ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সময় মার্কিন ধনকুবের হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। কিন্তু এখন এই মার্কিন ব্যবসায়ীর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশটির প্রেসিডেন্ট। তাও আবার একবার নয়, এ নিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসতে যাচ্ছেন। স্থানীয় সময় সোমবার (২০ জানুয়ারি) বেলা ১২টায় তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথগ্রহণ করবেন।
Advertisement
২০১৬ সালে প্রথমবার যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিলেন তখন অনেকেই ভাবেননি যে তিনি জয়ী হবেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের মতো তুমুল জনপ্রিয় প্রার্থীকে পরাজিত করেন। ওই নির্বাচনে হিলারি এবং ট্রাম্পের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল এবং শেষ হাসি হেসেছিলেন ট্রাম্প।
এর আগে ২০০৮ সালে ওবামার কাছে হেরে যান হিলারি। ২০১৬ সালে আবারো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে তার অংশগ্রহণ নিয়ে নতুন সূচনার আশা জেগেছিল। বিশ্ব তাকিয়ে ছিল নতুন এক ইতিহাসের দিকে। তিনি জয়ী হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কোনো নারী প্রেসিডেন্ট পেতো হোয়াইট হাউজ। কিন্তু ব্যতিক্রমী সেই ইতিহাস রচনা করতে ব্যর্থ হন হিলারি। এমনকি চলতি বছরের নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটেছে। এবার ডেমোক্র্যাট দল থেকে কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন। ট্রাম্পকে হারিয়ে তিনিও নতুন ইতিহাস গড়তে ব্যর্থ হয়েছেন।
নিউইয়র্কের ধনকুবের ব্যবসায়ী ফ্রেড ট্রাম্পের চতুর্থ সন্তান ডোনাল্ড ট্রাম্প। পরিবারের অগাধ অর্থসম্পদ থাকা সত্ত্বেও বাবার প্রতিষ্ঠানে তাকে সবচেয়ে নিচু স্তরে কাজ করতে হয়েছিল। স্কুলে দুষ্টুমি এবং উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য ১৩ বছর বয়সে তাকে সামরিক একাডেমিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
Advertisement
তিনি পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হোয়ার্টন স্কুলে লেখাপড়া করেন এবং তার বড় ভাই ফ্রেড পাইলট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে বাবা তাকেই ব্যবসায় তার উত্তরসূরি নির্বাচন করেন। অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তার ভাই ফ্রেড ট্রাম্প মারা যান। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জীবনে মদ ও সিগারেট ধরেননি ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ব্যবসায়ী হিসেবে যাত্রাবাবার প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে নিজেই ১০ লাখ ডলার ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন ট্রাম্প। তিনি নিউইয়র্ক শহরের বিভিন্ন পৌর এলাকায় ছড়ানো তার বাবার বিপুল পরিমাণ আবাসিক সম্পত্তি দেখাশোনার কাজেও সহায়তা করতেন। ক্রমে তিনি বাবার ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন এবং ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠানের নাম দেন ‘ট্রাম্প অর্গানাইজেশন’।
ব্রুকলিন আর কুইন্স এলাকার আবাসিক ভবন কেনাবেচার পারিবারিক ব্যবসাকে তিনি নিয়ে যান অন্য মাত্রায়। ম্যানহাটনের অভিজাত এলাকায় বিভিন্ন ভবন প্রকল্প গড়ে তোলেন তিনি, ভগ্নদশা কমোডোর হোটেল ভেঙে তিনি তৈরি করেন গ্র্যান্ড হায়াত হোটেল এবং ম্যানহাটানের অভিজাত রাস্তায় নির্মাণ করেন তার সবচেয়ে চোখ ধাঁধানো ৬৮তলা ভবন- ট্রাম্প টাওয়ার। নিজের নাম দিয়ে আরও বহু বিখ্যাত ভবন তিনি গড়ে তোলেন। ট্রাম্প প্লেস, ট্রাম্প ওয়ার্ল্ড টাওয়ার, ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যান্ড টাওয়ারের মধ্যে অতি পরিচিত কয়েকটি ভবন। এমনকি মুম্বাই, ইস্তানবুল এবং ফিলিপিন্সেও তিনি তৈরি করেছেন ট্রাম্প টাওয়ার।
