বিনোদন

সৈয়দ জামিল আহমেদের অভিযোগ নিয়ে যা বললো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়

শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের (ডিজি) পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন নাট্যব্যক্তিত্ব সৈয়দ জামিল আহমেদ। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সেসময় তিনি শিল্পকলার কাজে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও উপদেষ্টার হস্তক্ষেপের অভিযোগ আনেন।

Advertisement

সেই প্রেক্ষিতে গেল শনিবার বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ফেসবুকে ফারুকী লেখেন, ‘আপাতত বলে রাখি, উনার (সৈয়দ জামিল আহমেদ) বলা অনেকগুলা কথা পুরো সত্য নয়, অনেকগুলা কথা ডাহা মিথ্যা এবং কিছু কথা পরিস্থিতি ডিল (মোকাবিলা) না করতে পারাজনিত হতাশা থেকে বের হয়ে আসা বলে মনে হচ্ছে।’

এবার পাওয়া গেল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা। রোববার সন্ধ্যায় পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন। তিনি সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর দাখিলকৃত পদত্যাগ পত্রে পদত্যাগের কোনো কারণ উল্লেখ না করলেও পরবর্তীতে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কিছু কারণ উল্লেখ করেন। উক্ত বিবৃতিটি মন্ত্রণালয়ের নজরে এসেছে। জামিল আহমেদের উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের প্রতি কিছু অসত্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য ব্যবহৃত হয়েছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার বিষয়েও অসত্য, মনগড়া ও ব্যক্তিগত আক্রমণাত্মক বক্তব্য রয়েছে। এহেন পরিস্থিতিতে ড. সৈয়দ জামিল আহমেদ কর্তৃক উত্থাপিত অসত্য অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়।

সেখানে বলা হয়েছে, একটি ভিডিও নির্মাণের বিষয়ে চিঠিপত্র ছাড়া টাকা প্রদানের জন্য চাপ প্রয়োগ বিষয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক বক্তব্য ও অভিযোগ সম্পূর্ণ অসত্য ও বানানো। গত ২০-২১ ফেব্রুয়ারি প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দফতরে অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত অনুষ্ঠানে বিশেষ আমন্ত্রিত হয়ে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশের পক্ষে উক্ত অনুষ্ঠানে মাতৃভাষা দিবসের ইতিহাস সংরক্ষণে বাংলাদেশের অবদান তুলে ধরে বিশেষভাবে নির্মিত একটি ১৫ মিনিটের ভিডিও এবং একটি লাইভ প্রোগ্রাম উপস্থাপন করা হয়।

Advertisement

ভিডিওটি নির্মাণের জন্য গত ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিকে একটি পত্র প্রেরণ করা হয়। পত্রের ২ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে মন্ত্রণালয়ের ৩৮ কোডের ‘সাংস্কৃতিক মঞ্জুরি- ৩৮২১১১৫’ খাত থেকে বর্ণিত খরচের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা হবে। উন্নত কারিগরি সহায়তা এবং সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে ভিডিওটি নির্মাণের জন্য নিয়ম অনুযায়ী অগ্রিম কিছু অর্থ নির্মাতাকে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হলে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক মহোদয় সম্পূর্ণ অসৌজন্যমূলক আচরণ করে বাজেট বরাদ্দ না দিলে অর্থ দেয়া হবে না মর্মে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার অনুরোধকে নাকচ করেন। অথচ মহাপরিচালক এর পূর্বে সাধু মেলা অয়োজনের জন্য শুধুমাত্র উপদেষ্টার মৌখিক কথায় প্রায় ৩৩ লাখ টাকার প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের উদ‍্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে এই বিষয়ে পত্র প্রেরণ করা হয়। সাধারণত জরুরি বিবেচনায় মন্ত্রণালয় তার দপ্তর সংস্থাগুলোর এরকমভাবে কাজ এগিয়ে নেয়।

