দেশজুড়ে

সিলেটে রিসোর্টে আটক ৮ তরুণ-তরুণীর বিয়ে দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন

সিলেটের একটি রিসোর্টে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ তুলে ‘স্থানীয়রা হানা’ দিয়ে ১৬ তরুণ-তরুণীকে আটকের পর আটজনকে বিয়ে দেওয়ার ঘটনায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এমনকি পুলিশের উপস্থিতিতে এ ধরনের বিয়ের আয়োজন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আপত্তিকর ভিডিও নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন বিশিষ্টজনরা।

Advertisement

আইনজীবী ও সুশীল ব্যক্তিরা বলছেন, অনৈতিক কাজের অভিযোগে আটকের পর ‘জোরপূর্বক’ বিয়ে দেওয়াটা সম্পূর্ণ বেআইনি। এ ধরনের বিয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।

তবে বিয়ে আয়োজন করা ব্যক্তিরা বলছেন, আটক তরুণীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিধিমোতাবেক কাজি ডেকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখানে দুই পক্ষের সম্মতি রয়েছে। জোরপূর্বক কাউকে বিয়ে দেওয়া হয়নি।

এর আগে রোববার (১৯ জানুয়ারি) দুপুরে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার থানার রিজেন্ট পার্ক অ্যান্ড রিসোর্টে অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগে ১৬ জন তরুণ-তরুণীকে আটক করেন স্থানীয়রা। এসময় রিসোর্টটি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে আটক আট তরুণ-তরুণীকে স্থানীয় মুরুব্বি ও পুলিশের উপস্থিতিতে কাজি ডেকে বিয়ে পড়ানো হয়।

Advertisement

আরও পড়ুন:

সরকারি মোটেলে আগ্রহ নেই পর্যটকদের, ভরসা ‘প্রেমিক যুগল’

বিয়ে সম্পন্ন হওয়া চার যুগলের মধ্যে তিনজনের দেনমোহর ১০ লাখ টাকা এবং একজনের জন্য ১২ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়। আটক বাকি আটজনকে তাদের পরিবারের জিম্মায় ছেড়ে দেওয়া হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, রিজেন্ট পার্ক অ্যান্ড রিসোর্টে দীর্ঘদিন ধরে অসামাজিক কার্যকলাপ চলছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রিসোর্টের কক্ষ ভাড়া নিয়ে অনৈতিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছেন বলে দাবি করেন তারা। ঘটনার দিন দুপুরে স্থানীয়রা রিসোর্টে হানা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আটক করেন। এসময় উত্তেজিত জনতা রিসোর্টের কয়েকটি কক্ষে ভাঙচুর চালান এবং আগুন ধরিয়ে দেন।

রিসোর্টে ‘স্থানীয়দের হানা’ দেওয়ার ঘটনাকে ভিন্নভাবে দেখছেন সুশীল ব্যক্তিরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ নিজের হাতে তুলে নেওয়ার পেছনে ভিন্ন কারণও থাকতে পারে বলছেন তারা। তবে এ বিষয়ে ঘটনার শিকার কোনো তরুণ-তরুণীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

Advertisement

আরও পড়ুন:

প্রেমিকের অফিসে গিয়ে অবস্থান তরুণীর, দৌড়ে পালালেন প্রেমিক

সিলেট জেলা বারের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘কোনো জায়গায় অসামাজিক কাজকর্ম হলে এলাকার মানুষের একেবারে দায়দায়িত্ব নেই তা না। ফৌজদারি কার্যবিধিতে মানুষকে কিছুটা ক্ষমতায়ন করা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, মানুষের সামনে কোনো আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হয় বা হওয়ার সম্ভাবনা যদি থাকে, তাহলে মানুষ সেই অপরাধ ঠেকানোর জন্য তাদের আটক করতে পারবে। কিন্তু আটক করার পরপরই নিকটবর্তী থানার পুলিশ অফিসার বা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হস্তান্তর করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘এলাকার মানুষ যদি মনে করেন এই পার্কে অসামাজিক কর্মকাণ্ড হচ্ছে বা তার ভিত্তি রয়েছে, তাহলে উচিত ছিল কাছের থানাকে অবহিত করা। যেহেতু তারা আটকই করেছেন, তাহলে থানাকে হস্তান্তর করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারতো। কিন্তু জোরপূর্বক বিয়ে পড়ানো ইসলাম ধর্মের কোথাও বলা হয়নি। এসব কর্মকাণ্ড পরবর্তী সময়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।’