তার অসংখ্য হোটেল ও জুয়া খেলার ক্যাসিনোর মধ্যে কিছু কিছু প্রকল্পে লালবাতিও জ্বেলেছে, যেগুলোকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়।
Advertisement
বিনোদন ব্যবসায়ও তিনি নিজস্ব রাজত্ব গড়ে তোলেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১৫ পর্যন্ত মিস ইউনিভার্স, মিস ইউএসএ সহ বিভিন্ন সুন্দরী প্রতিযোগিতার মালিক ছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে এনবিসি টেলিভিশনে তিনি চালু করেন দারুণ জনপ্রিয় রিয়ালিটি শো ‘অ্যাপ্রেনটিস’। এই শোতে বিজয়ীকে ট্রাম্প তার প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনার উচ্চপদে কাজ করার সুযোগ দেন। ১৪ মৌসুম ধরে এই শো তিনি করেছিলেন এবং তার আর্থিক হিসাবে দেখা গেছে শুধু ওই শোর জন্য টেলিভিশন নেটওয়ার্ক তাকে দিয়েছিল ২১ কোটি ৩০ লাখ ডলার।
ব্যক্তি জীবনট্রাম্প বিয়ে করেছেন তিনবার। তিনি পাঁচ সন্তানের জনক। এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ছিলেন তার প্রথম স্ত্রী ইভানা জেলনিকোভা। তিনি ছিলেন অ্যাথলেট এবং মডেল। ওই দম্পতির তিন সন্তান ডোনাল্ড জুনিয়ার, ইভাঙ্কা এবং এরিক। ১৯৯০ সালে তাদের বিয়ে ভেঙে যায়। বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে তাদের আদালতে লড়াই বিভিন্ন ট্যাবলয়েডে ছিল মুখরোচক খবর। এসব খবরে ছিল ট্রাম্প তার স্ত্রী ইভানাকে নির্যাতন করতেন- যদিও ইভানা পরে বলেছিলেন এসব ঘটনা অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল।
২০২২ সালে ৭৩ বছর বয়সে ইভানা ট্রাম্পের মৃত্যু হয়। ইভানা ট্রাম্পের মৃত্যুর পেছনে কোনো অস্বাভাকিতা পাওয়া যায়নি। একটি জরুরি নম্বরে ফোন পেয়ে পুলিশ তাকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে। ট্রাম্পের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন মার্লা ম্যাপলস। ১৯৯৩ সালে তাদের বিয়ে হয় এবং বিচ্ছেদ হয় ১৯৯৯ সালে। ২০০৫ সালে মেলানিয়া ক্নাউসকে বিয়ে করেন ট্রাম্প। এই দম্পতি এখনও একসঙ্গেই সংসার করছেন। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান ব্যারন ট্রাম্প।
রাজনীতিতে প্রবেশ১৯৮৭ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়ানোর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। এমনকি রিফর্ম পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও নামেন ২০০০ সালে। ২০০৮ সালের পর থেকে তিনি একটি আন্দোলন শুরু করেন, যার মূল বিষয় ছিল বারাক ওবামার জন্ম আমেরিকায় কিনা এবং ফলে দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্মগত অধিকার তার আছে কিনা। পরে অবশ্য এই আন্দোলন থিঁতিয়ে পড়ে, যখন প্রমাণিত হয় যে বারাক ওবামার জন্ম আমেরিকার হাওয়াইয়ে। ট্রাম্প বিষয়টা মেনে নেন- কিন্তু স্বভাবগতভাবে কখনই তিনি এই প্রসঙ্গ নিয়ে আন্দোলনের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেননি।
ট্রাম্প ২০১৫ সালের জুনে প্রথম প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, আমরা এমন একজনকে ক্ষমতায় চাই যে আক্ষরিক অর্থে এই দেশকে আবার মহান করে তুলবে। আমরাই তা করতে পারব। আমেরিকাকে আবার মহান করুন এই শ্লোগান দিয়ে তিনি প্রচারে নামেন। তার প্রচারে আমেরিকার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি যেমন তিনি দিয়েছেন, তেমনি পাশাপাশি মেক্সিকো আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দেওয়াল তুলে এবং মুসলমানদের অভিবাসন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন ট্রাম্প।
এদিকে দ্বিতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আগে পর্ন তারকাকে ঘুস দেওয়ায় মার্কিন আদালতে অভিযুক্ত হয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে তার বিরুদ্ধে সাজা ঘোষণা হলেও এজন্য তাকে কারাগারে যেতে হবে না। তবে এই সাজার ঘোষণা মাথা নিয়েই তাকে দ্বিতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে হবে।
