অনিয়ম-দুর্নীতি, গ্রাহক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা বিমা কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালকরা আসতে চান বিমা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্সুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) নেতৃত্বে। আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে বিমা কোম্পানির পরিচালক থেকে শুরু করে বিনিয়োগ নীতিমালা অমান্যকারীরাও প্রার্থী হয়েছেন।
Advertisement
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জীবন বিমা খাতে দাবি পরিশোধের আর্থিক সক্ষমতা হারানো কোম্পানির পরিচালকদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হলে সরকারের বিমা খাত সংস্কার বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে অবৈধ কমিশন, অতিরিক্ত ব্যয়, ট্যারিফ রেট লঙ্ঘন এবং অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ করা বা কমিয়ে আনা বাধাগ্রস্ত হবে।
এখানে একটা ডেমোক্রেসি আছে। সেটা হলো- একটা নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে, যে কেউ এখানে প্রার্থী হতে পারেন। সদস্যরাই সিদ্ধান্ত নেবে কে নেতৃত্বে আসবেন।- কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের ভাইস চেয়ারম্যান কে এম আলমগীর
তারা বলছেন, গত ১৪ বছর ধরে একটি গোষ্ঠীর পছন্দ অনুসারেই বিআইএর কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে বিআইএ হয়ে উঠেছিল বিশেষ কিছু কোম্পানির স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার। সামগ্রিক বিমা খাতের উন্নয়নে বিআইএ কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। বছরের পর বছর ধরে কমিশন, অতিরিক্ত ব্যয়, বিনিয়োগ নীতিমালা অমান্য করার প্রবণতা বন্ধ হয়নি বিমা খাতে।
Advertisement
আবার বেশ কিছু জীবন বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে গ্রাহকের দাবি পরিশোধ না করার শত শত অভিযোগ থাকলেও তার কোনো সুরাহা হয়নি। উল্টো কোম্পানির তহবিল থেকে গ্রাহকের হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ায় অভিযুক্ত কোম্পানিগুলোর পক্ষেই দাঁড়িয়েছে বিআইএ।
এদিকে যেসব বিমা কোম্পানির বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, সেসব কোম্পানির পরিচালকরাও বলছেন, বিআইএর নেতৃত্বে দক্ষ ও স্বচ্ছ ইমেজের ব্যক্তিদের আসা উচিত। যাদের নেতৃত্বে বিমা খাত এগিয়ে যাবে এবং বিমা খাতের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যার সমাধান হবে। বিতর্কিত ব্যক্তি বা যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগ আছে, সেসব কোম্পানির প্রতিনিধি বিআইএর নেতৃত্বে আসা উচিত হবে না।
এবারের বিআইএ নির্বাচনে জীবন বিমা কোম্পানি এনআরবি ইসলামিক লাইফ ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রার্থী হয়েছেন কোম্পানিটির পরিচালক আরিফ শিকদার। প্রতিষ্ঠার তিন বছরের মধ্যেই কোম্পানিটির গ্রাহকের দাবি পরিশোধে আর্থিক সক্ষমতা হারানোর চিত্র উঠে এসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতিবেদনে।
যে মানুষগুলো নেতৃত্ব দিলে ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের অগ্রগতি হবে, তাদেরই নেতৃত্বে আসা উচিত। এখানে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আছে যেগুলো অনেকদিন ধরেই চলমান। এগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। যারা ছিলেন সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেননি।- প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাহাদত হোসেন
Advertisement
আইডিআরএর এক তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এনআরবি ইসলামিক লাইফ অনুমোদন পায় ২০২১ সালের ৬ মে। অনুমোদনের পর থেকে ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন বছরে সর্বমোট প্রিমিয়াম আয় করে ৭৮ কোটি ৭৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় করে ৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। ব্যবসার আয় থেকে ব্যয় বাদ দিলে কোম্পানিটিতে উদ্বৃত্ত থাকে ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকা।
