ড.ফোরকান আলী
Advertisement
মুক্তা একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রাকৃতিক মুক্তা সংগ্রহ করে আসছে। চীনে সর্বপ্রথম শিল্পভিত্তিক কৃত্রিম উপায়ে মুক্ত চাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে কৃত্রিম উপায়ে মুক্তা উৎপান ও চাষ শুরু হয়।
তবে বাংলাদেশি গোলাপি মুক্তা পৃথিবীখ্যাত। এখনো দেশের গোলাপি উজ্জ্বল মুক্তার বিদেশে কদর রয়েছে। অষ্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকে গোলাপি উজ্জ্বল মুক্তা কিনে নিয়ে যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মুক্তাচাষ সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ সেভাবে গড়ে ওঠেনি। ১৯৭৪-৭৯ সালে মৎস্য অধিদপ্তর মুক্তা বহনকারী ঝিনুক চাষের পরীক্ষামূলক প্রকল্প শুরু করে। পরবর্তীতে ময়মনসিংহ মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রে ও মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউটের সহযোগিতায় পরীক্ষামূলকভাবে কৃত্রিম উপায়ে মুক্ত চাষের প্রচেষ্টা চালায়। সুষ্ঠ পরিচর্যা, সঠিক প্রযুক্তি উদ্ভাবন সম্ভব হয়নি। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে গবেষণা করছেন। ব্যক্তিগত পর্যায়েও এদেশে অনেকেই বর্তমানে মুক্তা চাষে এগিয়ে আসছে।
মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকসমূহতবে সব ঝিনুক থেকেই কিন্তু মুক্তা পাওয়া যায় না। বাংলাদেশে পাঁচ প্রকার ঝিনুকে মুক্তা পাওয়া যায়। তবে গোলাপি মুক্তা পাওয়া যায় ল্যান্ডস্যালাইডস ও ফার্সিয়া জাতের ঝিনুকে। যা শতকরা ১-৩ ভাগ এবং লামেলীয়া ও মারজেনালিয়া প্রজাতির শতকরা ৭-১০ ভাগ মুক্তা পাওয়া যায়। এছাড়া প্লাকুনা প্লাসিন্টা নামক দেশীয় সামুদ্রিক ঝিনুকেও মুক্তা পাওয়া যায়।
Advertisement
বাংলাদেশে নদী-নালা, খাল-বিল ও পুকুরে পরিপূর্ণ মুক্তা বহনকারী ঝিনুকের প্রাচুর্য্যে ভরপুর। এদেশে ঝিনুকে মুক্তা হওয়ার মতো পানি ও মাটির রাসায়নিক গুণ এবং সুন্দর আবহাওয়া বিদ্যমান। মুক্তা বহনকারী ঝিনুক বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলাতেই পাওয়া যায়। তবে উন্নতমানের গোলাপি মুক্তা শুধু বৃহত্তর ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, ফরিদপুর, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল জেলায় পাওয়া যায়।
মুক্তার প্রকারভেদমুক্তা বিভিন্ন আকারের, রঙের ও নামের হয়ে থাকে। আকারের দিকে দিয়ে লম্বা, ত্রিকোনা, গোলমুক্তা মেথী, গারা, চুমকী, রাইটকী, ফসকী ডিম্বাকৃতি গোল ও চুর, ঝুর নামে পরিচিত। অপরিপক্ক মুক্তাকে চুর/ঝুর বা গুঁড়া মুক্তা বলা হয়ে থাকে। মুক্ত সাধারণত সাদা, গোলাপি, উজ্জ্বল গোলাপি, কালো সোনালি, সোনালি হলুদ, ধূসর ও মরা মুক্তা (রংহীন) রঙের হয়ে থাকে।
