অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, যেসব পণ্য ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে তাতে জনজীবনে কষ্ট বাড়বে না। তিনি বলেছেন, মূল্যস্ফীতির মূল নির্দেশক চাল, ডালসহ নিত্যপণ্য। তাই যেসব পণ্যে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে তাতে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না।
Advertisement
মূল্যস্ফীতির মূল নির্দেশক চাল, ডালসহ নিত্যপণ্য হলেও সম্প্রতি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর যে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে, তার মধ্যে দু-একটা জায়গায় কমানো হয়েছে এবং প্রত্যাহার করা হয়েছে। যেমন, ওষুধের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ী পর্যায়ে যেটা ছিল সেটা কমানো হয়েছে। কিছু জায়গায় ১৫ শতাংশ ছিল সেটা ১০ শতাংশ করা হয়েছে, ১০ শতাংশ থাকলে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়েছে।
এক ধরনের পণ্য দিয়ে কিন্তু মূল্যস্ফীতি নির্ধারিত হয় না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতি নিরূপণের বড় একটা পণ্য-সেবার ঝুড়ি রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ২৪২টি খাদ্যপণ্য এবং ৫০৭টি খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবা । যে পণ্য এবং সেবাগুলোর জন্য ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে সেগুলোর সিংহভাগ সাধারণ মানুষ ভোগ করে। যে ফলগুলো প্রতিদিন ভোগ করা হয় সেগুলো কিছু আসে দেশের ভিতর থেকে কিছু আসে বাইরে থেকে। কিন্তু প্রতিদিনই মানুষ কিন্তু এগুলো ফুটপাত থেকে কেনেন। আপেল, আঙ্গুর এখন কোনো বিলাস পণ্য নয়, সাধারণ মানুষের ভোগ্যপণ্য। ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর কারণে ইতোমধ্যে এগুলোর দাম তো অনেকটা বেড়ে গেছে। পাশাপাশি এই ছোট ছোট ব্যবসায়ী যারা আসলে ফুটপাতে এগুলো বিক্রি করেন, রাস্তার পাশে একটা ঝুড়ি নিয়ে বিক্রি করেন তাদের অবস্থাটা কি? এই মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের বিক্রি কমে গেছে । তাহলে একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ, অন্যদিকে এই ছোটখাটো, মাঝারি সব রকমের ব্যবসায়ের ওপরে চাপ তৈরি হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি তো কোনোভাবেই কমানো সম্ভব হচ্ছে না। তার মধ্যে এতগুলো পণ্য ও সেবার ওপর যে ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলো তাতে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, এটা সত্য। মূল্যস্ফীতি তো কেবল গরিব মানুষের জন্যই নয়, বরং নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তসহ সীমিত আয়ের মানুষের জন্যও। ট্রান্সফর্মারের ওপরে যে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হলো তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে এবং সামনের দিনগুলোতে বিদ্যুতের বিল বেড়ে যাবে। মড়ার ওপর যেন খাঁড়ার ঘা।
Advertisement
এছাড়া কতগুলো জিনিস আছে, যেমন বিস্কুট যার দাম ৫ টাকা ছিল সেটা এখন ৭ টাকা হয়ে গেছে। ২ টাকা বেড়ে যাওয়া মানে শতাংশ হিসাবে অনেক বেড়ে যাওয়া, প্রায় ৫০ শতাংশ। বিস্কুট, কেক থেকে শুরু করে যত বেকারি পণ্য আছে সবগুলোর ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। এই পণ্যগুলো নিম্ন আয়ের মানুষ সবাই ভোগ করে। রিকশা-ভ্যানওয়ালারা ক্ষুধা লাগলে রাস্তার পাশে টং দোকানের বিস্কুট বা এক পিস কেক মুখে দেন। তাদের অবস্থা কি হবে?
