ফিচার

গ্রিন হাউস ইফেক্ট থেকে বাঁচার উপায়

ড. ফোরকান আলী

Advertisement

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানবসভ্যতার অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে। বিজ্ঞানের বৈচিত্র্যপূর্ণ বিস্ময়কর অবদানে মানবজাতি একদিকে যেমন সভ্যতার স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে, অন্যদিকে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া মানবজাতিকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে। প্রাকৃতিক সম্পদে বিনাশ সাধনের ফলে পৃথিবী চরম দুর্দিনের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের ফলে বেড়ে যচ্ছে হাউস ইফেক্ট। মূলত গ্রিণ হাউস ইফেক্ট পরিবেশ দূষণের এমন এক বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া যা বিশ্ববাসীকে এক নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়েছে। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলেছে তার ভারসাম্য ও স্বাভাবিক গতি।

গ্রিণ হাউস কী?

ইংরেজি গ্রিণ হাউজ শব্দের অর্থ সবুজ ঘর। পৃথিবীর কিছু মেরু অঞ্চলে সূর্যালোকের স্বল্পতার কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় শাক-সবজির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীগণ বিশেষ ধরনের কাচের ঘর উদ্ভাবন করেন, যার ভেতরে চাষাবাদ সম্ভব। এ ঘরের ছাদ ও দেয়াল তাপ বিকিরণরোধী বিশেষ ধরনের কাচ দিয়ে তৈরি। গ্রীষ্মকালে এ ঘরে সূর্যালোক ও উত্তাপ প্রবেশ করে কিন্তু বিকিরণ না ঘটায়, তাপ বের হতে পারে না এবং এর ভেতরের পরিবেশ উত্তপ্ত থাকে। তাই সঞ্চিত সূর্যতাপে বৈরী ও শীতার্থ পরিবেশেও শাক-সবজি উৎপাদন করা সম্ভব হয়। বিজ্ঞানীরা এ বিশেষ ঘরের নাম দিয়েছেন গ্রিণ হাউস।

গ্রিণ হাউস ইফেক্ট কী?

পৃথিবীকে ঘিরে এর চারপাশে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত রয়েছে ওজোনস্তর। যার ঘনত্ব সব জায়গায় এক রকম নয়। ২৩ কিলোমিটার উর্ধ্বে এর ঘনত্ব অপেক্ষাকৃত কম। এখানে রয়েছে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও অপর কয়েকটি গ্যাসের বেষ্টনী। এ গ্যাসগুলোকে একত্রে গ্রিণ হাউস গ্যাস বলা হয়। এ গ্যাসের বেষ্টনী রাসায়নিক পর্দা হিসেবে কাজ কর। গ্রিণ হাউসের কাচের দেয়াল যেভাবে তার ভেতরের উষ্ণতাকে বাইরে বিকিরণ হতে বাধা সৃষ্টি করে, টিক তেমনিভাবে বায়ুমন্ডলে সৃষ্ট রাসায়নিক পর্দা বা গ্যাসের দেয়াল ভূ-পৃষ্ঠের শোষিত তাপের বিকিরণ ঘটাতে বাঁধা দেয়। গ্যাসের এ দেয়াল আছে বলেই কিছু পরিমাণ তাপ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পৃথিবীতে থেকে যায় এবং এর প্রভাবে বায়ুমন্ডল উষ্ণ থাকে। ফলে পৃথিবীতে যে উষ্ণতা থাকে তা জীবের পক্ষে বাসযোগ্য হয়। জীবের বসবাসের অনুকূল এরূপ পরিস্থিতিকে বলা হয় গ্রিণ হাউস ইফেক্ট।

Advertisement

গ্রিণ হাউস ইফেক্ট-এর কারণ

পৃথিবী বেষ্টনকারী বায়ুমন্ডলের কারণে পৃথিবী বাসোপযোগী হয়েছে। মহাশূণ্যের আবহাওয়ামন্ডলে ওজোনস্তর নামে অদৃশ্য এক বেষ্টনী বিদ্যমান। এ ওজোন স্তর পৃথিবীতে সূর্যের ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মির প্রবেশ রোধ করে এবং বিকিরণ প্রক্রিয়ায় পৃথিবী থেকে আসা তাপ মহাশূণ্যে পুনরায় ফিরে যেতে সহায়তা করে। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন দূষণের ফলে প্রকৃতির এ প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বেষ্টনি ওজোন স্তর প্রতিনিয়ত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। গৃহস্থালী পণ্য ফ্রিজ, এয়ারকন্ডিশনার, বিভিন্ন ধরনের স্প্রে ইত্যাদিতে ব্যবহৃত হয় ক্লোরোফ্লোরো কার্বন বা সিএফসি গ্যাস। শিল্প কারখানাতেও এ ক্ষতিকর গ্যাস ব্যবহৃত হয়। অবমুক্ত সিএফসি মহাশূন্যের ওজোন স্তর ক্ষয়কারী অন্যতম উপাদান।