যাদের বিয়ে হয়েছে তারা নিজ নিজ পরিবারে যাবেন। কোনোদিন হয়তো এটা স্বাভাবিক বিয়ে থাকবে না। এটা একটা সামাজিক বিশৃঙ্খলা বলেও মন্তব্য করেন অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল।

আরও পড়ুন:

পরিবারের পছন্দে বিয়েতে রাজি না হওয়ায় মেয়েকে গুলি করে হত্যা করলেন বাবা

শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘বিয়ের মধ্যে কিছুটা সামাজিকতার প্রয়োজন আছে। ছেলেমেয়ের সম্মতি, বাবা-মায়ের মতামতও প্রয়োজন। কিন্তু অপরিচিত তরুণ-তরুণীকে অপরিচিত গ্রামবাসী বিয়ে দিয়ে দেবে, এটা সামাজিক নৈরাজ্য। এটা ঠিক না।’

পুলিশের উপস্থিতিতে বিয়ে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এটা কোনোভাকেই মেনে নেওয়া যায় না। পুলিশের দায়িত্ব নয় বিয়ে পড়ানো। থানার মধ্যে কোনো আপস চলবে না। পুলিশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করবে। এখানে (থানায়) আপসের কিছু নেই।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে আইনজীবী শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘পাত্র-পাত্রীর সম্মতি ছাড়া জোরপূর্বক বিয়ে পড়ানোটা একটা অপরাধ। সেই ঘটনা লাইভ করে বা ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া সাইবার অপরাধ। যারা এই কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

সিলেট জেলা বারের সদস্য অ্যাডভোকেট আশফাকুজ্জামান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিয়ে হচ্ছে একটা সামাজিক চুক্তি। জোরপূর্বক কোনো চুক্তি করা হলে সেটা অবৈধ হয়ে যাবে। তাই আইনের দৃষ্টিতে এসব বিয়ের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। যারাই এ কাজটা করেছেন, এটা কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। বরং তারা যেসব তরুণ-তরুণীকে আটক করেছেন, তাদের পরিবারের জিম্মিায় ছেড়ে দিলে ভালো হতো।’

আরও পড়ুন:

‘সীমিত পরিসরে’ বিয়ের প্রবণতা বেড়েছে বলিউডে

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘প্রথমত রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ তরুণ-তরুণীদের এ ধরনের অনৈতিক কাজের সুযোগ দিয়ে অন্যায় করেছে। দ্বিতীয়ত সাধারণ জনগণ এই কাজ করতে পারে না। ৯৯৯-এ ফোন করলেও পুলিশ গিয়ে অভিযান চালাতে পারতো। কিন্তু জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না। তাছাড়া তরুণ-তরুণীদের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনৈতিক কাজের অভিযোগে আটক করে পুলিশে দিতে পারতেন। কিন্তু জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়াটা মোটেই ঠিক হয়নি। যাদের দেনমোহর ১০ লাখ টাকা, তাদের কি সেই সক্ষমতা আছে সেটা বিবেচনা করা উচিত ছিল। বরং এই বিয়েটা টিকবে কী না এখন সেটাই প্রশ্ন।’

এ বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দা ও সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘রিসোর্টে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে আটক ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনকে কাজি ডেকে বিয়ে পড়ানো হয়েছে। এসময় দুই পরিবারের অভিভাবকরা উপস্থিত ছিলেন। তাদের সম্মতি ছিল। আটক বাকি তরুণ-তরুণীদের স্থানীয় মুরুব্বিদের মাধ্যমে তাদের অভিভাবকদের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।’

আরও পড়ুন:

তাহসানের বিয়ের খবরে সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা

তিনি বলেন, ‘আটক তরুণীরা আমাদের জানিয়েছেন ঘটনাস্থল থেকে বের হলে তাদের প্রেমিকরা প্রতারণা করতে পারেন। তাই তাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিয়ে পড়ানোর সময় মোগলা বাজার থানার ওসিসহ স্থানীয় মুরুব্বিরা উপস্থিত ছিলেন।’

সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (মিডিয়া) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, রিসোর্টে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের খবর পেয়ে ওসি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ে পড়ানো পর্যন্ত তিনি ছিলেন না।

তিনি আরও বলেন, জোরপূর্বক বিয়ে পড়ানোর বিষয়ে কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ দেননি। এরকম কোনো অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।।

আহমেদ জামিল/এসআর/এমএস