নারায়নগঞ্জে বেসরকারি পাঠাগারের মধ্যে অন্যতম ‘সুধীজন পাঠাগার’। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ যুগেরও বেশি সময় ধরে এ পাঠাগার জেলায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ পেসক্লাবসংলগ্ন একটি ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত পাঠাগারটিতে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজার বইয়ের সমাহার।
Advertisement
প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে শুরু করে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এখান থেকে জ্ঞান আহরণ করেন। বই পড়ার সুযোগের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমেও সম্পৃক্ততা পাঠাগারটির। শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে।
পাঠাগারের সদস্যরা জানান, কোনো পাঠক চাহিদা অনুযায়ী বই না পেলে পরবর্তীতে বই ক্রয় হলেও তাকে পড়ার সুযোগ করে দেয় পাঠাগার কর্তৃপক্ষ। অন্যথায় পাঠককে বই কিনে আনতে বলা হয়। পরবর্তীতে তাকে পাঠাগার থেকে সে টাকা পরিশোধ করা হয়।
পাঠাগার কর্তৃপক্ষ জানায়, সুধীজন পাঠাগারের সদস্য হতে শিক্ষার্থীদেরকে বাৎসরিক ১২০ টাকা এবং অন্যদেরকে ১৮০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। পরিচালকদের চাঁদা দিতে হয় এক হাজার টাকা। তবে সদস্যরা ছাড়াও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ পাঠাগারে বসে পত্রিকা এবং বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন পড়ার পান।
Advertisement
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, সুধীজন পাঠাগারের ৬১ বছরের যাত্রা মসৃণ ছিল না। ১৯৬৪ সালে স্বল্প পুঁজি নিয়ে শহরের আমলাপাড়া এলাকার ১৬ হরকান্ত ব্যনার্জী রোডের রহমত উল্লাহ হাজীর মালিকানাধীন রজনী নিবাসের একটি ছোট্ট ঘরে শুরু হয় পাঠাগারের পথচলা। তখন পাঠাগারের সম্বল বলতে ছিল কেবল ১০টি বই, একটি আলমারি, একটি টেবিল, ১০টি চেয়ার এবং দুটি হারিকেন।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের কো-অপারেটিভ ভবনে স্থানান্তরিত করা হয় পাঠাগারটিকে। তবে সেখানে পাঠাগারটির কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হচ্ছিল না। এরপর নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান প্রয়াত আলী আহম্মদ চুনকা, তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক এ এফ এম ইমাম হোসেন ও ঢাকা জেলা প্রশাসক এ এম এম শওকত আলীর সহযোগিতায় ১৯৭৮ সালে পৌরসভার লিজে প্রদত্ত জমিতে নিজস্ব একতলা ভবনে স্থানান্তরিত হয় পাঠাগারটি।
তবে স্থায়ী জায়গা ও ভবন নির্মাণের পরও আর্থিক সমস্যা থেকেই যায়। ড. এম এম শওকত আলী তখন সবেমাত্র বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তার সমর্থনে পাঠাগারের একতলা ও দোতলার তিন বৎসরের ভাড়া সুদহীন অগ্রিম প্রদানে সম্মত হয় কৃষি ব্যাংক।
১৯৮৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর নিচতলা এবং ১৯৮৭ সালের ১ জানুয়ারি দ্বিতীয় তলা কৃষি ব্যাংকের কাছে ভাড়ার শর্তে হস্তান্তর করা হয়। এরপর ১৯৮৭ সালের ২৬ এপ্রিল ভবনের তৃতীয় তলায় পাঠাগারের কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি পাঠাগারকে।
Advertisement
পাঠাগারের প্রবেশ দ্বার থেকে শুরু করে অধিকাংশ জায়গাজুড়ে বইয়ের সমাহার। পাঠাগারের পরিচালক আলামীন বলেন, বর্তমানে সুধীজন পাঠাগারে গল্প, কবিতা, সাহিত্য, ভ্রমণ কাহিনি, জীবনী, ধর্মীয়, সায়েন্স ফিকশন, কিশোর কিলার, খেলাধুলা, চলচ্চিত্র ও সাধারণ জ্ঞান বিষয়ক ৪০ হাজার বই রয়েছে। এর মধ্যে বাংলা বই রয়েছে ৩০ হাজার। ইংরেজি বই রয়েছে ১০ হাজার। পাঠকদের চাহিদা অনুযায়ী বই পাওয়া যায় না এমন বইয়ের সংখ্যা খুবই কম। কোনো বই পাঠাগারে না থাকলে সে বই যত টাকাই হোক সংগ্রহ করা হয়। এ ছাড়া পাঠাগারে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য রয়েছে ‘হোসেন জামাল স্মৃতি পাঠকক্ষ’।