হিসাব অনুসারে এই উদ্বৃত্ত ১৭ কোটি ৮ লাখ টাকা বিনিয়োগ থাকার কথা। অথচ আইিডআরএর মূলধন সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন অনুসারে ৩১ ডিসেম্বরে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কোম্পানিটির প্রিমিয়াম আয় থেকে বিনিয়োগ রয়েছে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। আর মোট বিনিয়োগ ১৬ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। যার মধ্যে মূলধন থেকে বিনিয়োগ ১২ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আর সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগ আছে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
কোম্পানির পেইড-আপ ক্যাপিটাল ১৮ কোটি টাকা। এই হিসেবে পেইড-আপ ক্যাপিটালের চেয়ে বিনিয়োগ কম আছে ২ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ, গ্রাহকের কাছ থেকে প্রিমিয়াম আয়ের প্রায় সব টাকাই খরচ করে ফেলেছে।
আমরা আশা করছি ডায়নামিক লিডার আসবেন। যিনি আমাদের পথপ্রদর্শক হবেন এবং বিমা খাতের যত চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সহযোগিতা করবেন। আমরা স্বচ্ছ, ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব চাই। যেসব কোম্পানিতে অনিয়ম হয়েছে সেসব কোম্পানিতে জড়িত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আসা উচিত হবে না।- রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক মোস্তফা কামরুস সোবহান
আইডিআরএর তদন্তে উঠে এসেছে, প্রতিষ্ঠার পর কোম্পানি পরিচালনার জন্য মূলধন থেকে তোলা হয় চার কোটি টাকা। এই টাকা এখনো পুনর্ভরণ করতে পারেনি। অপরদিকে ২০২১ সালে বিদেশে অফিস স্থাপন ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য মূলধন থেকে তোলা হয় আরও তিন কোটি টাকা। এনআরবি ইসলামিক লাইফের মূলধন সংক্রান্ত এ তদন্তটি করা হয় গত ডিসেম্বরে।
আরও পড়ুন হোমল্যান্ড লাইফ এখন যেন ‘হায় হায় কোম্পানি’ সোনালী লাইফের ৩৫৩ কোটি তছরুপ, কুদ্দুসের পকেটেই ১৮৪ কোটি টাকা বাবা-মেয়ের লুটপাটের শিকার সোনালী লাইফের ভবিষ্যৎ কী? জাল শিক্ষা সনদে দুই বিমা কোম্পানির সিইও পদে নিয়োগ চুক্তিআইডিআরএ দাখিল করা ব্যবসা সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এনআরবি ইসলামিক লাইফ প্রতিষ্ঠার পর তিন বছরেই ব্যবস্থাপনা খাতে আইন লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় করেছে।
বিমা খাতের আলোচিত আরেক কোম্পানি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ। সীমাহীন অনিয়মের কারণে সংকটে নিমজ্জিত হওয়া এ জীবন বিমা কোম্পানি থেকে দুই হাজার ৮শ কোটি টাকার তহবিল তসরুফ হয়। তছরুপের এই তথ্য উঠে আসে আইডিআরএর তদন্তে। এ আত্মসাতে জড়িত কোম্পানির সাবেক চেয়ারম্যান, পরিচালক, মুখ্য নির্বাহী এবং বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। একই সঙ্গে ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পক্ষ থেকেও অর্থ আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়।
এ ঘটনায় ফারইস্ট ইসলামী লাইফের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম এবং পরিচালক এম এ খালেক জেল-হাজতেও যান। দফায় দফায় পরিবর্তন আসে পরিচালনা পর্ষদে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পর নতুন করে গঠন করা হয় ফারইস্ট ইসলামী লাইফের পরিচালনা পর্ষদ। কোম্পানিটির নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন ফখরুল ইসলাম। এস আলমের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত ফখরুল এর আগে এস আলমের মালিকানাধীন কোম্পানি পদ্মা ইসলামী লাইফের চেয়ারম্যান হিসেবে ছিলেন। এবারের বিআইএর নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন তিনিও।
