ক্রমে কঠিন হয়ে উঠছে নাগরিক জীবন। রাজধানী ঢাকার জীবনযাত্রায় বিগত কয়েক বছরে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বছরের শুরুতেই একগাদা খরচের চাপ আসে জগদ্দল পাথরের মতো। বাসাভাড়া, সন্তানের পড়াশোনার খরচ বাড়েই। সঙ্গে যোগ হয় মূল্যস্ফীতি কিংবা ভ্যাট-ট্যাক্স, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়া, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা সংক্রান্ত কারণে অতিরিক্ত পণ্যমূল্য। নগরজীবনে টিকে থাকার লড়াই নিয়ে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাত রিপনের চার পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে প্রথমটি।
Advertisement
বছর ঘুরলে ক্যালেন্ডারের পাতায় যেমন একটি সংখ্যা যোগ হয়, নগরের বাসাভাড়ায়ও তেমন যোগ হয় নতুন বোঝা। ২০২৪ সালের পর ২০২৫ আসা যেমন অবধারিত, দুই কোটির বেশি মানুষের ঢাকায় বাসাভাড়া বাড়ানোও যেন তেমনই অবধারিত। আর নতুন বাসা নিতে গেলে দিতে হয় দু-তিন মাসের অগ্রিম। সঙ্গে চলতি মাসের ভাড়া। এই টাকার জোগান দিতে অনেকের সঞ্চয় ভাঙতে হয় নতুবা করতে হয় ধার-দেনা। এতে বছরের শুরুতেই চাপে পড়েন ভাড়াবাসায় থাকা সব শ্রেণির মানুষ।
বাড়তি খরচের চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়ে অনেকেই সাবলেট বেছে নেন। অথবা শহর থেকে একটু দূরে নেন ছোট বাসা। কেউ কেউ পরিবার পাঠিয়ে দেন গ্রামে। স্বস্তিতে নেই মেসে থাকা ব্যাচেলর কিংবা শিক্ষার্থীরাও। সব কিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদেরও বাড়ছে মেসভাড়া, খাবারের খরচ। খাবারের মান কমিয়ে কেউ আবার সমন্বয় করছেন বাড়তি খরচ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতবারের মতো এবারও বছরের শুরুতেই রাজধানীতে এলাকাভেদে এক হাজার থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত বাসাভাড়া বাড়িয়েছেন মালিকরা। বাড়তি ভাড়া নতুন বছরের প্রথম মাস (জানুয়ারি) থেকেই পরিশোধ করতে হবে। এর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল তো আছেই। আর নতুন ফ্ল্যাট বা অ্যাপার্টমেন্টের ভাড়া চাওয়া হচ্ছে আরও বেশি। এ নিয়ে মালিক-ভাড়াটিয়ার মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও সমাধানের কোনো পথ দেখা যায়নি।
Advertisement
বাসা মালিকদের অভিযোগ, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বাড়ছে। ভাড়াটিয়ারা বলছেন, দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ‘মানবিকতার’ পরিচয় দেওয়া উচিত মালিকদের।
গত বছরের শুরুতে বাসা সংস্কার করার অজুহাত দেখিয়ে এক হাজার টাকা বাড়িয়েছিলেন মালিক। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মালিকের ভাই জানিয়েছেন নতুন বছর থেকে আরও দেড় হাজার টাকা ভাড়া বেশি দিতে হবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটেই এ নিয়ে নোটিশ দিয়েছেন।-ভাড়াটিয়া সাব্বির আহমেদ
বেসরকারি চাকরিজীবী মাহমুদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কদিন আগে গ্রামের বাসায় কিছু টাকা দিয়েছি বোনের বিয়েতে। এখন বাচ্চার স্কুলে ভর্তিসহ নতুন বাসার খরচ রয়েছে। হাতে নগদ অর্থ নেই, সামান্য সঞ্চয় রয়েছে সেটা ভেঙে খরচ করতে হবে। কেউ অসুস্থ হলে তো ঋণ করা ছাড়া উপায় নেই।’
বছরের শুরুতে এমন চাপে পড়েন অধিকাংশ চাকরিজীবী। স্কুলে ভর্তিতে বড় একটি টাকা চলে যায়। সঙ্গে থাকে স্কুলের জুতা, ইউনিফর্ম, ব্যাগ, স্টেশনারি, টিফিন বক্স ইত্যাদি কেনার খরচ। বাড়িভাড়ার চাপ তো আছেই। নতুন বছর উদযাপনটাও হয়ে ওঠে না অধিকাংশ মানুষের।
Advertisement