তাছাড়া গৃহস্থালি ও শিল্পবর্জ্য, কলকারখানা ও যানাহনের ধোঁয়া থেকে ক্রমবর্ধমান হারে নির্গত হচ্ছে কার্বন ডই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতি গ্যাস। বায়ুমন্ডলে এসব গ্যাসের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে তাপ বিকিরণে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এবং সূর্য থেকে আগত কিছু তাপ পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে ধরে রাখে। এভাবে একদিকে ওজোন স্তরের ক্ষয়জনিত কারণে মাত্রাতিরিক্ত সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে পৌঁছাচ্ছে, অন্যদিকে বায়ুমন্ডলে প্রতিনিয়ত তাপ সঞ্চিত হচ্ছে। ফলে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। গ্রিণ হাউজ ইফেক্ট-এর আর একটি অন্যতম প্রধান কারণ বনভূমি উজাড়করণ। বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার ফলে বৃক্ষ কর্তৃক কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণের হারও আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে। ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রাও ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে যা গ্রিণ হাউস ইফেক্টের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটছে।

বাংলাদেশের প্রভাব

গ্রিণ হাউস ইফেক্ট শুধু বাংলাদেশ নয় বরং সমগ্র বিশ্বের জন্যই এক ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে। এটা প্রকৃতির ওপর এমন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। যার ফলে বাস্তুসংস্থান হয়ে পড়ছে বিপর্যস্ত। পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা ১.৭৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বর্তমানে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৪.৫ সেলসিয়াসে। পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ আশঙ্কা করছেন আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে ১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা গ্রিণ হাউস ইফেক্টের কারণে বাড়ার প্রভাবে এরই মধ্যে মেরু অঞ্চলে কোটি কোটি বছর ধরে জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে পর্বতশৃঙ্গে জমে থাকা বরফও গলতে শুরু করেছে। বরফ গলা এ পানি নদী পথে প্রবাহিত হয়ে নেমে আসছে সমুদ্রে। এভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। যা বাংলাদেশসহ অন্যান্য সমতল ভূমিরক্ষা দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে। বিজ্ঞানীগণ আশঙ্কা করছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত হারে বৃদ্ধি পেতে থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ মালদ্বীপ প্রভৃতি দেশের মতো সমতল দেশগুলোর বিশাল অঞ্চল পানির নিচে চিরতরে তলিয়ে যাবে।

এছাড়া সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির কারণ ত্বক-ক্যান্সারসহ অন্ধত্ব ও বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হবে মানবজাতি। প্রচন্ড উত্তাপের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন বনাঞ্চলে দাবানল সৃষ্টি হবে। সমুদ্রের স্রোত পরিবর্তিত হবে। সবুজ-শ্যামল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মরুকরন প্রক্রিয়া শুরু হবে। অতি বন্যা, খরা, এসিডবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস পৃথিবীবাসীর জীবন ও জীবিকা বিপন্ন করে তুলবে। এভাবে গ্রিণ হাউস প্রতিক্রিয়া বিশ্বকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করবে।

Advertisement

বাংলাদেশ গ্রিণ হাউস ইফেক্টের ক্ষতিকর প্রভাব

১. গ্রিণ হাউস ইফেক্টের একটি সম্ভাব্য পরিণতি হলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি। ফলে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে এবং পানি সম্প্রসারিত হয়ে পানির আয়তন ও পরিধিকে বাড়িয়ে তুলবে। এছাড়া উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলতে শুরু করবে, যা ক্রমাগতভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি করবে।

বাংলাদেশ প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৭ মি. মি. কিন্তু এ তুলনায় ভূ-পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৫-৬ মি. মি./বছর। অর্থাৎ প্রতিবছর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ ১-২ মি. মি./বছর। সমুদ্র থেকে ৯০ কি. মি. দূরে অবস্থিত বরিশাল জেলার সমুদ্রসীমা থেকে ৩ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। তাই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা যদি বছরে ৩ মি. মি. বৃদ্ধি পায় তবে এক হাজার বছর পরে বরিশাল শহর সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাবে। এরমধ্যে কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর ধলঘাটা ইউনিয়নের ‘সরইতলা গ্রাম’ ও কুতুবদিয়ার ‘খোদিয়ার’ টেক এর কিছু অংশ বঙ্গোপসাগরে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য উপকূলবর্তী দ্বীপ ও এলাকাসমূহ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ সুন্দরবনের অস্তিত্বও হুমকির সম্মুখীন পড়বে।

