কান চলচ্চিত্র উৎসবের সর্বশেষ আসরে সর্বোচ্চ পুরস্কার পাম দর পেয়েছিল ‘আনোরা’। এ বছর পেয়ে গেল অস্কার। সেও গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ পাঁচটি শাখায়। একাধারে অস্কারে সিনেমা, পরিচালক, অভিনেত্রী, চিত্রনাট্য ও সম্পাদনায় সেরার পুরস্কার পেল ছবিটি। শুধু কি তাই? কানের একই আসরে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছিল ‘এমিলিয়া পেরেজ’ ছবিটি। সেটিও অস্কারে জিতে নেয় দুটি পুরস্কার। তবে কি কান চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে উঠছে অস্কারের আয়না?
Advertisement
অস্কার স্মারক হাতে মাইকি ম্যাডিসন। ছবি: ইনস্টাগ্রাম থেকে
প্রায় প্রতি বছরই দেখা যাচ্ছে কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত ছবিগুলো অস্কারের বিচারকদেরও মন জয় করে নিচ্ছে। গত বছর কানে প্রশংসা কুড়ানো ৮ সিনেমা ৯৭তম অস্কারে ৩১টি মনোনয়ন পেয়েছিল ১৭টি শাখায়। অস্কার জিতে নিয়েছে তার কয়েকটি। অনেক সিনেমা বোদ্ধা বিষয়টিকে সাধারণীকরণ করে ফেলেছেন। তারা মনে করেন, একটি উৎসবে সেরা সিনেমাগুলোই জমা দেওয়া হয়। জুরিরা সেরা সিনেমাগুলোকেই বেছে নেন। আর কান উৎসবটির পরে অস্কারের আসর বসে বলে মনে হতে পারে, কানের আয়নায় সেরা সিনেমাগুলো দেখে নিচ্ছেন অস্কারের জুরিরা।
তবে আরেকটি পক্ষ মনে করেন, কান চলচ্চিত্র উৎসব তাদের জুরি বাছাইয়ে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেন। তাদের চেষ্টা থাকে সেরা জুরি দিয়ে ছবি যাচাই-বাছাই করার। আর সেই চেষ্টাকে গুরুত্ব দেন অস্কারের বিচারকেরা। অন্য একটি পক্ষ মনে করেন, পুরস্কারের এই ব্যাপারগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে চলচ্চিত্রের সূক্ষ্ম রাজনীতি। বৈশ্বিক অনেক ঘটনার প্রতিবাদ রাজনৈতিকভাবে করা সম্ভব হয় না। সেগুলো শৈল্পিক প্রতিবাদের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে চলচ্চিত্র ও এর উৎসব। তাই কান চলচ্চিত্র উৎসব গুরুত্বপূর্ণ, অনেক ক্ষেত্রে অস্কারের চেয়ে বেশি।
Advertisement
মেয়েটার বাড়ি ব্রুকলিনে। পেশায় একজন যৌনকর্মী। এক ধনীর দুলালের সঙ্গে পরিচয়, প্রেম, তারপর বিয়ে হয় তার। নিউইয়র্কে তারা সংসার শুরু করে। সে খবর চলে যায় রাশিয়ায়, ছেলের পরিবারের কাছে। ছেলের মা-বাবা বিয়েটা মেনে নিতে পারেন না। ছেলেকে ওই ‘দুষ্টু’ মেয়ের কাছ থেকে কেড়ে নিতে তারা রওনা হন নিউইয়র্কের দিকে। এটা হচ্ছে ‘আনোরা’ নামের সিনেমাটার কাহিনি, বানিয়েছেন মার্কিন চলচ্চিত্রকার শন বেকার। কান ফিল্ম ফ্যাস্টিভ্যাল থেকে গত বছর ছবিটি জিতে নিয়েছে সেরা সিনেমার পুরস্কার। এ বছর জিতলো অস্কার। ‘আনোরা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মাইকি ম্যাডিসন নামের অখ্যাত এক তরুণী।
আনোরা টিমের একাংশ। ছবি: এএফপি
সিনেমার গল্পে একজন যৌনকর্মীকে পুত্রবধু হিসেবে মেনে নিতে পারেননি আনোরার শ্বশুর-শাশুড়ি। কিন্তু কান চলচ্চিত্র উৎসব এ গল্পকে মেনে নিয়েছে। পুরস্কৃতও করেছে। কান চলচ্চিত্র উৎসব থেকে প্রতি বছর এভাবে একটি প্রতীকি বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় সারা পৃথিবীতে। বার্তাটি কীসের? বিপরীতকে, বিরোধীকে, ভিন্নতাকে, ব্যতিক্রমকে, নতুনকে মেনে নেওয়ার, সাদরে গ্রহণ করার, স্বাগত জানানোর। সেই বার্তা কি পৌঁছায় পৃথিবীর কাছে?
