মতামত

বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব কেমন পড়বে?

হোয়াইট হাউসে পা রেখেই ছড়ি ঘোরাতে শুরু করছেন বিশ্বের ক্ষমতাধর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শপথ নেওয়ার পর থেকে মেক্সিকো এবং কানাডার পণ্যের উপর ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসিয়েছেন তিনি। তবে শুল্ক বসিয়েও আবার কয়েক দিনের মধ্যে প্রত্যাহার করলেন তিনি। অনেকটা নাটকীয় ভাবে মাত্র এক মাসের জন্য শুল্ক কমানোর বিষয়ে স্থগিতাদেশ করেছে তার প্রশাসন। কেন এই উল্টো পুরাণ?

Advertisement

মেক্সিকোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সীমানা রয়েছে। কানাডার সাথে ও রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে কানাডা ইস্যুতে প্রায়ই সরগরম দেখা যাচ্ছে ট্রাম্পকে। কখনো কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য বলে ঘোষণা কিংবা ভয় ভীতি প্রদর্শন করা এসব যেন ট্রাম্পের মামুলি কাজ হয়ে দাড়িয়েছে। ট্রাম্পের এসব হুঁশিয়ারি কি আদৌও বিবেচনায় নিচ্ছেন জাস্টিন ট্রুডো? তবে ট্রুডোর আচরণে কিন্তু সেটা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তিনি পাল্টা আমেরিকা থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর প্রতিশোধমূলক শুল্ক বসিয়েছেন। এই যেন আগাম যুদ্ধের ডঙ্কা বাজিয়েছে দুই প্রতিবেশী। তবে কি এবার সত্যি সত্যি বিশ্বে বাণিজ্য যুদ্ধ আসন্ন হচ্ছে?

ট্রাম্প যে শুধু মেক্সিকো ও কানাডাকে টার্গেট করেছে বিষয়টা কিন্তু এমন নয়। তার তালিকায় আছে চীনের মতো প্রভাবশালী দেশ ও। ট্রাম্প শি জিনপিংয়ের দেশের পণ্যের উপরও নানা হারে আমদানি শুল্ক বসিয়েছেন সুকৌশলে। যদিও এটি কিন্তু এখনো প্রত্যাহার করেনি ট্রাম্প প্রশাসন। তার ঘোষণার বিপরীতে চীন ত্বরিত প্রতিক্রিয়া স্বরূপ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা কিছু পণ্যে নতুন করে শুল্ক বসিয়েছে। কয়লা এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর ১৫ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছে চীন। তেল এবং কৃষির সরঞ্জামের উপর বসিয়েছে ১০ শতাংশ শুল্ক। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি থেকে বুঝা যায়, আমেরিকা একপাক্ষিকভাবে শুল্ক যে হারে বাড়াচ্ছে তাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম সুস্পষ্ট লঙ্ঘিত হচ্ছে এবং একটি অসম বাণিজ্যিক যুদ্ধের দিকে ধাবমান হচ্ছে।

কানাডা, মেক্সিকো, চীন ছাড়াও ট্রাম্পের তালিকায় আরো আছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলি। যদিও ট্রাম্পের প্রশাসন এসব বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে এখনো সেভাবে কিছু প্রকাশ করেনি। তবে গণমাধ্যমে এ বিষয়ে সংবাদ ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। যদিও, ট্রাম্পের এই বার্তার কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তাদের মুখপাত্র নিশ্চিত করছে যে, ইউরোপের পণ্যের উপর যদি আমেরিকা অতিরিক্ত শুল্ক চাপায় তাহলে তারাও কড়া পদক্ষেপ নিতে কালক্ষেপণ করবে না। এখন মোটামুটি এটা স্পষ্ট যে, মসনদে বসেই ট্রাম্প কার্যত ‘বাণিজ্যিক যুদ্ধের’ জিগির তুলছেন।

Advertisement

ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি:এবারের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। যেমন অভিবাসন সমস্যা, অনুদান হ্রাস করা ছাড়াও আমেরিকার বাহির থেকে আমদানি করা পণ্যের উপর শুল্ক আরোপ ইত্যাদি। যদিও অভিবাসন নীতিতে বড় চমক দিয়েছেন তিনি ইতিমধ্যে। বিশাল সংখ্যক অবৈধ অভিবাসীদেরকে আমেরিকা থেকে বের করার বন্দোবস্তো করে বাহবা পেয়েছেন। যা তার সাফল্যকে আমেরিকাবাসী উজ্জ্বল ভাবে দেখছেন। এরপর পূর্ব ঘোষিত শুল্ক আরোপ নীতি প্রয়োগ করে তিনি রীতিমতো স্টার হতে চেয়েছেন। তবে এর প্রভাব যে কতটা ভয়াবহ হবে তার দূরদর্শিতার অভাব দেখে সেটা প্রমাণ হচ্ছে। সস্তা ও অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত যে কতটা ভয়াবহ হয় তা তিনি টের পাচ্ছেন। তাইতো তিনি শুল্ক আরোপের ঘোষণার পরপরই পাল্টে ফেললেন নিজের আগের সিদ্ধান্ত।