২. ভূ-পৃষ্টের নিচু এলাকায় প্লাবন

গ্রিণ হাউস প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে বায়ুমন্ডল ও ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণতা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে। যার প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে এবং উপকূলীয় দ্বীপ শহর ও বনাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে অচিরেই বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। এর ফলে বাংলাদেশের প্রায় ১ লাখ ২০হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্লাবনজনিত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এমনকি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশের মোট ভূ-ভাগের ১৭ শতাংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। যার ফলে দেশের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সে সাথে বাড়তে থাকবে বিপন্ন মানুষের সংখ্যা।

৩. অতিবৃষ্টি

গ্রিণ হাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে জলবায়ুতে পরিবর্তন আসবে। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে বাংলাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়বে। এতে বর্ষাকালে নদ-নদীর পানি প্রবাহের মাত্রা বেড়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এরই মধ্যে আমাদের দেশে বৃষ্টিপাত প্রায় সব ঋতুতেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। একারণে ভূ-পৃষ্ঠের নিম্ন এলাকাসমূহে বন্যা তীব্র আকার ধারণ করবে। এছাড়া অতিমাত্রায় পানি প্রবাহের ফলে দেশে নদী তীরবর্তী এলাকাসমূহে নদী ভাঙনের মাত্রা বেড়ে যাবে।

৪. প্রাকৃতিক সম্পদের ধ্বংশ সাধন

গ্রিণ হাউস ইফেক্টের ক্ষতিকর প্রভাবে আমাদের অতি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এর প্রভাবে সুন্দরবনসহ অন্যান্য বনভূমির ভবিষ্যৎ হুমকির সম্মুখীন। পরিবেশ ও ভূবিজ্ঞানীদের মতে সমুদ্রের পানির উচ্চতা মাত্র ১ মিটার বা ৩.৩৩ ফুট বৃদ্ধি পেলে সুন্দরবনের প্রায় ৭০ শতাংশ তলিয়ে যাবে। এর প্রভাবে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ভয়াবহ। দেশের বনজ সম্পদ বিনষ্ট হবে এবং বিভিন্ন দুর্লভ প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটবে। যার প্রভাবে বাস্তুসংস্থান এবং বস্তুসংস্থান তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের মাত্রা আরও ঘনীভূত হবে।

৫. লবণাক্ততার বিস্তৃতি

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করে। আইপিসিসির সমীক্ষানুযায়ী, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১০০ সেমি বৃদ্ধি পেলে ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় লোনা পানি অনুপ্রবেশ ঘটবে। ফলে দেশের প্রায় ৩ কোটি ৫০ লাখ লোকের জীবন ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রস্ফীতির কারণে খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা প্রভৃতি জেলার কৃষি জমিতে সহজেই লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ঘটছে। ফলে এসব জেলার আবাদি কৃষি জমি কৃষি কাজের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। মানুষের ব্যবহার্য স্বাদু পানির উৎস বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

৬. মরুভূমির বৈশিষ্ট্য

গ্রিণ হাউস ইফেক্টের ফলে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, সেইসঙ্গে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বেড়ে যাবে। যার প্রভাবে মাটিতে প্রয়োজনীয় পানির পরিমাণ কমে যাবে এবং সমগ্র ভূমি মরুভূমিতে পরিণত হবে। দেশের উত্তরাঞ্চলে এরই মধ্যে মরুভূমির বৈশিষ্ট্য দেখা দিয়েছে। এর ফলে ফসল উৎপাদন মরাত্মকভাবে ব্যহত হবে। বর্তমানে বাংলাদেশে শীত মৌসুমে প্রায় ৩৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা খরার কবলে পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে খরার ব্যাপ্তি আরও বাড়বে এবং খরাকবলিত এলাকা ভবিষ্যতে ২২ হাজার বর্গ কিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে। তাছাড়া আমন মৌসুমে খরার প্রকোপ বাড়লে মাঝারি ধরনের খরাকবলিত এলাকা চরম খরাকবলিত এলাকায় পরিণত হবে। গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বর্ষা মৌসুমের ফসলের ওপর খরার প্রতিকুল প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তিত হলে দেশের মধ্য দক্ষিণ ও দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে আবাদ অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং আলুর চাষও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। প্রয়োজনীয় সেচের অভাবে দেশের উত্তর-পশ্চিম ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে চাষাবাদ ব্যাপকভাবে ব্যাহত হবে।