উন্নতির শিখরে পৌঁছে যাওয়া, ছোট হয়ে আসা পৃথিবীতে আজও সাদা-কালোর দ্বন্দ্ব রয়েছে। সামান্য কালো হলে আজও ইউরোপের কোনো কোনো দেশে অবহেলার শিকার হতে হয় মানুষকে। অনেক দেশেই ইহুদি বা খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারীরা অন্য ধর্ম বা সম্প্রদায়ের মানুষের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পান। পৃথিবীর খুব কম দেশেই সমপ্রেমী মানুষকে স্বাভাবিক মানুষ বলে মেনে নেওয়া হয়। পৃথিবীতে খুব কম দেশেই রূপান্তরকামীদের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। স্বাধীনতার নামে পরাধীন দেশ আজও পৃথিবীতে রয়েছে, গণতন্ত্রের নামে ছদ্ম স্বৈরতন্ত্র আজ পৃথিবীতে জেঁকে বসছে। কট্টোর ধর্মীয় গোড়া শাসকের সীমানা থেকে পালিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়, পালাতে চেয়ে পালাতে না পারা মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। ক্রয় ক্ষমতায় পিছিয়ে পড়া মানুষেরা যেন পৃথিবীর সবখানে অনাকাঙ্ক্ষিত, অপ্রয়োজনীয়, অপ্রত্যাশিত! এই সব বৈসাদৃশ্যকে গ্রহণ করে নিয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজনকারী দেশ ফ্রান্স। দেশটিকে বলা হয় পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্যের রাজধানী। দুহাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেওয়ার জন্য তারা অপেক্ষা করে আছে। সেই চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার একটা সুবৃহৎ ক্যানভাস কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল।
Advertisement
কান চলচ্চিত্র উৎসবে গত বছর পুরস্কার দেওয়া হয়েছে একঝাঁক ব্যতিক্রমকে। ধরা যাক, সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন যে চার জন, তাদের অন্যতম কার্লা সোফিয়া গ্যাসকন একজন রূপান্তরিত নারী। তার অভিনীত সিনেমা ‘এমিলিয়া পেরেজ’। দীর্ঘ দিনের চেপে রাখা কান্না ভূমধ্যসাগরের তীরে কান সৈকতে গিয়ে কেঁদেছেন তিনি। রূপান্তরকামী হিসেবে নিজের দেশ মেক্সিকোতেও অপমানিত হতে হয়েছে তাকে। উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পাওয়ায় দুনিয়ার সবগুলো চোখ ঘুরে গেছে তার দিকে। তারপর সেই প্ল্যাটফর্ম থেকে রূপান্তরকামীদের প্রতি সদয় হওয়ার নম্র আহ্বান জানিয়েছেন এই অভিনয়শিল্পী। নিজের দেশ মেনে নেয়নি তাকে। সেখানে অপমানিত হতে হয়েছে পদে পদে, বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে, এমনকি প্রায়ই খুনের হুমকি দেওয়া হতো। সেরা নায়িকার স্বীকৃতি হাতে তিনি বলেছেন, ‘আমার নিজের দেশের মানুষ আমাদের বিশ্রি ভাষায় সম্বোধন করে। অথচ আমরা যা, আমাদের সেভাবেই গ্রহণ করা উচিত। শরীর আমাদের, এটা বদলে ফেলার অধিকারও আমার আছে। ট্রান্সজেন্ডাররা স্বাভাবিক মানুষ, মানুষ হিসেবেই তাদের সম্মান পাওয়ার অধিকার আছে।’
সে বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবের আরেক বিস্ময় ছিল ভারত। ত্রিশ বছর পর মূল প্রতিযোগিতা বিভাগের ২২টি সিনেমার তালিকায় জায়গা করে নেয় দেশটির সিনেমা ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’, নির্মাতা পায়েল কাপাডিয়া। ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের পুনেতে নামকরা চলচ্চিত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার ছাত্রী ছিলেন তিনি। ২০১৫ সালে সেখানে চেয়ারম্যান নিয়োগের প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি ও তার সহপাঠীরা। সে বছর অভিনেতা গজেন্দ্র চৌহানকে ওই পদে নিয়োগ দেয় দেশটির তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। প্রতিবাদে ক্লাস বর্জন, অফিস ঘেরাও, মানববন্ধন করেন পায়েলরা। কেউ কেউ গ্রেফতার হন, পুলিশের চার্জশিটে নাম ওঠে তাদের অনেকের। কর্তৃপক্ষের রোষানলে অনুদান দেওয়া হয়নি পায়েলকে। এমনকি ফরেন এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে বিদেশে যাওয়ার পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নিজ দেশে বঞ্চিত, অবহেলিত পায়েল কান থেকে জিতে নেন উৎসবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার গ্রাঁ প্রি। আরেক বিভাগ আঁ সার্তে রিগায় ‘দ্য শেমলেস’ সিনেমার জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পান ভারতের অনসূয়া সেনগুপ্ত। গ্ল্যামারের দুনিয়া হয়তো তাকে গ্রহণ করবে না, কিন্তু অভিনেত্রী হিসেবে তিনি উতরে গেছেন।