ঝিনুকের খাদ্যভ্যাসঝিনুক মিঠা, লোনা উভয় প্রকার জলাশয়ে জম্মায়। পানির তলদেশে বিচরণ ও নিচের স্তরের পচাগলা জৈবিক পদার্থ খেয়ে থাকে বলে পচাগলা ভোজী প্রাণি হিসেবে পরিচিত। খাদ্য গ্রহণের প্রতিযোগিতায় ঝিনুকের সঙ্গে পুকুরের তলদেশের খাদ্যভোজী অন্যান্য মাছ (মৃগেল, চিংড়ি, মিরর কার্প, ব্ল্যাক কার্প প্রভৃতির) চাষ করা যায় না। ঝিনুক বিভিন্ন পরজীবীর পোষক হিসেবে কাজ করে। ঝিনুকের স্পর্শে পুকুরের নিচের স্তরের মাছ বা চিংড়ি রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ঝিনুক সংগ্রহ, মজুদ, পুকুর প্রস্তুত ও ছাড়ার সময়প্রাকৃতিকভাবে ঝিনুকের চাষে ভালো প্রজাতির লেমিলিডেন্স অরজিনালিস প্রজাতির লম্বাটে ফোলা বা একটু মোটা ধরনের ঝিনুক সবচেয়ে ভালো। জুন-জুলাই মাসে ঝিনুক নদী নালা খাল বিলে ডিম ছাড়ে। ডিমগুলো আঁঠালো বিধায় জলাশয়ে নিমজ্জিত বাঁশ, বাঁশের কঞ্চি বা আগাছার সঙ্গে আটকে থাকে। দুই মাসের মধ্যে খোলসসহ ২-৩ সেন্টিমিটার ছোট ঝিনুকে পরিণত হয়। তখন ঝিনুক সংগ্রহ করে পুকুর বিলে মজুদ করা ভালো। নাইলনের জালের বা বাঁশের গড়া দিয়ে তৈরি বেষ্টনীর মধ্যে ছাড়লে মুক্তা চাষের জন্য অপারেশনের সময় সংগ্রহ করা সহজ হয়। পুকুর/বিলে তখন রাসায়নিক সার, জৈব সার ও চুন প্রয়োগ করতে হবে।
Advertisement
এক বিঘা পুকুরে মাছের সঙ্গে সর্বোচ্চ ২ হাজার ঝিনুক ছাড়া যেতে পারে। ৩ বছর পর বা ঝিনুকের আকার সাধারণত ১০ সেমি এর উর্ধ্বে হলে জলাশয় থেকে উঠিয়ে মুক্তা সংগ্রহ করতে হবে। মাছ ও ঝিনুক চাষের জন্য পুকুরের গভীরতা ২ মিটার হলে ভালো। মাটি দো-আঁশ বা এঁটেলে দো-আঁশ। পুকুর শুকিয়ে বিঘা প্রতি ৬০ কেজি চুন এবং পরবর্তীতে ৫-৬’শ কেজি পচা গোবর প্রয়োগ করে পুকুরে তলদেশের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হবে। বর্ষার পানিতে পুকুর ভরে গেলে ঝিনুক ও মাছ ছাড়তে হবে । মাছ চাষের নিয়মানুযায়ী রাসায়নিক সার বিঘা প্রতি ১৫ কেজি ইউরিয়া ও ১৫ কেজি টি এস পি প্রয়োগ করা যেতে পারে। পরবর্তীতে প্রতি মাসে ৫ কেজি করে প্রয়োগ করতে হবে।
প্রাকৃতিক মুক্তা উৎপাদনের কারিগরি দিক ও কলা কৌশলসাধারণত মুক্তা ঝিনুকের শরীরের ছয়টি অংশে পাওয়া যায়। মুক্তার রাসায়নিক পরীক্ষা করে দেখা গেছে এতে শতকরা ৯২ ভাগ ক্যালসিয়াম, ৬ ভাগ অজৈব খনিজ পদার্থ ২ ভাগ পানি। মুক্তার আকার ও রং ইত্যাদি নির্ভর করে ঝিনুকের ভিতর, ক্যালসিয়াম জাতীয় কি ধরনের কণিকা প্রবেশ করেছে তার উপর। প্রাকৃতিকভাবে খাদ্য আহরণ কালে বা চলন্ত অবস্থায় ঝিনুকের খোল থেকে কোনো কণা বা বাইরে থেকে যদি কোনো দ্রব্য, (বালির কনা, ময়লা বা কোনো পোকা) যদি ঝিনুকরে গায়ে পড়ে তাহলে ঝিনুকের শরীর থেকে এক ধরনের লালা নিস্বরণ হয়ে তা ঐ পদার্থের চারপাশ ঢেকে দেয়। প্রতিনিয়ত তার উপর লাল আবরণের পর আবরণ জমা হতে হতে এক সময় মুক্তায় পরিণত হয়। মাটি, পানি ইত্যাদির রাসায়নিক গুণের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন রঙের মুক্তা তৈরি হয়ে থাকে।