কিন্তু এবার পূর্বেই পত্র প্রেরণ করা হয়েছিল। শুধু তাই নয়, ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন ও সমন্বয়ের জন্য উপদেষ্টা, ইউনেস্কো সদর দফতর, বাংলাদেশ দূতাবাস, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, ভিডিও নির্মাতা, শিল্পকলা একাডেমিকে সংযুক্ত করে একটি হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক অসৌজন্যমূলকভাবে উক্ত হোয়াটসএ্যাপ গ্রুপ থেকে বেরিয়ে যান।

পূর্বে এ ভিডিও নির্মাণের জন্য যথোপযুক্ত পত্র প্রেরণ করা হলেও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের প্রতি সম্মান ও তার একগুয়েমির জন্য গত ১০ ফেব্রুয়ারি তারিখে পুনরায় বাজেট বরাদ্দের বিষয় উল্লেখপূর্বক করে পত্র প্রেরণ করা হয়। প্যারিসের ইউনেস্কো সদর দফতরে অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ২৫ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রায় ২০ দিন পূর্বে মন্ত্রণালয় হতে পত্র প্রেরণ এবং ১০ দিন পূর্বে বাজেট বরাদ্দ প্রদান সংক্রান্ত পত্র দেয়ার পরও চিঠি ছাড়া টাকা দেয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয় হতে চাপ দেয়ার বক্তব্য শুধুমাত্র অসত্যই নয়, ব্যক্তিগত আক্রোশের বহি:প্রকাশ বলে প্রতীয়মান হয়। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক এমনভাবে বিষয়টির অবতারণা করেছেন, প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে সংস্কৃতি উপদেষ্টা তার ব্যক্তিগত কাজের জন্য কোনো অনৈতিক টাকা দাবি করেছেন।

শিল্পকলা একাডেমির কাজে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় শিল্পকলা একাডেমির কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করেনি। মন্ত্রণালয় একাডেমির কোনো কাজ বন্ধ করতে বলেছে এরকম কোনো নজির নেই। বরং সবসময় শিল্পকলার কাজকে উৎসাহিত করা হয়েছে। বাংলাদশের কোনো কোনো জায়গায় যখন বাউলদের প্রোগ্রাম নিয়ে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল তখন মন্ত্রণালয় শিল্পকলা একাডেমিকে বাউলদের জন‍্য শিডিউলকৃত সাধুমেলার সংখ্যা দ্বিগুণ করতে পরামর্শ দেয়। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এছাড়া ‘রিমেম্বারিং জুলাই রেভ্যুলেশন’ নামে ৮ বিভাগে প্রোডাকশন ওরিয়েন্টেড ফিল্ম মেকিং ওয়ার্কশপ পরিচালনা করার জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলাএকাডেমিকে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়। সেই সাথে একদল বেসরকারি বিশেষজ্ঞ টিম এজন্য কাজ করছে। এসব কাজে মন্ত্রণালয় সার্বিকভাবে সহযোগিতা ও সমন্বয় করছে। পাশাপাশি জুলাই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে ৮টি নতুন থিয়েটার ও একটি গেরিলা/ ইনভিজিবল থিয়েটার নির্মাণের বিষয়েও মন্ত্রণালয় হতে শিল্পকলা একাডেমিকে বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন কর্মসূচিতে শিল্পকলা একাডেমির অনুরোধে মন্ত্রণালয় হতে সাধারণ বাজেটের বাইরেও বিশেষ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং শিল্পকলা একাডেমিকে আন্তরিক সহযোগিতা প্রদান ছাড়া কোনরকম হস্তক্ষেপের কোন নজির নেই। তাই যা তিনি বলেছেন তা অসত্য, তাঁর মনগড়া।

