ন্যূনতম এমবিবিএস অথবা বিডিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাড়া অন্য কেউ তাঁদের নামের আগে চিকিৎসক (ডাক্তার) পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না—মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আইনের—এমন বিধান প্রশ্নে রুলের ওপর শুনানি শেষ হয়েছে। আগামী বুধবার (১২ মার্চ) রায়ের জন্য দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। এ দিন ন্যায়বিচার না পেলে সব হাসপাতালে বহির্বিভাগের চিকিৎসাসেবা বন্ধ করে দেওয়াসহ কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের নেতারা।
Advertisement
রোববার (৯ মার্চ) রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ণ টাওয়ারে ন্যাশনাল ডক্টরস ফোরামের (এনডিএফ) কার্যালয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এ হুঁশিয়ারি দেন চিকিৎসকেরা। এসময় চিকিৎসকরা সব সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করার কথা বলেন।
বিশ্বের কোনো দেশে এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রি ছাড়া কেউ চিকিৎসক পদবি ব্যবহার করতে পারেন না উল্লেখ করে তারা বলেন, সেখানে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। এমনকী অবৈধ এ বিষয়টি নিয়ে আদালতে বছরের পর বছর রিট ঝুলে রয়েছে। চিকিৎসক সমাজ ও দেশের স্বাস্থ্যখাতের জন্য চরম হুমকি। আগামী ১২ মার্চের মধ্যে এ সংক্রান্ত আইন ও জনস্বাস্থ্য বিরোধী সব রিট নিষ্পত্তি করতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা বিশ্বের কোথাও নেই এমন ‘ডিপ্লোমা চিকিৎসক’ নামে বিভ্রান্তিকর কোনো পদবির প্রচলন করা যাবে না।
সভায় পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। এমবিবিএস ও বিডিএস ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাড়া কাউকে নামের আগে চিকিৎসক পদবি ব্যবহার করতে না দেওয়া, রেজিস্টার্ড চিকিৎসক ছাড়া অন্য কেউ স্বাধীনভাবে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবে না-এ মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে।
Advertisement
আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট কোর্স কারিকুলাম সংস্কার কমিটি গঠন করে তাদের কোর্স কারিকুলাম পুনর্নির্ধারণ এবং মানহীন সব ম্যাটস (মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুল) বন্ধে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
এছাড়া জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণের জন্য শূন্যপদে পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক নিয়োগ এবং চিকিৎসকদের বিসিএসের বয়সসীমা ৩৪ বছরে উন্নীত করতে হবে। অনতিবিলম্বে চিকিৎসক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন এবং বেসরকারি চিকিৎসকদের জন্য সুনির্দিষ্ট বেতন কাঠামো (পে-স্কেল) প্রণয়ন করতে হবে।
এ সময় চিকিৎসকদের দাবিকে যৌক্তিক মন্তব্য করে সমর্থন দেন এনডিএফ নেতারা। দাবি বাস্তবায়নে যৌথ কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা ও পাশে থাকার কথা জানায় এনডিএফ।
সভায় ডক্টরস মুভমেন্ট ফর জাস্টিসের সভাপতি ডা. জাবির হোসেন বলেন, ‘এমবিবিএস এবং বিডিএস ছাড়া কেউ চিকিৎসক লিখতে পারবেন না—এই আইনের বিরুদ্ধে গিয়ে আমরা রিট করেছি। বিষয়টি নিয়ে এ পর্যন্ত ৯১ বার শুনানি হয়েছে, কিন্তু নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আমাদের দাবি, দ্রুতই বিষয়টি নিষ্পত্তি হোক। ম্যাটস থেকে উত্তীর্ণরা অনেক ক্ষেত্রেই অপচিকিৎসা দিচ্ছেন, এটা বন্ধ হোক।’
Advertisement
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই না ম্যাটস বিলুপ্ত হয়ে যাক। তারা তাদের সীমার মধ্যে কাজ করুক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ম্যাটস আছে, তারা সারা বিশ্বেই চিকিৎসকের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু তারা যদি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে আমরাও নিশ্চয়ই বসে থাকবো না।’