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাব্বির আহমেদেরও একই অবস্থা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছরের শুরুতে বাসা সংস্কার করার অজুহাত দেখিয়ে এক হাজার টাকা বাড়িয়েছিলেন মালিক। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই মালিকের ভাই জানিয়েছেন নতুন বছর থেকে আরও দেড় হাজার টাকা ভাড়া বেশি দিতে হবে। প্রতিটি ফ্ল্যাটেই এ নিয়ে নোটিশ দিয়েছেন।’
আমার মেইনটেন্যান্স খরচ বেড়েছে। নিরাপত্তা প্রহরীদের বাড়তি খরচ না দিলে থাকবে না। সব মিলে আমাকেও চলতে হবে।– বাড়ির মালিক রফিকুল ইসলাম
তিনি বলেন, ‘কথা বলতে গেলে মালিক বলেন না পোষালে বাসা ছেড়ে দিতে। মানে ভাড়া বাড়ানো হবে মালিকের ইচ্ছায়। কথাও বলা যাবে না। বাসা ছাড়তেও পারছি না, কারণ বাচ্চাদের স্কুল বাসার কাছে। দূরে বাসা নিলে তাদের জন্য নতুন স্কুলে ভর্তিসহ বাড়তি পরিবহন খরচ লাগবে। সঙ্গে নিত্যপণ্যের দামও নাগালের বাইরে। কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারছি না, আবার জীবিকার তাগিদে এ শহরও ছাড়তে পারছি না।’
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এর আগে যে বাসা ১২ থেকে ১৩ হাজারে পাওয়া যেত এখন ভাড়া নিতে গুনতে হচ্ছে অন্তত ১৬ হাজার টাকা। রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি চাহিদা ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার বাসা। মধ্যবিত্ত শ্রেণি এমন বাসা খোঁজেন। এতে তারা বেশি খেয়াল রাখেন কর্মস্থলের দূরত্ব এবং বাচ্চাদের স্কুলের যাতায়াত।
সিটি করপোরেশনগুলোতে বসবাসকারীদের ৭২ শতাংশই থাকেন ভাড়া বাসায়বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান-২০২৩-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন বলছে, দেশের সিটি করপোরেশনগুলোতে বসবাসকারীদের মধ্যে ৭২ শতাংশই ভাড়া বাসায় থাকেন। এসব এলাকায় নিজের বাসায় থাকেন মাত্র ২৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ মানুষ। সিটি করপোরেশনের বাইরে অন্য শহরে ভাড়ায় থাকেন ১৮ শতাংশ।
বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন আছে, যেটা ভাড়াটিয়া কিংবা মালিক কেউ ফলো করেন না। মালিক খেয়ালখুশি মতো ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। আইনের বিধান সাপেক্ষে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার বেশি বাড়ালে সেই অধিক ভাড়া কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও তা আদায়যোগ্য হবে না।- সিএমএম আদালতের সিনিয়র আইনজীবী আক্তারুজ্জামান ডালিম
বিবিএসের তথ্য আরও বলছে, দেশে বাসাভাড়াও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়ে শহরে বাড়িভাড়া বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন। যার মধ্যে গ্রামে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ, শহরে ১৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ আর সিটি করপোরেশনে ৭২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। দেশে ভাড়া ছাড়াই থাকেন ১ দশমিক ৯৬ শতাংশ মানুষ।
বাড়ির মালিকদেরও খরচ বাড়ার দাবিতবে ভাড়া বাড়লেও বাড়ির মালিকরা বলছেন উল্টো কথা। তারা এর পেছনে নানান সংস্কারসহ বিভিন্ন বিলের ইস্যু নিয়ে আসছেন। মগবাজার চান বেকারির গলির বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মেইনটেন্যান্স খরচ বেড়েছে। নিরাপত্তা প্রহরীদের বাড়তি খরচ না দিলে থাকবে না। সব মিলে আমাকেও চলতে হবে।’
একই কথা বলেন ব্যাপারী গলির বাসামালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রিপন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘কদিন আগেই গ্যাস লাইন মিটারে কনভার্ট করলাম, বিদ্যুতের কাজও চলমান। বাসার কিছু সংস্কার করেছি। আমার বাড়তি আয় নেই। বাসাভাড়ার ওপরেই চলতে হয়। তাহলে এই বাড়তি অর্থ কোথায় পাবো?’