মোহাম্মদ রাসুলফ। ছবি: এএফপি
ইরানের এই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার মোহাম্মদ রাসুলফ (৫০)। চলতি বছরের ৮ মে জানা যায়, তাকে আট বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন দেশটির আদালত। একই সঙ্গে চাবুক মেরে শাস্তি ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশও দিয়েছেন। রাসুলফের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার কর্মকাণ্ড দেশটির নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল। ঘটনা হচ্ছে, তার সিনেমায় ইরানের বিচারব্যবস্থার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়েছে। এ কারণেই কারাদণ্ড, আর সেই দণ্ড মাথায় নিয়ে ইরান থেকে পালিয়ে কানে চলে যান তিনি। তার নতুন সিনেমা ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ সেবারের উৎসবে মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে জায়গা করে নিয়েছিল। ইরান সরকারের চাপের মুখেও রাসুলফ তার সিনেমা উৎসব থেকে প্রত্যাহার করেননি। দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়েই গোপনে দেশত্যাগ করেছেন। উৎসব শুরুর আগের দিন ১৩ মে ইনস্টাগ্রামে নিজেই জানিয়েছেন, ‘... সামনে দুটো পথ খোলা ছিল, কারাগার নয়তো নির্বাসন। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি নির্বাসনকেই বেছে নিলাম।’
ইরানের শাসনব্যবস্থা একজন চলচ্চিত্রকারকে সহ্য করতে পারেনি! মাত্র ২ ঘণ্টা ৪৮ মিনিটের একটি সিনেমা একটা দেশের শাসনব্যবস্থার চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে? শিল্পমাধ্যমে বলা কথা, প্রতিবাদ, প্রত্যাশার বিপরীতে পরমতসহিষ্ণুতা কি আরও সহজ নয় একটি শাসনতন্ত্রের জন্য? দীর্ঘকাল ধরে এমন অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে সাধারণ মানুষও যেন প্রতিবাদ করতে ভুলে গেছে। অন্যায় ও জুলুমের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া এখনকার মানুষের জন্য বরং প্রতিবাদ করার চেয়ে সহজ। কিন্তু এর শেষ আছে, সেটা কি সে কখনও ভেবেছে? শুধু শাসক কেন, সাধারণ মানুষও কি ভিন্ন মতকে মেনে নেওয়ার মতো মন রাখে? পৃথিবীটাই যেন হয়ে উঠেছে অসহিষ্ণু, যুদ্ধবাজ। যেখানে পরমতসহিষ্ণুতার কোনো জায়গা নেই। সবচেয়ে কাছের মানুষটিই যে কোনো মুহূর্তে হয়ে উঠছে ঘাতক।
আরও পড়ুন ‘ছাবা’ সিনেমা দেখে গুপ্তধনের সন্ধানে রাতভর খোঁড়াখুঁড়ি যে কারণে হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল টম ক্রুজের সিনেমার শুটিংফ্রান্স পৃথিবীর শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির রাজধানী, সে তো সবার জানা। সিনেমার মতো অতিকায় শিল্পমাধ্যমে তারা পৃথিবীর কাছে বার্তা পৌঁছে দিতে চেষ্টা করছে। নিজের শোবার ঘরে বসে যে কথা বলা যাবে না, সে কথা ফ্রান্সে বসে বলা যাবে। সে কথা সারা পৃথিবী শুনবে। যেমন, অস্ট্রেলিয়ান অভিনেত্রী কেট ব্ল্যানচেট কানের লাল গালিচায় উঠে গায়ের কাপড় উঁচু করে ধরতে পেরেছেন; পৃথিবী দেখেছে, লাল গালিচায় তার সাদা-সবুজ পোশাক হয়ে উঠেছিল ফিলিস্তিনি পতাকা। তিনি পৃথিবীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, ফিলিস্তিনকে ভুলে যেও না। কান থেকে পাঠানো এসব মেসেজ সম্ভবত কাজ করছে না। এসব বার্তা গায়ে মাখছেন না যুদ্ধবাজ বিশ্বনেতারা। তাদের থামাতে আর কী করা যায় সৃষ্টিশীল মানুষেরা কি সেটা আবার ভেবে দেখবেন?
আরএমডি/জিকেএস