Advertisement

বাজেট বরাদ্দের বিষয়ে অমূলক অভিযোগ নিয়ে মন্ত্রণালয় বলছে, জুলাই বিপ্লবের পর শিল্পকলা একাডেমির নিয়মিত বাজেট বরাদ্দের বাইরেও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টার ব্যক্তিগত আগ্রহে সাধুমেলা আয়োজন, জুলাই বিপ্লবের উপর বিশেষ নাটক প্রযোজনা, মনিষী স্মৃতিমূলক অনুষ্ঠানসহ নানাবিধঅনুষ্ঠানের জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেয়া হয়। এসব অনুষ্ঠান বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। কোনো আর্থিক বছরে বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি নিতান্তই অর্থ মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট বরাদ্দের মিটিংয়ে রুটিন দায়িত্ব অনুযায়ী নেগোশিয়েশনের জন্য বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিসহ সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সকল দপ্তর/ সংস্থার প্রধানগণ উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলার ভঙ্গুর শিল্পকলা একাডেমি ভবন মেরামত, সংস্কারসহ সর্বমোট ২০০ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করা হয়। অর্থ সচিব মিটিংয়ের প্রথমইে সকল দফতর/সংস্থা প্রধানের উদ্দেশ্যে বলেন অর্থনৈতিক মন্দা ও সীমাবদ্ধতার জন্য বাজেট কিছুটা কাটছাট করা হবে তবে শিল্পকলা একাডেমির বিষয়ে বলা হয়েছে আলাদা প্রকল্প গ্রহণ করা হলে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া হবে। এছাড়া আগামী ২০২৫-২৬ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের শিল্পকলা একাডেমির জন্য চলতি বছরের চেয়েও বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে মর্মে অবহতি করা হয়। এমনকি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও অর্থ বরাদ্দ করা হবে মর্মে নিশ্চিত হয়েছে। তাই অর্পযাপ্ত বাজেট বিষয়ে অভিযোগ নিতান্তই অমূলক ও প্রশাসনিক অদক্ষতার বহিঃপ্রকাশ।

রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ বা প্রটোকলের তোয়াক্কা না করার অভিযোগ তোলা হয়েছে সৈয়দ জামিল আহমেদের বিরুদ্ধে। মন্ত্রণালয় লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছে, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানের ফাইনাল রিহার্সাল অনুষ্ঠানে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় সংগীত ও আবহ সংগীত পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে রিহার্সালে আসতে না দিয়ে মিটিংয়ের নামে আটকিয়ে রাখেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। যে মিটিং তিনি সকালবেলা বা পরদিন বিকালে আযোজন করতে পারতেন। একই অনুষ্ঠানের পদক বিতরণে জাতীয় সংগীতে অংশগ্রহণকারী একজন সংগীতশিল্পীকে শুনানির নামে অংশ নিতে দেননি। সংশ্লিষ্ট শিল্পী একুশে পদকের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন বলে শুনানি পিছিয়ে দেয়ার অনুরোধ করলে তিনি কোনোভাবেই তাতে রাজি হননি। বরং তিনি তাকে বিষোদগার করেন।

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আইন অনুযায়ী প্রতি তিন মাস অন্তর একাডেমির সভা করার বিধান থাকা সত্ত্বেও পরিষদ সভার কার্যবিবরণী অনুমোদন করতে উপদেষ্টা ৫ সপ্তাহ অহেতুক সময় নেন। অথচ একাডেমির আইন অনুযায়ী প্রতি তিন মাস অন্তর সভা করার বিধান রয়েছে। সৈয়দ জামিল আহমেদের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর যোগদান করেন। তাঁকে সচিব পদমর্যাদা প্রদান করা হয় ২১ নভেম্বর। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৫ ডিসেম্বর তাঁর চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করে। উপদেষ্টা কর্তৃক তারিখ ও সময় নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পকলা একাডেমির ১২৫তম পরিষদ সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৮ ডিসেম্বর জাতীয় নাট্যশালার সেমিনারকক্ষে। উক্ত সভার কার্যবিবরণী বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি হতে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয় ২৩ ডিসেম্বর। উক্ত কার্য বিবরণী অসম্পূর্ণ তথ্যসহ বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল বিধায় সংশোধন করে পাঠানোর জন্য এ বছরের ৯ জানুয়ারি শিল্পকলা একাডেমিকে চিঠি দেওয়া হয়। শিল্পকলা একাডেমির সচিব সংশোধিত কার্যবিবরণী নিজ দায়িত্বে হাতে হাতে মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসেন ১২ জানুয়ারি। এরপর প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শেষে মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমোদনে ২০ জানুয়ারি শিল্পকলা একাডেমিতে প্রেরণ করা হয়। সুতরাং এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কালক্ষেপণের অভিযোগ সত্য নয়।’

এলআইএ/জেআইএম