ভাড়া বাড়ানোর আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই২০০৭ সালে ঢাকা সিটি করপোরেশনের ৭৭৫টি এলাকায় ১০টি রাজস্ব আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি, পাকা ঘর, সেমি পাকা, মেইন রোডের তিনশ ফিট ভেতরে এবং বাইরে পাঁচ থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি বর্গফুট ভাড়া নির্ধারণ করা করে দেওয়া হয়। এটির প্রয়োগ কোথাও দেখা যায়নি বা শোনা যায়নি। আবার বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ এ রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান। আইনের ১৬ ধারা মতে, বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া বাসার মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। এটা মানা হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই।
আরও পড়ুনটিসিবির পণ্য নিতে মধ্যবিত্তরাও লাইনেছয় পণ্যে শুল্কছাড়, দাম কমেছে একটিরসেই সিন্ডিকেটের কবলেই বাজার, দ্রব্যমূল্যে দিশাহারাবছর শেষ হয় বাসাভাড়া বাড়ানোর নোটিশেহাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে ২০২৫ সালে বাড়িভাড়া বাস্তবায়ন ও স্বাভাবিক রাখার দাবি জানিয়েছেন বাংলাদেশ মেস সংঘের (বিএমও) মহাসচিব মো. আয়াতুল্লাহ আকতার। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাকরিজীবী, শ্রমজীবী, শিক্ষার্থীরা প্রতি নতুন বছরে বাসাভাড়া নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। তাদের আয়ের সিংহভাগ বাসাভাড়ায় চলে যায়। নতুন বছরে লাগামহীন বাড়িভাড়া বাড়ানো কারও কাম্য নয়। অযৌক্তিকভাবে কোনো অবস্থায়ই বাড়িভাড়া বাড়ানো যাবে না। বাড়িভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে নির্দেশনা প্রতিপালন করতে হবে।’
রাজধানীর বাসার মালিকের অবস্থা মনে হয় খুবই করুণ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভাড়া দিয়েই তার সংসার চলে। ভাড়া কম হলে চলতে পারবেন না, তাই প্রতি বছরই বাড়াতে হবে।- বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারায়ে সুলতান বাহার
মালিকের ইচ্ছামতো বাসাভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি না- এ বিষয়ে ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের সিনিয়র আইনজীবী আক্তারুজ্জামান ডালিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাড়িভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন আছে, যেটা ভাড়াটিয়া কিংবা মালিক কেউ ফলো করেন না। মালিক খেয়ালখুশি মতো ভাড়া বাড়াতে পারবেন না। আইনের বিধান সাপেক্ষে, কোনো বাড়ির ভাড়া মানসম্মত ভাড়ার বেশি বাড়ালে সেই অধিক ভাড়া কোনো চুক্তিতে ভিন্নরূপ কিছু থাকা সত্ত্বেও, তা আদায়যোগ্য হবে না। তবে সুনির্দিষ্ট চুক্তি না থাকলে বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়াতে পারবেন, কিন্তু সেটা যৌক্তিক হতে হবে।’
আর্থিক সংকটে বাড়ছে সাবলেটপ্রতিনিয়ত বাড়ছে খাদ্যপণ্যের দাম, এর প্রভাব পড়ছে অন্য পণ্যেও। অথচ সেভাবে বাড়ছে না আয়। এতে নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে খাদ্যপণ্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। ডিসেম্বরেও প্রায় ১৩ শতাংশ ছিল। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। আর এসবের প্রভাব পড়ছে নগরের অধিবাসীদের বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ওপর। এতে অনেকেই বাধ্য হচ্ছেন সাবলেট নিতে।