পদ্মা ইসলামী লাইফে দায়িত্ব পালনের সময় শত শত গ্রাহকের বিমা দাবি বকেয়া থেকে গেছে। কোম্পানিটির ভুক্তভোগী গ্রাহকরা আইডিআরএর কাছে অভিযোগ দাখিল এবং আদালতে মামলা দায়ের করেও টাকা পাচ্ছেন না। গত ৫ আগস্টের পর ফারইস্ট ইসলামী লাইফের গ্রাহক, কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের দাবির মুখে সাবেক পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন পদত্যাগ করেন। নতুন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হন ফখরুল ইসলাম।
ফারইস্ট ইসলামী লাইফের তহবিল থেকে তছরুপ করা টাকা উদ্ধারে যথাযথ পদেক্ষপ যেমন তিনি নিতে পারেননি, তেমনি গ্রাহকের ভাগ্যেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে বিমা আইন এবং বিএসইসির নীতিমালা লঙ্ঘন করেই তিনি পরিচালক এবং চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
এবারের বিআইএ নির্বাচনে সাধারণ বিমা খাতের রূপালী ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রার্থী হয়েছেন কোম্পানিটির পরিচালক মোস্তফা কামরুস সোবহান। তিনি সোনালী লাইফেরও পরিচালক এবং ড্রাগন সোয়েটারের সিইও। সোনালী লাইফের চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্ত করে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিএফআইইউ থেকে আইডিআরএর কাছে এ সংক্রান্ত একটি তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়। এই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সোনালী লাইফের ৩৫৩ কোটি টাকা তছরুপের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কোম্পানিটির সাবেক চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানসহ ৮ পরিচালক, ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহী ও অপর দুই কর্মকর্তা। এছাড়াও কোম্পানিটির ভারপ্রাপ্ত মুখ্য নির্বাহীর এক ভাই ও ফুপুর নাম উঠে এসেছে তহবিল তছরুপে জড়িত ব্যক্তিদের তালিকায়। এই আটজনের মধ্যে মোস্তফা কামরুস সোবহান একজন।
সোনালী লাইফ থেকে মোস্তফা কামরুস সোবহানের ৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা আত্মসাৎ করার তথ্য উঠে আসে বিএফআইইউর তদন্তে। এছাড়াও ভ্রমণ ও বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়ে মোস্তফা কামরুস সোবহানের মেয়েকে দেওয়া হয় ২৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
ড্রাগন সোয়েটার বাংলাদেশ লিমিটেডের সিইও হিসেবেও রয়েছেন মোস্তফা কামরুস সোবহান। বিএফআইইউর প্রতিবেদন অনুসারে, সোনালী লাইফের তহবিল থেকে ২৩ কোটি টাকা নিয়ে ড্রাগন সোয়েটারের ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে।
বিএফআইইউর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে সোনালী লাইফের পরিশোধিত মূলধন ১৮ কোটি টাকা থেকে ১০ কোটি টাকা বাড়িয়ে ২৮ কোটি টাকা করার অনুমোদন দেয় পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। উদ্যোক্তা পরিচালকদের এই টাকা পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা না করে সোনালী লাইফের সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার ব্যাংকের এসওডি অ্যাকাউন্ট থেকে ৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ও ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা নগদে উত্তোলন করে ১০ জন পরিচালকের নামে শেয়ারের মূল্য পরিশোধ বাবদ পে-অর্ডার ইস্যু করা হয়। এই ১০ পরিচালকের একজন মোস্তফা কামরুস সোবহানের স্ত্রী সাফিয়া সোবহান চৌধুরী।
অতিরিক্ত ব্যয়, অবৈধ কমিশন, ভুয়া বেতন-ভাতা দেওয়ার অভিযোগসহ লোকসান গোপন করার অভিযোগ রয়েছে সাধারণ বিমা কোম্পানি প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে। বিআইএর নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন এই কোম্পানিটির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ শাহাদত হোসেন। ২০২৪ সালের এপ্রিলে বিমা কোম্পানিটিতে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে আইডিআরএর তদন্ত দল।