কৃত্রিম উপায়ে মুক্তা উৎপাদনের কৌশলঝিনুকের বাইরের শক্ত আবরণ বা খোলটি ক্যালসিয়াম কার্বনেট দ্বারা তেরি। শক্ত আবরণের নিচেই ম্যানটেল নামক পাতলা একটি পর্দা আছে এবং পর্দার উপরের অংশটি ভীষণ সংবেদনশীল। পর্দার এই অংশ (অর্থাৎ পায়ের উর্ধ্বাংশ যেখানে ডিম্বাশয় শুরু) ছিদ্র করে কেটে ক্ষুদ্র কণা/পুতি/ছোট মরা মুক্তা ঢুকানো হয়। ফলে উপরের অংশের বিভিন্ন কোষে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় কোষসমূহ বহিরাগত কণিকা সংস্পর্শ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য লালা নিঃসৃত করে এবং বস্তুটিকে ঢেকে দেয়। ফলে ঝিনুকের দেহের উত্তেজনা বৃদ্ধি পায় এবং বেশি পরিমাণে লালা বেরিয়ে কণিকাটিকে শক্ত আকারে রূপান্তরিত করে মুক্তায় পরিণত করে।
ফারমিন পারটিসেল ঢুকানোর পর ঝিনুকের মৃত্যুহার শতকরা ২০-২৫ ভাগ এবং কমপক্ষে ১০ ভাগ ঝিনুক শরীর থেকে বহিরাগত কণিকাটিকে বের করে দেয়। জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত, ফিলিপাইন, বার্মায় বর্তমানে ৭০-৮০ ভাগ ঝিনুক এ পদ্ধতিতে মুক্তা উৎপাদন ও আহরণ করে থাকে। কৃত্রিম উপায়ে মুক্তা উৎপাদনের জন্য আপারেশন কার্যক্রমকে আরামদায়ক ও সুন্দরভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় চেয়ার, টেবিল, ট্রে, গামলা, বালতি, শুকনা কাপড়, স্পঞ্জ, এন্টিবায়েটিক ওষুধ ইত্যাদি উপকরণের প্রয়োজন।
ঝিনুক অপারেশনের জন্য স্থান নির্বাচনঘরের ভেতরে বা বাইরে পুকুর পাড়ে ছায়ামুক্ত স্থান আপারেশনের জন্য উত্তম। অপারেশনের ০৫-১০ দিন আগে সিসেন্টের তৈরি ট্যাঙ্কে ঝিনুক সংগ্রহ করে রাখা ভালো। যাতে সঠিক ব্যবস্থাপনায় অপারেশনকৃত ঝিনুক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতিপালন করা যেতে পারে।
আপারেশন পদ্ধতিঝিনুকের দুই স্থানে যথা গোনাড ও দেহস্থিত মোট আবরনীয় মেন্টলের মধ্যে নিউক্লুজ প্রতিস্থাপন করা হয়ে থাকে। গোনাড থেকে চক্রাকারে ও ম্যানটেল থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীজ, মুক্তা উৎপাদিত হয়ে থাকে।
মুক্তা ও ঝিণুক আহরণঝিনুকের অভ্যন্তরে মুক্তার বৃদ্ধি দুই থেকে আড়াই বছর দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এরপর বৃদ্ধির হার কমে আসে। ৩০ থেকে ৩৬ মাস পর যখন ঝিনুকগুলো ১০ সেমি বা তদুর্ধ্ব হবে তখন সেগুলো পানি থেকে ওঠাতে হবে। সংগৃহীত ঝিনুকগুলো কেটে খোলসমুক্ত করে মাংস আলাদা করার পর্বে হাতে আঙুল দিয়ে টিপে দেখতে হবে। কোনো শক্ত পদার্থ অনুভব করলে তা মাংস থেকে বিছিন্ন করে পরিষ্কার পানির পাত্রে রাখতে হবে। এভাবে মুক্তা সংগ্রহ করা যায়। আবার শতকরা ৫ ভাগ পটাশিয়াম হাইড্রোক্সাইডের পানির দ্রবণে ১০ মিনিট আহরিত ঝিনুকগুলো রেখেও মুক্তা আলাদা করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে মুক্তা থাকলে পাত্রের নিচে জমা হবে। ঝিনুকের খোলস ও অনেক মুল্যে বিক্রি হয়।