আমেরিকার শুল্ক আরোপের কারণ?অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ফলে মার্কিন নাগরিকরা বেজায় বিপাকে পড়তে চলেছেন এটা এখন প্রকাশ্য দিবালোকের মতো সত্য। তাদের নিত্য ব্যবহার্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে অনেকটা। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, এই শুল্ক ব্যবস্থা বেআইনি অভিবাসন এবং ফেন্টানিল (মাদক) পাচার বন্ধ করতে সহায়ক হবে। পাশাপাশি, দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি ও কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্ব বাড়াতে সাহায্য করবে। এতে বর্তমান সময়ে আমেরিকানদের উপর চাপ বাড়লেও ভবিষ্যতে এর প্রভাব আসলে কি কমবে? নাকি অতিরিক্ত শুল্কের প্রভাবে দৈনন্দিন জীবন চালাতে হিমশিম খাবে? যুক্তরাষ্ট্র শুধু আমেরিকার-মেক্সিকো সীমান্তে ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করেছে মাদক কারবার রোখার জন্য। কাজে কি আসছে এই নীতি? ব্যয়সংকোচন করতে গিয়ে নাকি ব্যয় বৃদ্ধির জাঁতাকল পড়বে মার্কিন মুলুক?

শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব কেমন হবে আমেরিকায়?কানাডা ও মেক্সিকো উভয় দেশের সঙ্গেই আমেরিকার প্রচুর বাণিজ্যিক লেনদেন হয়। দুই দেশের উপরেই ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক চাপানোর ফলে আমেরিকায় ফল, সবজি, শস্য, মাংস, ইস্পাত, নির্মাণ সামগ্রী-সহ নানা জিনিসের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন স্বল্প সময়ের জন্য শুল্ক প্রত্যাহার হয়েছে কিন্তু মার্কিন স্থানীয় বাজারে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। উল্টো হু হু করে বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম। এতে যে আমেরিকানদের ভুগতে হবে, তা স্বয়ং ট্রাম্প ও মেনে নিয়েছেন। এই অবস্থায় ইউরোপ ছাড়াও অন্য কোন দেশের আমেরিকার বাণিজ্যিক যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া খুব একটা সুখকর হবে না এটা সবার জানা।

আমেরিকার শুল্ক আরোপ নিয়ে চীনের বিবৃতি:বর্তমান সময়ে ট্রাম্পের হুমকি দেখলে মনে হবে এই বুঝি বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন সংস্থার বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গের তদন্তও করতে চলেছে বেইজিং। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দুই দেশ যেভাবে শুল্ক যুদ্ধ শুরু করেছে তাতে সিঁদুরে মেঘ দেখছে ওয়াকিবহাল মহল। চীনের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে যে, আমেরিকার একতরফা শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO)-র নিয়মের পরিপন্থি। এটি চীন ও আমেরিকার অর্থনৈতিক সম্পর্ককে নষ্ট করবে। সে কারণেই আমেরিকার পণ্যের উপর পাল্টা শুল্ক আরোপের পথে হাঁটছে চীন।

Advertisement

বিশ্ব অর্থনীতিতে আমেরিকার শুল্ক আরোপের প্রভাব:যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা দিবে। আমেরিকার বাজারে যে সব পণ্য অন্য দেশ থেকে প্রবেশ করে তাদের গুণতে হবে করের বোঝা যা সরাসরি পণ্য সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করবে। তার উপরে অতিরিক্ত করের বোঝা সরাসরি পণ্য উৎপাদন ও বিপণনের ধারায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে। অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে ক্ষুদ্র উৎপাদনকারী নিঃস্ব হয়ে যাবে। পণ্য সরবরাহে দেখা দিবে নানা চ্যালেন্জ।

ট্রাম্পের এই শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ভালো চোখে দেখছে না অনেক দেশ। ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধের ডঙ্কায় উত্তর আমেরিকা ছাড়িয়ে বিশ্বের অর্থনীতিতে যে মারাত্মক অভিঘাতের হুমকিতে পড়বে তা এখন পুরোটাই দৃশ্যমান। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কাছে এই রকম শুল্ক আরোপ নিজেদের ব্যাবসা টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জও বটে। নিজেদের পণ্য আমেরিকার বাজারে বিপণন করতে সরাসরি হিমশিম খাবে উন্নত দেশগুলোর কাছে। এই রকম শুল্ক বাধা অবাধ বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করবে। স্বল্প আয়ের দেশগুলো যেখানে নানা প্রতিকূলতায় পণ্য উৎপাদন করে সেখানে এসব কর আরোপ যা পুরো শিল্পকে ধ্বংস করবে। সে দিকে আমাদের এখনই সজাগ দৃষ্টি দেওয়া উচিত।

লেখক : গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। vprashantcu@gmail.com

এইচআর/এমএস