এ তদন্তে উঠে আসে, ২০২১ সালে ৪০০-এর বেশি নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে। ফলে বছরের ব্যবধানে কোম্পানিটির বেতন-ভাতা খাতে খরচ বেড়ে যায় দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা। বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেতন-ভাতা খাতে কোম্পানিটির খরচ হয় ৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ২২৩ টাকা। আর চার শতাধিক নতুন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার ফলে ডিসেম্বর মাসে এ খাতে ব্যয় হয় দুই কোটি ৯৫ লাখ ৩২ হাজার ৮০৫ টাকা। খরচ বাড়ার হার ৪৩৩ শতাংশ।
তদন্তে আরও উঠে আসে, এক বছরেই প্রাইম ইন্স্যুরেন্স ব্যবস্থাপনা খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করেছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। এই অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশই খরচ হয় বেতন-ভাতা খাতে। ব্যবস্থাপনা ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণী বিধিমালা লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত ব্যয় করায় প্রাইম ইন্স্যুরেন্সকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করে আইডিআরএ।
ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল মাহমুদও প্রার্থী হয়েছেন বিআইএ নির্বাচনে। সাধারণ বিমা খাতের এই কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রিমিয়াম আয়ের তথ্য গোপন, অতিরিক্ত ব্যয়, ট্যারিফ রেট লঙ্ঘন, অতিরিক্ত কমিশন দেওয়া, ভ্যাট ফাঁকি, বাকিতে ব্যবসাসহ বিমা আইন লঙ্ঘনের নানান অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় ২০২২ সালে ক্রিস্টাল ইন্স্যুরেন্সকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানাও করে বিমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
বিআইএ নির্বাচনের আরেক প্রার্থী কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের ভাইস-চেয়ারম্যান কে এম আলমগীর। এই সাধারণ বিমা কোম্পানিটি সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিয়ম করার পাশাপাশি সিইও নিয়োগেও অনিয়ম করেছে। আইডিআরএর সর্বশেষ বিনিয়োগ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৬৫ কেটি ৮৮ লাখ টাকা। তবে সরকারি সিকিউরিটিজ বন্ডে কোম্পানিটি বিনিয়োগ করেছে দুই কোটি ৫০ লাখ টাকা। যা বিমা কোম্পানিটির মোট বিনিয়োগের ২ দশমিক ০২ শতাংশ। এক্ষেত্রে কোম্পানিটি নন-লাইফ বিমাকারীর সম্পদ বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ প্রবিধানমালা লঙ্ঘন করে সরকারি সিকিউরিটিজে ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম বিনিয়োগ করেছে।
এদিকে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার পদ শূন্য থাকায় সম্প্রতি কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সকে পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করেছে আইডিআরএ। একইসঙ্গে কোম্পানিটিকে আগামী ৬০ দিনের মধ্যে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিমা আইন ২০১০ এর ১৩০ ধারা মোতাবেক এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ।
বাকিতে ব্যবসা করার পাশাপাশি পুনঃবিমা ও কমিশনের ক্ষেত্রেও অনিয়ম করেছে কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবার পর্যন্ত কোম্পানিটির বিভিন্ন শাখা পরিদর্শন করে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে এ অনিয়মের তথ্য পায় আইডিআরএ। এজন্য কোম্পানিটিকে ১১ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
দারুল ইহসানের বিতর্কিত বিবিএ এবং এমবিএ সনদ দিয়ে রূপালী লাইফের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ গোলাম কিবরিয়াও প্রার্থী। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান সন্দীপের এমপি মাহফুজুর রহমান মিতা বর্তমানে আত্মগোপনে।