কথা হয় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আহসান হাবীবের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রায় দুই বছর ধরে ছোটো ফ্ল্যাট নিয়ে ছিলাম। এখন আর আয় ও ব্যয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছি না। বাচ্চাকে এবার স্কুলে ভর্তি করতে হবে। খরচ বাড়বে সেখানেও। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে সাবলেট বেছে নিয়েছি।’
শফিউল্লাহ কারওয়ান বাজারে সবজির ব্যবসা করেন। তিনি গত মাসে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে চলতি মাস থেকে সাবলেট নিয়ে থাকছেন। শফিউল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেকেই সাবলেট ছেড়ে ফ্ল্যাটে ওঠেন, আমি এখন ছোট ফ্ল্যাট ছেড়ে সাবলেটে উঠেছি। এতদিন চলেছি, এখন পারছি না। গ্রামে বাবা-মা রয়েছেন, বাচ্চাটার স্কুল খরচ, পরিবারের বাজার-সদাই নিয়ে আর চলে না। খাওয়া খরচ এখন দ্বিগুণ হয়েছে। এখন দুই ভাই মিলে সাবলেট নিয়েছি আর পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়েছি।’
সাবলেট নিয়েও স্বস্তিতে নেই অনেকে। সেখানেও মুখোমুখি হতে হচ্ছে বাড়তি ঝামেলা। আজিমপুর এলাকায় সাবলেট নিয়ে থাকা ফেরদৌস জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাবলেট নিয়ে থাকা মানে অন্য একটি পরিবার কিংবা অন্য সংস্কৃতির কিছু মানুষের সঙ্গে থাকা। এটা বেশ কষ্টের। নতুন বছরে নিরাপত্তা বিল বাবদ অতিরিক্ত ৫০০ টাকা দিতে বলেন ফ্ল্যাটের মালিক। এর সঙ্গে অতিরিক্ত আরও ৫০০ টাকা বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। এটি অমানবিক।’
অর্থাভাবে নগরে বসবাসকারীদের ‘কোয়ালিটি লাইফ’ কমে যাচ্ছে। এতে নগরজীবনে আর্থিক সংকটে চাহিদা বাড়ছে সাবলেটের। আনিসুর রহমান একটি সরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। প্রায় ২৪ হাজার টাকা বেতন তার। তিনি থাকছেন রাজধানীর রেলওয়ে কলোনিতে একটি সাবলেট রুমে। আনিসুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মেলাতে পারছি না। এ কারণে একটা ভালো বাসায় রাতযাপন করবো সেটাও হয়ে ওঠে না। পরিবার গ্রামে থাকে, মাঝে মধ্যে আত্মীয় আসে ঢাকায়। তাদের কথা ভেবে মেসে থাকতে পারছি না। একটা সাবলেট বাসায় থাকতে হচ্ছে। সেখানেও প্রায় আট হাজার টাকা চলে যাচ্ছে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারায়ে সুলতান বাহার জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাজধানীর বাসার মালিকের অবস্থা মনে হয় খুবই করুণ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভাড়া দিয়েই তার সংসার চলে। ভাড়া কম হলে চলতে পারবেন না, তাই প্রতি বছরই বাড়াতে হবে। দেশের অর্থনীতি আগের মতো নেই, এ অবস্থা থেকে সরে আসা উচিত। এখন মানবিক হওয়া উচিত। মানিবকতার পরিচয় দেওয়া উচিত। মানুষের হাতে টাকা এলে বা নিত্যপণ্যের দাম কম হলে তখন বাড়াতে পারেন, এখন বাড়ানোটা অমানবিক।’
মেসেও মিলছে না স্বস্তি সুমাইয়া আক্তার পাখি, ধোলাইখাল এলাকায় একটি মেসে থাকেন। পড়াশোনা করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। টিউশনি করার পাশাপাশি একটি কোচিং সেন্টারেও খণ্ডকালীন চাকরি করেন। চারজন মিলে এক রুমের মেসে থাকছেন। খাওয়া ও মেসভাড়া বাবদ মাসে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার টাকা চলে যায়। তার মাসিক আয় গড়ে সাত হাজার টাকার কিছু বেশি।
পাখি জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটা সময় ছিল পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে সব খরচ হয়ে যেত। হাতে বাড়তি দেড়-দুই হাজার টাকা থাকতো। এখন মাস যায়, খরচ বাড়ে। মালিক ভাড়া বাড়িয়েছেন, এতে এক ধাপে মেস খরচ ৫০০ টাকা বেড়েছে। চাল-তেলের দামও বাড়তি। এখন সব খরচ শেষে আর হাতে টাকা থাকে না।’
