অর্থনীতি

ভ্যাটের চাপে টমেটো ফের ‘আশীর্বাদ’ থেকে ‘অভিশাপ’

• কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নেতিবাচক প্রভাব• রপ্তানিতে আসবে আঘাত • কাঁচামাল আমদানিনির্ভরতা বাড়বে• সরকারের রাজস্ব কমবে

Advertisement

এই মুহূর্তে উৎপাদিত অতিরিক্ত পণ্য নিয়েও আমি খুশি। কারণ অতিরিক্ত সরবরাহ এখন কোনো সমস্যা নয়। চুক্তিভিত্তিক চাষের ফলে ঠিকাদার সব পণ্য কিনে নেন। এতে কৃষক থাকেন সুরক্ষিত। অথচ একটা সময় ক্রেতা না থাকায় টমেটো ফেলে দিতে হতো। বিক্রি করতে হতো পানির দামে। টমেটোর অতিরিক্ত উৎপাদন ছিল কৃষকের জন্য অভিশাপ, এখন তা আশীর্বাদ।

মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) জাগো নিউজের সঙ্গে কথাগুলো বলছিলেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পাইতা পুকুর গ্রামের কৃষক মো. হাসানুজ্জামান।

চুক্তিভিত্তিক চাষের অধীনে কয়েক বছর ধরে টমেটো ও অন্য ফসল চাষ করে এখন স্বাবলম্বী তিনি। শিক্ষিত করছেন দুই ছেলেকে।

Advertisement

হাসানুজ্জামান বলেন, চুক্তিভিত্তিক চাষের অধীনে প্রাণ গ্রুপ আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ এবং নানান ধরনের পরামর্শ দেয়। ফলে আমরা ভালো মানের টমেটো উৎপাদন করতে পারি। ফলনও আগের তুলনায় খুব ভালো। চুক্তি অনুসারে, আমাদের সব উৎপাদিত পণ্য প্রাণ গ্রুপ কিনে নেয়। এতে আমাদের কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। ন্যায্যমূল্য পাই।

ক্ষেতেই পচতো টমেটো

২০ বছর বা তার কিছু আগের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। উৎপাদিত অতিরিক্ত টমেটো নিয়ে প্রতি বছরই বিপাকে পড়তেন কৃষক। ক্রেতা না থাকায় অনেকের টমেটো ক্ষেতেই পচে যেত। বাজারে দর নেমে যেত কেজিপ্রতি দুই থেকে পাঁচ টাকায়। অনেকে বিক্রি না করে নষ্টও করতেন, ফেলে দিতেন।

যথাযথ সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজতকরণের অভাবে টমেটোর মতো অনেক কৃষিপণ্য নষ্ট হতো। দেশের সর্ববৃহৎ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ গ্রুপ কৃষকের ত্রাণকর্তা হয়ে এগিয়ে আসে। ২০০২ সাল থেকে টমেটো থেকে নানান ধরনের খাদ্যপণ্য প্রস্তুত করছে প্রতিষ্ঠানটি। পণ্যের গুণগত মানের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় প্রাণ। পণ্যের গুণগত মান অনেকাংশে নির্ভর করে মানসম্মত কাঁচামালের ওপর। এটি বিবেচনায় রেখে ২০১০ সালে প্রাণ টমেটোর চুক্তিভিত্তিক চাষ শুরু করে।

ভ্যাট ও ট্যাক্স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অভিশাপের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াবে আমাদের জন্য। এটির কারণে পণ্যের দাম বাড়বে। চাহিদা কমবে। ফলে ক্রেতা কম কিনবে। ভোগ কমে যাওয়ায় সস ও অন্য পণ্যের উৎপাদকরা টমেটো কেনা কমিয়ে দেবে। আমাদের পণ্যগুলো আবার সেই ২০ বছর আগের মতো ফেলে দিতে হবে।- কৃষক হাসানুজ্জামান

Advertisement

শুধু হাসানুজ্জামান নন, তার মতো হাজার হাজার কৃষক চুক্তিভিত্তিক চাষের অধীনে প্রাণ গ্রুপকে টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ ও সরবরাহ করে, যা কৃষকের জীবনমান উন্নত করেছে। পাশাপাশি তৈরি করছে নতুন কর্মসংস্থান।

আরও পড়ুন টমেটো পেস্ট-কেচাপ-সস/ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করায় চাহিদা কমার শঙ্কা, উদ্বিগ্ন চাষিরা টমেটো চাষিদের ‘শেষ বিকেলের’ কান্না গোদাগাড়ীতে টমেটো চাষে ‘নীরব বিপ্লব’

হতাশা ব্যক্ত করে হাসানুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক ভ্যাট ও ট্যাক্স বাড়ানোর সিদ্ধান্ত অভিশাপের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াবে আমাদের জন্য। এটির কারণে পণ্যের দাম বাড়বে। চাহিদা কমবে। ফলে ক্রেতা কম কিনবে। ভোগ কমে যাওয়ায় সস ও অন্য পণ্যের উৎপাদকরা টমেটো কেনা কমিয়ে দেবে। আমাদের পণ্যগুলো আবার সেই ২০ বছর আগের মতো ফেলে দিতে হবে।