মোবাইল লাইব্রেরি সার্ভিসসুধীজন পাঠাগার শুধু ভবনেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের রয়েছে মোবাইল লাইব্রেরি সার্ভিসও। নিজস্ব পিক-আপ ভ্যানযোগে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন স্কুলে গ্রন্থসেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সুধীজন পাঠাগারের মাধ্যমে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য সাধারণ জ্ঞান, বিতর্ক, বাংলা বানান ও নানা রকম সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে। পাশাপাশি অভিভাবকদের নিয়েও বিভিন্ন রকমের প্রোগ্রাম করা হয়ে থাকে।
বৃত্তি ব্যবস্থা ও গুণী ব্যক্তি পুরস্কারপাঠাগারের কর্মাধ্যক্ষ ইমতিয়াজ ফারুক রনি বলেন, প্রতিবছর মেধাবী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত করতে ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠাসহ শিক্ষা-সাহিত্য এবং সমাজ সেবায় অবদান রাখার জন্য মোট আটটি বৃত্তি চালু রয়েছে। বৃত্তিগুলোর মধ্যে ছয়টি প্রয়াত বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে এবং দুটি পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক নুরুল হক ও তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগমের নামে। বৃত্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে- হোসেন জামাল স্মৃতি বৃত্তি, অধ্যাপক নুরুল হক বৃত্তি, হেদুন ব্যাপারী স্মৃতি বৃত্তি, হাজী মো. ইলিয়াছ স্মৃতি বৃত্তি, হাজী রহমতউল্লাহ ও সাহারা খাতুন স্মৃতি বৃত্তি, আলী আহাম্মদ চুনকা স্মৃতি বৃত্তি, এ এ আব্দুল আলী ও সৈয়দা সুলতানা বানু স্মৃতি বৃত্তি এবং আনোয়ারা বেগম বৃত্তি।
এছাড়াও প্রতিবছর সুধীজন পাঠাগার থেকে দেশের একজন গুণী ব্যক্তিকে শিক্ষা বিষয়ক যে কোনো শাখায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘হোসেন জামাল স্মৃতি পুরস্কার’ প্রদান করা হয়। পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচিও রয়েছে। একই সঙ্গে গ্রন্থনীতি প্রণয়ন, পুস্তক রপ্তানি, প্রকাশনা, গ্রন্থাগার সংগঠন ইত্যাদি বিষয়েও জাতীয় পর্যায়ে পাঠাগারটি অবদান রাখার চেষ্টা করে চলেছে।
নিজস্ব প্রকাশনাপাঠাগারের পরিচালক আলামীন বলেন, সুধীজন পাঠাগারের রয়েছে নিজস্ব কিছু প্রকাশনা। এ পর্যন্ত পাঠাগারের উদ্যোগে প্রকাশিত হয়েছে তিনটি বই। যেগুলোতে উঠে এসেছে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস-ঐতিহ্য। ১৯৮৫ সালে ২৬ মার্চ প্রকাশিত হয় নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস, ১৯৯৪ সালে ড. করুণাময় গোস্বামীর সম্পাদনায় ও এ.কে.এম শামসুজ্জোহা ফাউন্ডেশনের অর্থ সাহায্যে প্রকাশিত হয় ‘বাংলা সংস্কৃতির শতবর্ষ, ২০০৫ সালে ৩১ জুলাই ‘অধ্যক্ষ খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী’ স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এরপর ২০১৭ সালে ১ জুন নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস বইটি পুনঃমুদ্রিত হয়। এসব বইয়ে নারায়ণগঞ্জের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে।
পরিচালক আল আমিন বলেন, আমরা মনে করি বেসরকারি পাঠাগারের মধ্যে সুধীজন পাঠাগার অন্যতম শ্রেষ্ঠ। আমরা পাঠকদের চাহিদা বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। পাঠকের চাহিদা অনুযায়ী বই না থাকলেও সংগ্রহ করে দিয়ে থাকি। আগে উপন্যাসের পাঠক বেশি ছিল। এখনও উপন্যাসের পাঠক আছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ের পাঠক রয়েছে। আগেও যেরকম পাঠক ছিল এখনও সেরকম পাঠক রয়েছে। এখনও বই পড়ার আকর্ষণ রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান দেবাশীষ ভদ্র বলেন, নারায়ণগঞ্জের মধ্যে সুধীজন পাঠাগার ঐতিহ্যবাহী। তারা পাঠকদের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করে থাকে। সেইসঙ্গে পড়ার পরিবেশও অনেক সুন্দর। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মাঝে জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের বেশ ভূমিকা রয়েছে।
এফএ/জিকেএস