২০১৭ থেকে ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ট্রাম্প। গত বছরের মে মাসে পর্ন তারকা ডানিয়েলস স্টর্মিকে ঘুস দেওয়ায় তিনি দোষী সাব্যস্ত হন। আদালাতের রায়ের ফলে তিনিই যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কোনো সাবেক প্রেসিডেন্ট হিসেবে অপরাধের সাজা পেয়েছেন।
২০২০ সালে দ্বিতীয় বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেন ট্রাম্প। কিন্তু সেবার ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে যান ট্রাম্প। যদিও এই নির্বাচনি ফলাফল মানতে অস্বীকার করেন তিনি। তার অভিযোগ, ভোটে কারচুপি করা হয়েছে তাই নির্বাচনের এই ফলাফল তিনি মানবেন না।
এরপর ২০২১ সালের ছয়ই জানুয়ারি ওয়াশিংটনে তার সমর্থকদের মিছিল করে জমায়েতের আহ্বান জানান। কিন্তু এই জমায়েত দাঙ্গায় রূপ নেয়। সে সময় ক্যাপিটল হিলে সহিংস হামলার দায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়। পাশাপাশি ব্যবসায়িক নথি জাল করার দায়ে গত বছর অভিযুক্ত হওয়ায় তিনি প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস গড়েছেন যাকে আদালত অপরাধী হিসেবে রায় দিয়েছে। ফলে একসময় তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শেষ বলেই অনেকে মনে করেছিলেন। তবে চলতি বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে শামিল হওয়ার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন তিনি। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হিসেবে অনুমোদনও পেয়ে যান। তিনি তার নির্বাচনি প্রচারের কর্মসূচি শুরু করেন তার বিরুদ্ধে থাকা ৯১টি অপরাধমূলক অভিযোগ নিয়ে।
এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচারণায় বেশ কিছু নাটকীয় ঘটনা ঘটেছে। কাজেই ট্রাম্পকে নিয়ে তীব্র বিতর্ক তৈরি হওয়ার বিষয়টি খুব একটা অবাক হওয়ার মত বিষয় নয়। প্রচারণার পুরোটা সময় ট্রাম্প বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেছেন, তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের হেয় করে কৌতুক করেছেন ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
চলতি বছরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে একবার সরাসরি বন্দুক হামলার শিকার হন তিনি। গত ১৩ জুলাই নির্বাচনী সমাবেশে ট্রাম্পের ওপর হামলা চালানো হয়। পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের বাটলারে এক নির্বাচনী জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় তার কান ছিদ্র করে গুলি বেরিয়ে যায়। অল্পের জন্য সেযাত্রায় বেঁচে যান ট্রাম্প। গত সেপ্টেম্বরেও ট্রাম্পের ওপর হামলার চেষ্টা হয়। গত ১৫ সেপ্টেম্বর ওয়েস্ট পাম বিচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু স্টিভ উইটকফের সঙ্গে ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল গলফ ক্লাবে সময় কাটানোর সময় তার ওপর হামলার চেষ্টা করেন এক ব্যক্তি।
আরও পড়ুন: যেভাবে শপথ নেবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ আজওই ঘটনার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ভয় পাবেন না। আমি ভালো আছি এবং কেউ আঘাতপ্রাপ্ত হননি। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ। তবে দুনিয়ায় এমন মানুষ আছে যারা আমাদের থামাতে যেকোনো কিছু করতে পারে। আমি আপনাদের জন্য লড়াই থামাবো না। আমি কখনো আত্মসমর্পণ করবো না। আমাকে সমর্থনের জন্য আপনাদের সবসময় ভালোবাসবো। আমাদের একতার মাধ্যমেই আমরা আমেরিকাকে আবারও মহান করবো। জয়ী হওয়ার পর ট্রাম্প আগের কথা স্মরণ করে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমেরিকাকে বাঁচানোর জন্যই ঈশ্বর আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন। বলা যায়, নানা ধরনের নাটকীয়তা, জল্পনা-কল্পনা সবকিছুকে পেছনে ফেলে ইতিহাস গড়েছেন ট্রাম্প।
টিটিএন