সোহরাওয়ার্দী কলেজের ছাত্র নাসিরুল ইসলাম থাকেন লালবাগ এলাকার একটি মেসে। একটা সময় বাড়ি থেকে টাকা এনে পড়াশোনা চললেও প্রায় তিন বছর ধরে নিজের টাকায় চলতে হয়। পার্টটাইম চাকরির পাশাপাশি চলছে চাকরির পড়া। মেসের ভাড়া, খাবার খরচ জোগাতে এখন চাইলেও ভালো খাবার বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় না তার।
ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়তে এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং করে বসবাসের উপযোগী করা যায়। ওয়ার্ডভিত্তিক নগর পরিকল্পনা প্রণয়নে টেকসই নগর গড়ে তোলাও সম্ভব। যেখানে সব শ্রেণির আয়ের মানুষের জন্য বাসযোগ্য নগর প্রয়োজন।- বিআইপির সাধারণ সম্পাদক আদিল মুহাম্মদ খান
নাসিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের সব কিছুর দাম বেড়েছে দেখে মেসের মালিক নিজেই মেসের ভাড়া বাড়িয়েছেন। আগে মেসের ভাড়ার সঙ্গে পানি-বিদ্যুৎ থাকলেও এখন আলাদা করে আরও ৫৫০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বাড়ি থেকেও টাকা নিতে পারি না, আবার আয়ও বাড়েনি। চাইলেও বাড়তি কাজ করতে পারছি না, চাকরির প্রস্তুতির কারণে। সবমিলিয়ে একটা কঠিন সময় পার করছি।’
ঢাকায় আয় অনুযায়ী যেসব বাসায় থাকেন ভাড়াটিয়ারারাজধানীর যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, মিরপুর, গুলশান, বনানী ও উত্তরার বিভিন্ন এলাকায় পরিচালিত গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০ হাজার টাকা আয়েও থাকতে হচ্ছে ঝুপড়ি ঘরে। অর্ধলাখ টাকা আয় না হলে মানসম্মত আবাসনে থাকার ব্যবস্থা নেই। গবেষণাটি পরিচালনা করেছে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেটস অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন বা রিহ্যাব।
রিহ্যাব গবেষণা সেলের তথ্য বলছে, রাজধানী ঢাকায় যাদের আয় ২০ হাজার বা ২০ হাজার টাকার মধ্যে তাদের ভরসা তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকার কোনো ঝুপড়ি ঘর। এ ঘরে পরিবার নিয়ে কোনোরকমে থাকছেন তারা। যাদের আয় ২১ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা তারা থাকছেন ছয় থেকে ১০ হাজার টাকায়, সাবলেট। ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকা যাদের আয়, তারা থাকছেন ছোট আকারের কোনো ফ্ল্যাটে। যেগুলোর ভাড়া ১১ থেকে ১৪ হাজার টাকার মধ্যে।
যাদের আয় ৪১ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকার মধ্যে তারা থাকছেন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ফ্ল্যাটে। যেগুলোর আয়তন ১১০০ থেকে ১১৫০ বর্গফুট। ৫১ থেকে ৮০ হাজার টাকা আয়ের মানুষের ভরসা ১১৫০ থেকে ১২০০ বর্গফুটের কোনো ফ্ল্যাট, যেগুলোর ভাড়া ২১ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। ৮০ থেকে এক লাখ টাকা আয়ের মানুষ থাকছেন ১২০০ থেকে ১৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে- যেগুলোর ভাড়া ৩১ থেকে ৪০ হাজার টাকার মধ্যে। তবে ভালো মানের ১৫০০ বর্গফুট বা তারচেয়ে একটু বড় কোনো বাসায় থাকতে হলে অবশ্যই একলাখ টাকার বেশি তাকে আয় করতে হবে। যেগুলোর ভাড়া ৪০ হাজার টাকা বা তার চেয়ে কিছুটা বেশি।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়তে এলাকাভিত্তিক ম্যাপিং করে বসবাসের উপযোগী করা যায়। ওয়ার্ডভিত্তিক নগর পরিকল্পনা প্রণয়নে টেকসই নগর গড়ে তোলাও সম্ভব। যেখানে সব শ্রেণির আয়ের মানুষের জন্য বাসযোগ্য নগর প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে লাখ লাখ মানুষের বসবাস এড়িয়ে কোনো উন্নয়ন সম্ভব হবে না। নগরে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের আবাসনের প্রতিও গুরুত্ব দিতে হবে।’
ইএআর/এএসএ/জেআইএম