দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির গতি একসময় এতটাই প্রবল ছিল যে ‘তাদের টাইগার অর্থনীতি’ বলা হতো। তবে বর্তমানে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ দেশ আর আগের মতো প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারছে না। বিশেষ করে চীনের উত্থান, মার্কিন অর্থনৈতিক নীতি ও বৈশ্বিক যোগান শৃঙ্খলে (সাপ্লাই চেইন) পরিবর্তনের ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জোট আসিয়ানের অর্থনৈতিক প্রবাহ দুর্বল হয়ে পড়েছে।
Advertisement
১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে, জাপানি ইয়েনের মূল্য বৃদ্ধি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশাল বিনিয়োগ প্রবাহ তৈরি করেছিল। সেই সময়ে মালয়েশিয়ায় মাটসুশিতা (বর্তমানে প্যানাসনিক) একাই দেশের জিডিপিতে ২-৩ শতাংশ অবদান রাখত। জাপানি অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো থাইল্যান্ডে গাড়ি তৈরি করত, আর মিতসুই ও মিতসুবিশির মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইন্দোনেশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি করত।
কিন্তু ১৯৯০-এর দশকে চীনের বিশাল উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক শিল্পকে পিছিয়ে দেয়। চীনের শহরগুলোতে বিশাল শ্রমশক্তির অভিবাসন, দেং জিয়াও পিংয়ের উন্নয়ন নীতি ও তুলনাহীন উৎপাদন সক্ষমতা অন্য কোনো দেশকে টিকে থাকার সুযোগ দেয়নি।
বর্তমানে চীনের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি দুর্বল হলেও, তারা আসিয়ান অর্থনীতির সহযোগী নয় বরং প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে। ২০০৮-০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার সময় চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে সহায়তা করেছিল, কিন্তু এখন চীন নিজেই সংকট মোকাবিলায় ব্যস্ত।
Advertisement
বিশেষ করে থাইল্যান্ডের অর্থনীতি চীনের প্রতিযোগিতার কারণে চাপে পড়েছে। দেশটি বছরে প্রায় ২০ লাখ গাড়ি উৎপাদন করত, যার ৯ লাখ অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হতো ও বাকিগুলো রপ্তানি করা হতো।
গাড়ি শিল্প একসময় থাই জিডিপির ১০-১২ শতাংশ ও মোট রপ্তানির ১১ শতাংশ অবদান রাখত। কিন্তু গত বছর এই খাতে বিক্রি ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে পৌঁছেছে। ব্যাংক অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে থাইল্যান্ডের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমছে।
ইন্দোনেশিয়ার বিশাল প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা সত্ত্বেও দেশটি কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। বেইজিংভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এমার্জিং অ্যাডভাইজরস গ্রুপের মতে, দেশটির অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার থেমে গেছে, ঋণচক্র দুর্বল হয়েছে ও বিনিয়োগের গতি মন্থর হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও বৈশ্বিক প্রভাব
Advertisement
চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতার পাশাপাশি, আসিয়ানের টাইগার অর্থনীতির পতনের আরেকটি কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরবরাহ চেইন নীতি ও উচ্চ সুদহার। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের উচ্চ সুদের হার ডলারের মূল্য ধরে রেখেছে, যার ফলে আসিয়ান অঞ্চলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে অর্থনীতিকে চাঙা করতে পারছে না। ২০২৪ সালের প্রথম চতুর্ভাগে এশিয়ার মোট রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে এবং বিনিয়োগ প্রবাহ ৬২ বিলিয়ন ডলার থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
সংবাদমাধ্যম নিক্কেই এশিয়া বলছে, যদিও বেশিরভাগ আসিয়ান অর্থনীতি তাদের পুরনো গতি হারিয়েছে, তবুও কিছু দেশ এখনো দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে।
ভিয়েতনাম: দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য ভিয়েতনাম আজ সেই ভূমিকা পালন করছে, যা একসময় মালয়েশিয়া জাপানের জন্য করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার পোশাক নির্মাতা ইয়াংওয়ান চীনের পর ভিয়েতনামে কারখানা স্থাপন করেছিল। তবে এখন সেখানে পর্যাপ্ত শ্রমিক না থাকায় তারা বাংলাদেশে কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে, যেখানে তারা ৭০,০০০ কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছে।
লাওস: একসময় বিনিয়োগের জন্য অনাকর্ষণীয় বলে বিবেচিত হওয়া লাওস এখন প্রতিবেশী দেশগুলোকে জলবিদ্যুৎ বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।
মালয়েশিয়া: সিঙ্গাপুরের নিকটবর্তী হওয়ায় মালয়েশিয়া একটি "গঠনগতভাবে ইতিবাচক উদীয়মান অর্থনীতি (EM)" হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জোহর-সিঙ্গাপুর স্পেশাল ইকোনমিক জোন মালয়েশিয়াকে চীনের বাইরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য বিকল্প বিনিয়োগ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনীতির একসময়কার প্রবল গর্জন এখন অনেকটাই স্তিমিত। চীনের অগ্রগতি, মার্কিন অর্থনৈতিক নীতি ও বৈশ্বিক চাহিদার পরিবর্তন আসিয়ান অঞ্চলের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। যদিও কিছু দেশ এখনো নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছে, তবে আসিয়ান অঞ্চলের অর্থনীতি আর একত্রে সেই বাঘের মতো শক্তি দেখাতে পারছে না।
এসএএইচ