অর্থনীতি

সর্বজনীন পেনশনে চাঁদা ১৬১ কোটি টাকা, বিনিয়োগ ১৬৪ কোটি

• নিবন্ধন করে চাঁদা দিয়েছেন ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬১ জন• নিবন্ধনকারীদের ৭৭ শতাংশই দরিদ্র• চাঁদা দেওয়ার শীর্ষে বেসরকারি চাকরিজীবীরা• ছয় মাসে নতুন নিবন্ধন মাত্র ১ হাজার ২৬৭ জন• আস্থা সংকটে কমেছে নিবন্ধনের গতি, রোজার পর ব্যাপক প্রচার

Advertisement

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সর্বজনীন পেনশন স্কিমে কমেছে নিবন্ধনের গতি। গত ছয় মাসে নতুন নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মাত্র এক হাজারের মতো। নিবন্ধনের গতি কমলেও প্রতিনিয়ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে টাকা জমার পরিমাণ বাড়ছে। বাড়ছে বিনিয়োগের পরিমাণও। ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করা অর্থ চাঁদা বাবদ জমা পড়া অর্থের পরিমাণকেও ছাড়িয়ে গেছে।

প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা— এই চার স্কিমে এরই মধ্যে তিন লাখ ৭৩ হাজারের বেশি মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দিয়েছে। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ১৬১ কোটি টাকার কিছু বেশি। বিপরীতে সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে সরকারি বিভিন্ন ট্রেজারি বন্ড ও বিলে এরই মধ্যে বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, চাঁদা বাবদ যে অর্থ জমা পড়েছে বিনিয়োগ হয়েছে তার চেয়ে প্রায় তিন কোটি টাকা বেশি। জমা হওয়া চাঁদার চেয়ে বিনিয়োগ বেশি হওয়ার কারণ সরকারি ট্রেজারি বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করে যে মুনাফা পাওয়া গেছে, সেই অর্থও বিনিয়োগ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সর্বস্তরের জনগণকে একটি টেকসই ও সুসংগঠিত সামাজিক নিরাপত্তা কাঠামোর আওতায় আনতে ২০২৩ সালে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করে সরকার। ওই বছরের ১৭ আগস্ট উদ্বোধনের পরপরই সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আবেদন শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা— এই চার স্কিম নিয়ে সরকার সর্বজনীন পেনশন চালু করে।

Advertisement

পরবর্তীসময়ে সব স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘প্রত্যয় স্কিম’ নামে নতুন স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে শিক্ষকদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীসময়ে প্রত্যয় স্কিম বাতিল করে সরকার। সে হিসেবে বর্তমানে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা- এই চারটি স্কিম চালু রয়েছে।

আমরা আমাদের প্রত্যাশিত জায়গায় যেতে পারিনি। মানুষের মধ্যে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা ফিরিয়ে আনতে একটু সময় লাগবে। অনেকে মনে করেছিল ৫ আগস্টের পর এই স্কিম আর থাকবে না।- সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা

শুরুতে সর্বজনীন পেনশনে মানুষের ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেলেও মাঝে নিবন্ধনে কিছুটা ধীরগতি আসে। তবে গত বছরের এপ্রিল মাস থেকে হু হু করে বাড়তে থাকে নিবন্ধন করে চাঁদা জমা দেওয়া মানুষের সংখ্যা। এপ্রিলে ৬০ হাজার মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে। এতে ওই মাসে নিবন্ধনের সংখ্যা এক লাখের মাইলফলক স্পর্শ করে।

আরও পড়ুন চালু থাকবে সর্বজনীন পেনশন স্কিম, নিবন্ধনের গতি কমেছে কোথায় কীভাবে আছে সর্বজনীন পেনশনের টাকা বিশ্ববিদ্যালয়-রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান/ সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত বাতিল ৯৯ শতাংশ পোশাকশ্রমিকই সর্বজনীন পেনশনে আগ্রহী নয়: জরিপ

অর্থাৎ, সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালুর আট মাস পরে নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা এক লাখ ছোঁয়। এরপর মে ও জুন মাসেও বিপুল সংখ্যক মানুষ নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দেন। এতে জুলাই মাস শুরু হতেই নিবন্ধন সম্পন্নকারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন লাখ হয়ে যায়। আর জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

Advertisement

তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পর পেনশন স্কিমে নিবন্ধের গতি বেশ কমে যায়। এরপর প্রায় সাত মাস পার হয়ে গেছে। অবশ্য ছাত্রদের আন্দোলন তীব্র হয় জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের গতি কমতে থাকে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২ জুলাই দুপুর পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করেন তিন লাখ ৪০ হাজার ২৪২ জন। আর তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ছিল ৯৯ কোটি ৮০ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ৯২ কোটি ৮৮ লাখ টাকায় সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়।

দুই মাস পর ৯ সেপ্টেম্বর বিকেল পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নিবন্ধন সম্পন্ন করার সংখ্যা দাঁড়ায় তিন লাখ ৭২ হাজার ৯৪ জন। আর তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২৩ কোটি ৫৬ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা সরকারি ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়।