কারিকুলাম সংস্কারের দাবি জানিয়ে ডা. জাবির বলেন, ‘ম্যাটসের কারিকুলামটা পুরোটাই গোলকধাঁধায়। তাদের কারিকুলামে অদ্ভুত কিছু রুলস আছে। তাদের কোর্সটা ছিল এতদিন তিন বছর। কিন্তু হঠাৎ করেই আন্দোলন করে সেটা চার বছর বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা সমসময় দেখি উল্টো আন্দোলন করে কারিকুলাম সংক্ষিপ্তের জন্য। কিন্তু তারা আন্দোলন করে বাড়ানোর জন্য। তারা এখন ইন্টার্নশিপ চাচ্ছে। এসব কার্যক্রম পুরোটাই পরিকল্পিত। তাই, আগামী ১২ মার্চের মধ্যে রিটের নিষ্পত্তি এবং ন্যায় বিচার চাই। এরমধ্যে আমরা ড্যাবসহ অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসেছি। দাবি বাস্তবায়ন না হলে সারাদেশের হাসপাতালে বহির্বিভাগে চিকিৎসা প্রদান বন্ধ করে দেওয়া হবে।’
ইউমব’র প্রধান সমন্বয়ক ডা. মোবারক হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের কথা বলে আসছি। প্রায় ১২ বছর ধরে ডাক্তারি পদ ব্যবহারের রিট ঝুলে আছে। তাহলে বিএমডিসি, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর কী করছে? এর পেছনে তৎকালীন চিকিৎসক নেতারাও দায়ী। এখন দুদিন পর পর ডিপ্লোমাধারীদের ডাক্তারি পদ ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন জারি হচ্ছে। এটি চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আমলাদের ষড়যন্ত্র।’
এনডিএফ নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘এনডিএফ’র মতো চিকিৎসকদের পেশাদার সংগঠনগুলো আমাদের অভিভাবক। আমাদের কথাগুলো আপনারা রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে তুলে ধরুন। যে কর্মসূচি আমরা বাস্তবায়ন করব, তাতে আপনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা চাই। বিশেষ করে আদালতে ন্যায় বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে, মন্ত্রণালয়ের বিষয়গুলো তুলে ধরা এবং ম্যাটসের কারিকুলাম স্ট্যান্ডার্ড পর্যায়ে নিতে এনডিএফ’র জোরালো ভূমিকা আমরা প্রত্যাশা রাখি।’
এনডিএফ জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘৫ আগস্টের পর চিকিৎসকদের যত যৌক্তিক দাবি ছিল, সবগুলোর পাশে থেকেছে এনডিএফ। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে একাধিক সংবাদ সম্মেলন ও কনফারেন্স করা হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে প্রতিটি জায়গায় আমরা কথা বলেছি। বর্তমানে চিকিৎসক পদবি ব্যবহার করা নিয়ে দেশব্যাপী সোচ্চার চিকিৎসকেরা। এবারও আমাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করছি। কীভাবে পাঁচ দফা বাস্তবায়ন করা যায়, সে ব্যাপারে সরকারের সঙ্গে কথা বলা হবে। সরকারকেই এগুলো সমাধান করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘চার মাস আগে বিএসসি করা ফিজিওথেরাপিস্টরাও চিকিৎসক পদবি ব্যবহার করার দাবি জানায়। আমরা এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছি, এমএমবিএস ও বিডিএস ডিগ্রিধারী ছাড়াও কেউ চিকিৎসক পদবি ব্যবহার করতে পারবে না। তারপরও আমরা যতটুকু করেছি সেটাকে যথেষ্ট নয় বলে আমরা মনে করি না। স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আজ ষড়যন্ত্র চলছে। ম্যাটসের হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে, তাদেরকে নিয়ে কী করবে? সেটিও ভাবনার বিষয়।’
এনডিএফ’র অফিস সেক্রেটারি ডা. এ কে এম জিয়াউল হকের উপস্থাপনা ও জেনারেল সেক্রেটারি অধ্যাপক ডা. মাহমুদ হোসেনের সঞ্চালনায় ‘স্বাস্থ্য খাতের চলমান পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণ বিষয়ক’ এই সভায় সভাপতিত্ব করেন এনডিএফ’র সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম।
উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক চিকিৎসক সাজেদ আব্দুল খালেক। ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকা বিভাগ উত্তর এবং বিএসএমএমইউ শাখার সভাপতি ডা. আতিয়ার রহমান, ফিন্যান্স সেক্রেটারি ডা. নাজমুল আরেফিন।
মতবিনিময় সভায় বক্তব্য দেন ইউনাইটেড মেডিকেল অর্গানাইজেশন অব বাংলাদেশের (ইউমব) প্রধান সমন্বয়ক ডা. মোবারক হোসেন, ডক্টরস মুভমেন্ট ফর জাস্টিসের সভাপতি ডা. জাবির হোসেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ইন্টার্নচিকিৎসক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ডা. রিফাত মাহবুব, বাংলাদেশ মেডিকেল কমিউনিটির প্রতিনিধি ডা. আসাদুজ্জামান এবং ডা. সম্রাট আকবর, রংপুর মেডিকেল কলেজ ইন্টার ডক্টর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মাহফুজুর রহমান, বাংলাদেশ ফরেন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ডা. শাহরিমা রিতু এবং সেক্রেটারি হেমায়েত উল্লাহ।
এএএম/এমএএইচ/