকা নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে জমজম ও তার পক্ষ নেওয়া আরও তিনজন ছাত্রের সহায়তায় কাননকে প্রায় দুই দফায় ২০-৩০ মিনিট মুখে ও চোখে কিল ঘুষি দেয়। এসময় নিচতলায় ছাত্রদের সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা চলছিল, যেখানে ব্লক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। ফলে ওনার জানার কোনো সুযোগ হয়নি। রাত ৯টায় কানন তারাবির সময় ডেকে নিয়ে অন্য আরও দুই ছাত্রের সহায়তায় জমজমকে প্লাস্টিকের ঝাড়ু দিয়ে মারপিট করে। পরদিন সকাল ১২টায় মাদরাসা কর্তৃপক্ষ জানতে পেরে তাৎক্ষণিক ফাস্ট এইডের ব্যবস্থা করে এবং বিষয়টি নিয়ে জমজম ও কাননের সঙ্গে কথা বললে তারা বোঝায় এটা মিউচুয়াল মারামারি। দুই পক্ষ তখন সঠিক তথ্য দিতে গড়িমসি করে। ফলে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে। ওনারা বিষয়টি অভিভাবককে জানাননি। রাতে জমজমের ভাই ও তার বাহিনী এসে মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপাল, শিক্ষক ও দুইজন স্টাফকে বেধড়ক মারধর করে। এ অবস্থায় থানার হস্তক্ষেপে পরদিন স্থানীয় মুরুব্বিসহ এই ঘটনার মীমাংসা হয়।
বিবৃতিতে কর্তৃপক্ষ দাবি করে, দায়িত্বে অবহেলায় মাদরাসার ভাইস প্রিন্সিপালকে অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং চারজন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। বৈঠকের সব সিদ্ধান্ত জমজমের পরিবারের মতানুসারে হওয়ায় তারা পরবর্তীতে আর কোনো উৎপাত করবে না বলে সিদ্ধান্ত দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। কিন্তু রাতের বেলা জানা যায়, ঐ ছাত্রের বড় ভাই ফাউন্ডেশনকে বিতর্কিত করতে ও ঘটনাকে বড় করতে পরিকল্পিতভাবে সত্যের সঙ্গে শিক্ষকদের নিয়ে অনেকগুলো মিথ্যা তথ্য দিয়ে মিডিয়াতে ছড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি শুক্রবার আবারও এলাকার গুন্ডা বাহিনী নিয়ে এসে প্রিন্সিপালের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যায়।
কর্তৃপক্ষ জানায়, শুধু ভুল বুঝে অবহেলা করায় ভাইস প্রিন্সিপালকে মেরে আহত করা হয়েছে। বর্তমানে ওনার কান, নাক ও মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা ও উপসর্গ দেখা দিয়েছে। ডাক্তার মাথায় এক্স-রে করতে দিয়েছে।
ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনও তাদের কাছে রয়েছে বলে জানিয়েছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
এই ঘটনার বর্ণনা মিডিয়া ও পুলিশকে দেওয়ার মাধ্যমে জমজমের পরিবার কাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে কিংবা শিক্ষকদের হেনস্তা ও মারধর করা কোনো সভ্য কাজ কি না এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে মাদরাসা কর্তৃপক্ষ।
কেআর/এএমএ/এমএমএআর/জেআইএম