৭. এসিড বৃষ্টি

গ্রিণ হাউস ইফেক্টের ফলে বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাসের মাত্রা ও পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব ক্ষতিকর অক্সাইডসমূহ বৃষ্টির পানির সঙ্গে এসিড বৃষ্টি হিসেবে ভূপৃষ্ঠে পড়বে। যার ফলে ভূপৃষ্ঠের উর্বরতা আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পাবে এবং বনাঞ্চলে এসিড বৃষ্টি হলে বনাঞ্চল ধ্বংশ হবে এবং বিভিন্ন প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটবে।

৮. ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ বৃদ্ধি

গ্রিণ হাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে সাগর উত্তাল হয়ে উঠছে। নিম্নচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরপরে অতি বন্যা ও দীর্ঘমেয়াদি বন্যা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় প্রাদুর্ভাব ঘনঘন পরিলক্ষিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন বন্যায় বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলা সমূহের বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠীর সলিল সমাধি ঘটেছে। সেই সঙ্গে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদেরও বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সাধারণত সামুদ্রিক ঝড়ের সৃষ্টি হয় উত্তপ্ত বায়ু ও ঘূর্ণিবায়ু থেকে। পানির উত্তাপ বৃদ্ধিই ঘূর্ণিঝড়ের অন্যতম প্রধান কারণ। তাই গ্রিণ হাউস ইফেক্টই এসব ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের জন্য অনেক দায়ী।

৯. আবহাওয়া বিপর্যয়

গ্রিণ হাউস প্রতিক্রিয়ার ফলে দেশের উত্তরাঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। ফলে বিশাল এলাকা ভবিষ্যতে অনুর্বর, নিষ্ফলা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চিরাচরিত ঋতুচক্র ভেঙে যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে অতি শীত ও গ্রীষ্মের দম্ভ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ইতিহাস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ক্রমশ নাতিশীতোষ্ণ মন্ডলের এ দেশটির আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠছে যা কৃষিসহ আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

গ্রিণ হাউস ইফেক্ট প্রতিকারের উপায়

গ্রিণ হাউস ইফেক্ট শুধু বালাদেশ নয় বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য এক ভয়াবহ সংকট। এ বিপর্যয় রোধে আমাদের যেসব বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো-

১. বনায়ন কর্মসূচী হাতে নিতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বনায়ন বাড়াতে হবে। উপকূলবর্তী জেলাসমূহে অধিক হারে বৃক্ষরোপন করতে হবে। কারণ একমাত্র বৃক্ষই প্রকৃতি থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস শোষণ করে।২. বৃক্ষ নিধন রোধ করতে হবে। বৃক্ষ ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের তীব্রতা কমিয়ে আনে এবং প্রকৃতিকে অক্সিজেন দিয়ে বিশুদ্ধ রাখে।৩. যেসব গ্যাস বায়ুমন্ডলের উত্তাপ বাড়ায় তাদের নির্গমন রোধ করতে হবে।৪. গ্যাসের চুলা ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি অকারণে খেলা রাখা যাবে না। অপচয় রোধ করতে হবে।৫. পরিবেশ বান্ধব জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে হবে।৬. শিল্পকারখানায় জ্বালানির সাশ্রয় করতে হবে।৭. পচা, ডোবা ও মজা পুকুরে মাছ চাষ করতে হবে। কারণ পচা পানিতে মিথেন গ্যাস উৎপন্ন হয়।৮. চাষাবাদ পদ্ধতির পরিবর্তন আনতে হবে।৯. শিল্পবর্জ্য পুনরায় বিশুদ্ধকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে।১০. দূষণ রোধে সরকার ও দেশের সব শ্রেণির মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।গ্রিন হাউস ইফেক্ট একটি বৈশ্বিক সংকট। বাংলাদেশ এ প্রতিক্রিয়ার অসহায় শিকার। ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূ-প্রাকৃতিক অবকাঠামো বাংলাদেশকে যতখানি এ সংকটের কুফলভোগী করেছে, সংকট সৃষ্টিতে আমাদের দেশের ভূমিকা তার চেয়ে নগণ্যই বটে। বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র একটি দেশের জন্য এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা ও সামর্থ্য খুবই সীমিত। এ সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখেই কৌশলগতভাবে অগ্রসর হতে হবে, যাতে দীর্ঘকালীন প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করা যায়।

আরও পড়ুন সবচেয়ে দুর্গন্ধময় যেসব জিনিস স্থান পেয়েছে গিনেস রেকর্ডে ৮৭ সন্তানের বাবা এক কৃষক, গড়েছেন বিশ্বরেকর্ড 

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ

কেএসকে/জিকেএস