কমবে পণ্য বিক্রি, রাজস্ব হারাবে সরকার

ভ্যাট-ট্যাক্সের জাঁতাকলে দাম বাড়বে টমেটোজাত পণ্যের। এতে বিক্রি কমলে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পড়বে শিল্প ও কৃষিখাতে। যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, আঘাত আসবে রপ্তানিতে, কাঁচামাল আমদানিনির্ভরতা বাড়বে এবং সরকারের রাজস্ব আদায় কমবে।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কৃষিজাত পণ্য নষ্ট হয় শুধু প্রক্রিয়াজাতকরণের অভাবে। এখন আমাদের যদি বিক্রি কমে তাতেই বিপুল পরিমাণ পণ্য নষ্ট হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষক।

টমেটোর নানান ব্যবহার

একটা সময় টমেটো সালাদ হিসেবে কাঁচা খাওয়া আর রান্না কিংবা চাটনি বানিয়ে খাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ব্যবহার ছিল না। প্রক্রিয়াজাত করে সারা বছর ব্যবহার করার প্রচলন সেভাবে হয়নি। সে সুযোগ-সুবিধা দেশে ছিল না। একসময় তা আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে। প্রাণ গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে টমেটো প্রক্রিয়াজাত করে বছরজুড়ে ব্যবহারের উপযোগী করতে। একে একে তৈরি হয় সস, কেচাপ, পেস্ট ইত্যাদি। এতে বাড়তে থাকে চাহিদা। মানুষও এসব পণ্য ভোগ করতে অভ্যস্ত হয়। সস, কেচাপ শুধু বিভিন্ন ফাস্টফুডজাতীয় খাবারের সঙ্গে নয়, রান্নার বিভিন্ন পদে বৈচিত্র্য আনতেও ব্যবহার হয়। ফলের টমেটোজাত পণ্যের ভোক্তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে চাষের আগ্রহ।

টমেটো সস-কেচাপ-পেস্টে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ

গত ৯ জানুয়ারি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভ্যাট বিভাগ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়ে দেয়। সেখানে আচার, বিস্কুট, কেক, চাটনি, টমেটো পেস্ট, টমেটো কেচাপ, টমেটো সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প ইত্যাদি পণ্যের মূসক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

এবার সারাদেশে প্রাণের সাড়ে ১০ হাজার চুক্তিভিত্তিক কৃষক প্রায় দুই হাজার ৮০০ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেন। চলতি বছর টমেটো সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ২২ হাজার টন।

কৃষিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নেতিবাচক প্রভাব

কৃষক ইফতেখার আহমেদ বলেন, ‘চলতি বছর আমি ৭৫ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছি। ফলন ভালো হয়েছে। বিঘাপ্রতি ২০-৩০ হাজার টাকা লাভ হবে। আমার ক্ষেতে কাজ করে বেশ কিছু লোক জীবিকা নির্বাহ করে। পণ্যের চাহিদা কমে গেলে এবং বিক্রি কমে গেলে আমরা পণ্যের সঠিক মূল্য পাবো না।’

সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তে প্রান্তিক কৃষক ও জনগণের ওপর প্রভাব বিবেচনা করা উচিত। ভ্যাট-ট্যাক্সের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নয়। সরকার সাধারণ ভোক্তা ও কৃষকদের চাপে না ফেলে রাজস্ব বাড়াতে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারে।- বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

‘যেহেতু দাম বাড়ার কারণে বিক্রি কমবে এবং উৎপাদকরা কম নেবে আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হবো। ফলে আমরা কম জমি চাষ করবো। এটি এ খাতে কর্মসংস্থানের ওপরও প্রভাব ফেলবে।’ বলেন ইফতেখার।

ইফতেখার আরও বলেন, ‘টমেটো, আম বা অন্য পচনশীল ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ না হলে দালাল ও ক্রেতারা আমাদের ঠকায়। এমনকি সরবরাহ বেশি থাকা অবস্থায় পণ্য না নেওয়ায় আমাদের মারাত্মক লোকসান গুনতে হয়েছে। এটি কৃষকদের কম জমিতে চাষ করতে নিরুৎসাহিত করবে। প্রান্তিক কৃষকরা ভ্যাটের ফলে চূড়ান্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। প্রান্তিক কৃষকদের বাঁচাতে সরকারের উচিত কর না বাড়িয়ে বর্ধিত হার অবিলম্বে প্রত্যাহার করা।’