মূল্যস্ফীতি তো কেবল সূচকের বিষয়। এটা সাধারণ মানুষের জীবনে কষ্টকর একটা উপলব্ধি। দীর্ঘশ্বাসের আরেক নাম। বিবিএস’র একটা ভোক্তা মূল্যসূচক দিয়ে সেটাকে পুরোপুরি বোঝা অসম্ভব। আসলে এই সূচকের মান কম নাকি বেশি সেটা মূল বিষয় নয়। মূল বিষয় হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবনের কষ্ট কতটুকু সেটা নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করতে পারলেন কি না। এই কষ্ট অনুধাবন করতে না পারার যে ব্যর্থতা, সেটারই বহিঃপ্রকাশ দেখাচ্ছেন উপদেষ্টা।
মোদ্দা কথা, বিবিএস হয়তো একটা সংখ্যা দিল, সেটা দিয়ে তো আর মানুষের জীবনের কষ্ট বোঝানো যাবে না। আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাজারে আসলে যতটুকু জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে সে অনুযায়ী বিবিএস মূল্যস্ফিতি দেখাতে পারে না। ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গত কয়েক মাসে চাল ও সবজিসহ জিনিসপত্রের দাম অনেক পরিমাণে বেড়ে গেছে। শীতকালীন শাক-সবজির দাম জানুয়ারি মাসেরও মাঝামাঝি পর্যন্ত অনেক চড়া ছিল, যদিও জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে এসে শাক-সবজির দাম কমে এসেছে। কিন্তু চালের দাম যে পরিমাণে বেড়েছে তাতে মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। সুতরাং, এ বিষয়গুলো আমাদের বিবেচনা করতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনের কষ্ট যদি নীতিনির্ধারকরা উপলব্ধি করতে না পারেন সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয়।সাধারণ মানুষ কাজে কোথাও গেলে নন-এসি হোটেলে থাকেন, রেস্টুরেন্টে খাবার খান। হোটেল-রেস্টুরেন্টে কর বেড়ে গেলে তার তো ভাড়া আর খাবার খরচও বেড়ে যাচ্ছে। দর্জির দোকানে ভ্যাট বাড়লে পোশাক সেলাইয়ের খরচও বেড়ে যায়। এছাড়া সব রকমের পেইন্টের ওপর শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে গ্রামগঞ্জে বাড়ি-ঘর, দোকানপাট নির্মাণ, রিকশাসহ সব রকমের যানবাহনে রং করার খরচ বেড়ে গেলো। এখানেও মূল্যস্ফীতি।
তার মানে এই অতিরিক্ত কর-শুল্কের কারণে খাদ্য এবং খাদ্যবহির্ভূত পণ্য ও সেবার জায়গায়ই মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে বেড়ে গেছে। সুতরাং, চাল-ডালের কথা বলে মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে দিলে চলবে না। সবার কষ্ট বেড়ে যাচ্ছে সেটা স্বীকার করতে হবে। সরকারের বলতে হবে যে, তার আর কোনো উপায় ছিল না, কারণ তার বেশি রাজস্ব দরকার। গত অর্থবছরের তুলনায় রাজস্ব কম আহরিত হচ্ছে কিন্তু সরকারের খরচ বেড়ে গেছে। তো বললেই হয় যে, রাজস্ব ঘাটতি মোকাবিলার জন্য সরকারের আর কোনো পথ খোলা নেই। অতিরিক্ত খরচ নির্বাহের জন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে রাজস্ব বাড়াতে হলে ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে হবে। সত্যিটা বললে মানুষ বুঝতে পারত, আর তাদের মানসিক যন্ত্রণাও লাঘব হতো। কিন্তু বিপুল পরিমাণে পণ্য-সেবার ওপর ভ্যাট-সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি তেমন বাড়বে না এমন কথা বলে মানুষের কষ্ট অস্বীকার করার মধ্যে তো কোনো কৃতিত্ব নেই। এই বিষয়টিই আসলে আমাদের অনুধাবন করতে হবে।
Advertisement
লেখকঃ অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ।
এইচআর/এমএস