কে কী বলছেনকন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের ভাইস চেয়ারম্যান কে এম আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য বিমা কোম্পানির যেসব সমস্যা রয়েছে সেগুলোর সুষ্ঠু সমাধান হোক। নেতৃত্ব যদি ভালো থাকে তাহলে যে কোনো সংগঠন খুব ভালো ভূমিকা রাখে। প্রতিটি সেক্টরেই বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রয়োজন। ১৫ বছর ধরে একটা গ্রুপ এটা (বিআইএ) নিয়ন্ত্রণ করেছে। সেখানে শত শত সমস্যা পুঞ্জিভূত হয়েছে। সেগুলো তো সুরাহা হয়নি। কখনো বছরে একবার মিটিং ডাকতো। সেখানে খুচরা আলাপ হতো, গঠনমূলক কোনো আলোচনা হয়নি।’
যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে সেসব কোম্পানির প্রতিনিধি নেতৃত্বে আসলে সংগঠনের জন্য ভালো হবে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘এখানে একটা ডেমোক্রেসি আছে। সেটা হলো- একটা নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে, যে কেউ এখানে প্রার্থী হতে পারেন। সদস্যরাই সিদ্ধান্ত নেবে কে নেতৃত্বে আসবেন।’
আপনাদের কোম্পানিতে সিইও নিয়োগে অনিয়মের পাশাপাশি বিনিয়োগসহ বিভিন্ন অনিয়ম হয়েছে। এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘অনেক কিছুই তো আইন অনুযায়ী করা যায় না। ৬০ শতাংশ ডিসকাউন্ট (কমিশন) দেয় কীভাবে? কোন আইনে? টিকে থাকার জন্য অনেক কিছুই কনসিডার (বিবেচনা) করতে হয়।’
বিআইএতে কী ধরনে নেতৃত্ব চান- এমন প্রশ্ন রাখা হয় প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাহাদত হোসেনের কাছে। উত্তরে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘যে মানুষগুলো নেতৃত্ব দিলে ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের অগ্রগতি হবে, তাদেরই নেতৃত্বে আসা উচিত। এখানে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা আছে যেগুলো অনেকদিন ধরেই চলমান। এগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি। যারা ছিলেন সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পারেননি।’
যেসব কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে তাদের প্রতিনিধি বিআইএর নেতৃত্ব আসা উচিত কি না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি এ ধরনের ব্যক্তিদের আসা উচিত না। এখানে এমন ব্যক্তিদের আসা উচিত যারা সরকারের নীতির সঙ্গে কমপ্লায়েন্স করে ব্যবসা করতে পারবে।’
আইডিআরএর প্রতিবেদনে আপনাদের কোম্পানির বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য উঠে এসেছে। আইডিআরএ আপনাদের কোম্পানিকে জরিমানাও করেছে। এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘কিছুদিন আগে আইডিআরএ জরিমানা করেছে। আইডিআরএর সার্কুলার যখন এসেছে তার আগেই আমরা সেগুলো কমপ্লায়েন্স করেছি। আমার কমপ্লায়েন্স নেওয়ার পরে যে সার্কুলার এসেছে তা কীভাবে আমি অ্যাডপ্ট (মানিয়ে নেওয়া) করবো। এ বিষয়ে আমরা আইডিআরএকে চিঠি দিয়েছি। সেখানে উল্লেখ করেছি- আপনারা যে সার্কুলার দিয়েছেন আমাদের ব্যবসার পলিসিগুলো তার আগেই হয়েছে। এখন আপনারা যে নিয়ম-নীতি দিয়েছেন সেগুলো মেনে আমরা ব্যবসা করবো।’
রূপালী ইন্স্যুরেন্সের পরিচালক মোস্তফা কামরুস সোবহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি ডায়নামিক লিডার আসবেন। যিনি আমাদের পথপ্রদর্শক হবেন এবং বিমা খাতের যত চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলো মোকাবিলা করার জন্য আমাদের সহযোগিতা করবেন। আমরা স্বচ্ছ, ক্লিন ইমেজের নেতৃত্ব চাই। যেসব কোম্পানিতে অনিয়ম হয়েছে সেসব কোম্পানিতে জড়িত ব্যক্তিদের নেতৃত্বে আসা উচিত হবে না।’
এসময় তাকে প্রশ্ন করা হয় আপনি সোনালী লাইফের পরিচালক ছিলেন, এই কোম্পানির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি রূপালী ইন্স্যুরেন্স থেকে প্রার্থী হয়েছি। রূপালী ইন্স্যুরেন্সের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।’
আপনি এবং আপনার স্ত্রীও সোনালী লাইফে ছিলেন। জাগো নিউজের পক্ষ থেকে এমন কথা বলা হলে তিনি বলেন, ‘আমি সোনালী লাইফে নেই। আমার স্ত্রী সোনালীতে আছেন, কথাটা ঠিক না। আমরা কেউ সোনালী লাইফে নেই। আমরা সবাই পদত্যাগ করেছি।’
এমএএস/এএসএ/জিকেএস