মুক্তার মূল্যমুক্তার মূল্য আকার, রং ও সাইজের উপর নির্ভর করে। সাদা মুক্তার চেয়ে ঝিকমিক করা গোলাপি প্রভাবিশিষ্ট বড় মুক্তা ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে। ছোট মুক্তার এবং অনুজ্জল মুক্তার মূল্য কম। এমনকি টাকা হিসেবেও প্রতিটি কিনতে পাওয়া যায়। পাঁচ সেমি গভীর এবং ৭.৫ সেমি লম্বা মুক্তাটি এশিয়ার মুক্তা নামে খ্যাত। ১৬২৮ সালে বাহরাইনের নিকটে, পারস্য উপসাগরে এক ডুবুরী মুক্তাটি পেয়েছিল। যেটি এখন যুক্তরাজ্যের ভাণ্ডারে রক্ষিত আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বে যার মূল্য ছিল ৩০ হাজার পাউন্ড ষ্ট্যালিং। এর ধরনের বড় মুক্তা আজও এক অপার রহস্যময়তার ঘিরে আছে। যা আমাদেরকে বিষয়টি নিয়ে গবেষণা কাজ করতে প্রলুব্ধ করে।
নক্ষত্র দেখে ভবিষ্যৎদান বিদ্যায় মুক্তার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখে থাকেন হস্তরেখাবিদগণ। যেমন ধন সম্পদ প্রাপ্তির জন্য সোনালি মুক্তা, আদর্শে জন্য সাদা মুক্তা, দর্শন গভীরতার জন্য কালো মুক্তা, সৌন্দর্যের জন্য গোলাপি মুক্তা, লাল মুক্তা ব্যবহৃত হয়। স্বাস্থ্য, শক্তি ও চিন্তাশক্তি উন্নয়নের জন্য ধূসর মুক্তা ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ।
করণীয়মুক্তার মূল্য অনেক। অলংকার হিসেবে হীরার পরই এর স্থান। শুধু মিঠা পানির ঝিনুকই নয়, সামুদ্রিক ঝিনুক বা ওয়িস্টারে মুক্তা চাষ করে দেশীয় প্রয়োজন মিটানোসহ প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। জাপানের মিকিমটো নামে এক বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম কৃত্রিম উপায়ে ম্ক্তুা তৈরি করেন। তার নামে জাপানে একটি দ্বীপের নাম মুক্তা দ্বীপ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের কক্সবাজারের মহেশখালী, সোনাদিয়া, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া ইত্যাদি এলাকায় প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক বড় সাদা মুক্তা বহনকারী পাকুনা প্লাসিন্টা নামক ঝিনুক ও মুক্তা চাষের কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারে। ঝিনুক ও মুক্তার এ অবহেলিত সম্পদকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সমৃদ্ধশালী করা সম্ভব। মাছের পাশাপাশি মুক্তার চাষ প্রযুক্তি উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ করা গেলে আমাদের দেশেও অন্যান্য দেশের মতো মুক্তা রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে গণ্য হতে পারে। মুক্তা রপ্তানীকরে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান হবে।
আরও পড়ুন
গ্রন্থাগার: হারানো স্বপ্নের আলোতে জ্ঞান অন্বেষণ বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা ৫ জনের জীবন কেমন ছিললেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ
কেএসকে/এমএস