৬০০ কোটি টাকার বাজার

দেশে বর্তমানে সস, কেচাপ ও টমেটো পেস্টের বাজার বার্ষিক ৬০০ কোটি টাকা। এই বাজার বছরে ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। তবে সম্প্রতি ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ফলে এসব পণ্যের দাম বেড়ে গেলে অনেকেই পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকবেন। এছাড়া এর প্রভাবে কারখানা বন্ধ হলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের জীবনেও অনিশ্চয়তা নেমে আসবে।

রাজস্ব কমবে সরকারের

ট্যাক্স ও ভ্যাট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যের দাম বাড়বে, ভোক্তা ব্যবহার কমাবে এবং বিক্রি কমবে। বিক্রি কমলে সরকার কম রাজস্ব পাবে বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, সরকারের যে কোনো সিদ্ধান্তে প্রান্তিক কৃষক ও জনগণের ওপর প্রভাব বিবেচনা করা উচিত। ভ্যাট-ট্যাক্সের সাম্প্রতিক বৃদ্ধি সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নয়। সরকার সাধারণ ভোক্তা ও কৃষকদের চাপে না ফেলে রাজস্ব বাড়াতে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে পারে।

আরও পড়ুন বর্ধিত ভ্যাট-শুল্ক প্রত্যাহারের আহ্বান আহসান খান চৌধুরীর বর্ধিত ভ্যাট প্রত্যাহার না হলে কারখানা বন্ধ করবেন ব্যবসায়ীরা ভ্যাটের চাপে মিষ্টিও এখন ‘তেতো’ ক্ষেতের ৫ টাকার টমেটো বাজারে ৩০ রপ্তানি কমবে, কাঁচামাল আমদানিনির্ভরতা বাড়বে

বর্তমানে সস-কেচাপের বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে প্রাণ। বছরে ৩০ হাজার টন টমেটো সস উৎপাদন করার সক্ষমতা রয়েছে প্রাণ গ্রুপের। বর্তমানে ১১টি ভ্যারিয়েন্টে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। দাম ৩ থেকে ১০৭০ টাকা পর্যন্ত।

দেশের বাইরেও প্রাণের সস-কেচাপের ভালো চাহিদা রয়েছে এবং ক্রমেই বাজার প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, মালয়েশিয়াসহ ২০টি দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে। এই বাজার আরও বাড়াতে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে প্রাণের পণ্য নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে ১৪৫টি দেশে। সুতরাং, আরও ১২৫টি দেশে সস রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। তাই সসের যত বেশি বাজার তৈরি হবে, কৃষক তত বেশি লাভবান হবেন।

আমরা বেশিরভাগ দেশেই বিক্রি করতাম। বিগত কয়েক বছরে রপ্তানি করছি। এই মুহূর্তে আমরা ২০টি দেশে সস রপ্তানি করছি। এর মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ১০ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো আমাদের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে।- প্রাণ অ্যাগ্রো লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম মইনুল ইসলাম মইন

প্রাণ অ্যাগ্রো লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম মইনুল ইসলাম মইন বলেন, ‘আমরা সস তৈরি করছি ২০০২ সাল থেকে। ২০১০ সাল থেকে কৃষকদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে বেশি পরিমাণে টমেটো উৎপাদন করছি। এখন আমরা দেশি টমেটো দিয়ে সস তৈরি করি। এতে আমাদের সসের ব্যয় অনেকটা কমেছে।’

বর্তমানে প্রাণ গ্রুপ রাজশাহীর বরেন্দ্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক-বিআইপি ও নাটোরের প্রাণ অ্যাগ্রো কারখানায় টমেটো সংগ্রহ ও পাল্পিং করে বলে জানান তিনি।

মইনুল বলেন, ‘আমরা বেশিরভাগ দেশেই বিক্রি করতাম। বিগত কয়েক বছরে রপ্তানি করছি। এই মুহূর্তে আমরা ২০টি দেশে সস রপ্তানি করছি। তার মধ্যে আছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ১০ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো আমাদের ওপর খুব বেশি প্রভাব ফেলবে।

তিনি বলেন, ভ্যাট শুধু ১০ শতাংশ বাড়িয়েছে বিষয়টি এমন নয়। এটি ৩০০ গুণ বাড়িয়েছে। সস অ্যাসেনশিয়াল পণ্য না যে মানুষ নিয়মিত খাবে। এখন মুদ্রাস্ফীতির সময়। দেখা যাবে মানুষ এখন সস কম খাবে। এতে বিক্রি কমলে দাম বেড়ে যাবে।

‘এতদিন আমরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতামূলক দামে সস দিতে পারছিলাম। এখন আমাদের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এতে আমরা রপ্তানির মার্কেটও হারাবো। আমাদের অনুরোধ থাকবে যদি আগের রেটে ট্যাক্স ফিরিয়ে আনা হয় তাহলে এ খাতটি বাঁচবে। আবার যদি টমেটো পেস্ট আমদানি করতে যাই তাহলে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বো।’ যোগ করেন তিনি।

আইএইচও/এএসএ/এমএমএআর/এএসএম