অর্থাৎ, আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর পর দুই মাসে (৩ জুলাই থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সর্বজনীন পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করে নতুন নিবন্ধন সম্পন্ন করেন ৩১ হাজার ৮৫২ জন। পরবর্তীসময়ে নিবন্ধের হার আরও কমে যায়। সবশেষ চলতি বছরের ৩ মার্চ দুপুর পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমাদানকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬১। অর্থাৎ, শেষ ছয় মাসে মাত্র ১ হাজার ২৬৭ জন নতুন নিবন্ধন করেছে।

এদিকে নতুন নিবন্ধনকারীর সংখ্যা কমলেও পেনশন স্কিমে আগের মতোই নিবন্ধের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে দরিদ্র মানুষ, যাদের বার্ষিক আয় সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা। এই আয়ের মানুষদের জন্য চালু করা হয়েছে সমতা স্কিম। এই স্কিমের মাসিক চাঁদার পরিমাণ এক হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫০০ টাকা স্কিম গ্রহণকারী দেবেন এবং বাকি ৫০০ টাকা সরকার থেকে দেওয়া হবে।

৩ মার্চ পর্যন্ত এই স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে দুই লাখ ৮৬ হাজার ৫৯ জন। জমা পড়া চাঁদার পরিমাণ ৪৪ কোটি ৯২ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অর্থাৎ, পেনশন স্কিমে নিবন্ধন সম্পন্নকারীদের ৭৭ শতাংশই দরিদ্র মানুষ। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৮৫ হাজার জন। অর্থাৎ, গত ছয় মাসে এই স্কিমে নতুন করে এক হাজার ৫৯ জন নিবন্ধন করেছেন। এ হিসেবে গত ছয় মাসে যে নতুন নিবন্ধন হয়েছে তার ৮৪ শতাংশই সমতা স্কিমের।

এদিকে বাকি তিন স্কিমের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিবন্ধন করেছেন অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা। সবচেয়ে বেশি চাঁদা জমা দিয়েছেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। বরাবরের মতো প্রবাসীদের নিবন্ধন ও চাঁদা বাবদ জমা দেওয়া অর্থের পরিমাণ সবচেয়ে কম।

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের কার্যক্রম চালু রয়েছে। প্রতিটি নিবন্ধনের জন্য আমরা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ১৫ টাকা করে দেই। এটা সরকারের বাজেট থেকে দেওয়া হয়। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে যিনি নিবন্ধন করবেন, তাকে বাড়তি কোনো অর্থ দিতে হবে না

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীদের জন্য চালু করা প্রগতি স্কিমে চাঁদা জমা পড়েছে ৬৩ কোটি ৭৯ লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা। এই স্কিমে নিবন্ধনকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৯৪২ জন।

অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বা স্বকর্মে নিয়োজিত ব্যক্তি যেমন- কৃষক, রিকশাচালক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি ইত্যাদি পেশার ব্যক্তিদের জন্য চালু করা সুরক্ষা স্কিম গ্রহণ করে চাঁদা পরিশোধ করেছেন ৬৩ হাজার ৪০৫ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ৪৬ কোটি ৮৯ লাখ ৩৮ হাজার টাকা।

বিদেশে অবস্থান করা বা প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য চালু করা প্রবাস স্কিমে চাঁদা জমা দিয়েছেন ৯৫৫ জন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ৬ কোটি ১৫ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ টাকা।

সবমিলিয়ে প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা এবং সমতা— এই চার স্কিমে মোট ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৩৬১ জন নিবন্ধন সম্পন্ন করে চাঁদা জমা দিয়েছেন। তাদের জমা দেওয়া চাঁদার পরিমাণ ১৬১ কোটি ৩৭ লাখ ৮২ হাজার টাকা। আর সর্বজনীন পেনশন স্কিম থেকে সরকারি ট্রেজারি বন্ড ও বিলে বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা।

যোগাযোগ করা হলে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা জাগো নিউজকে বলেন, ‘সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ১৬১ কোটি টাকার কিছু বেশি চাঁদা জমা পড়েছে এবং বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা। জমা পড়া চাঁদা থেকে বিনিয়োগ বেশি হওয়ার কারণ বিনিয়োগ থেকে যে মুনাফা হয়েছে, সেই অর্থও বিনিয়োগ করা হয়েছে।’

পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের গতি কমে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রত্যাশিত জায়গায় যেতে পারিনি। মানুষের মধ্যে যে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা ফিরিয়ে আনতে একটু সময় লাগবে। অনেকে মনে করেছিল ৫ আগস্টের পর এই স্কিম আর থাকবে না।’

তিনি বলেন, ‘প্রত্যাশিত জায়গায় যাওয়ার জন্য আমাদের ব্যাপক আকারে মানুষের কাছে যেতে হবে, সেটার জন্য আমরা কর্মপরিকল্পনা নিয়েছি। আমরা আশা করছি রোজার পর একটা ভালো অ্যাফোর্ট দিতে পারবো। রোজার ভিতরে মেলা করা যায় না, আর করলেও ভালো ফলাফল পাওয়া যায় না।’

ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে নিবন্ধনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের কার্যক্রম চালু রয়েছে। প্রতিটি নিবন্ধনের জন্য আমরা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ১৫ টাকা করে দেই। এটা সরকারের বাজেট থেকে দেওয়া হয়। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে গিয়ে যিনি নিবন্ধন করবেন, তাকে বাড়তি কোনো অর্থ দিতে হবে না।’

এমএএস/এএসএ/এএসএম