বাংলাদেশের কর কাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই একটা দুর্বল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও কর প্রশাসনের দক্ষতা এবং করজাল বিস্তারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা যায়নি। ফলস্বরূপ সরকারের রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে পরোক্ষ কর, বিশেষত মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) । এই ভ্যাটের বোঝা বারবার সাধারণ মানুষের উপর চাপানো হচ্ছে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে আরও কঠিন করে তুলছে।
Advertisement
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার বিশাল ঘাটতি ধরা হয়েছে। এই ঘাটতি পূরণের জন্য সরকার বিভিন্ন পণ্য ও সেবার উপর শুল্ক ও ভ্যাট বাড়িয়েছে। প্রস্তাবিত ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে রাজস্ব আয় থেকে আসার কথা ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম চার মাসেই (জুলাই-অক্টোবর) শুল্ককর আদায়ে ৩০ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকার ঘাটতি দেখা গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.৮১ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এমন পরিস্থিতিতে আকস্মিক ভ্যাট বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে।
সরকার মাল্টা আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করেছে। এরফলে প্রতি কেজিতে মাল্টার দাম ১৫ টাকা বেড়েছে এবং মোট শুল্ক-কর দাঁড়িয়েছে ১১৬ টাকায়। বাজারে মাল্টার দাম এমনিতেই ২৫০-২৮০ টাকা কেজি। শুধু মাল্টাই নয়, ফল, রান্নার গ্যাস, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, রেস্তোরাঁর খাবার, বিস্কুট, টিস্যু, ঢেউটিন, রংসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার উপর শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভ্যাট বৃদ্ধি একটি সাময়িক সমাধান হতে পারে বলে হয়ত মনে হতে পারে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কর কাঠামোর সংস্কার, দুর্নীতি দমন এবং সরকারি ব্যয়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। শুধু করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নয়, বরং একটি সুষম এবং কার্যকরী কর ব্যবস্থার মাধ্যমেই রাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থাকে টেকসই করা সম্ভব বলে মনে করি।
Advertisement
এখন থেকে নন-এসি রেস্তোরাঁ, বিস্কুট, কেক, আচার, টমেটো সস, কাপড়, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন, টাওয়েল, মিষ্টি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, চশমা, সানগ্লাস, মোটর ওয়ার্কশপ ও লুব্রিকেন্ট তেলের ওপর ৫ শতাংশের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট দিতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শুল্ক-কর বাড়ানোর কারণে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আদায় করা যাবে। তবে অর্থনীতিবিদদের মতে, ফল, মুঠোফোন, ইন্টারনেট, টিস্যু, রান্নার গ্যাস, পোশাক, রেস্তোরাঁর খাবার ইত্যাদি এখন দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য অংশ। এগুলোর উপর শুল্ক-কর বৃদ্ধি মধ্যম ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করবে। এই বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকা শেষ পর্যন্ত জনগণের পকেট থেকেই যাবে।
প্রাক্তন এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু সরকারের এই পদক্ষেপকে অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর বলে অভিহিত করেছেন। সুদহার ৯% থেকে ১৬% এ উন্নীত করা এবং নতুন ভ্যাট আরোপের ফলে পণ্যের দাম বাড়বে, যা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে। তিনি বলেন, ভ্যাট একটি পশ্চাৎমুখী কর ব্যবস্থা, যেখানে আয়ের ভিত্তিতে কর ধার্য করা হয় না। এর ফলে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের উপর তুলনামূলকভাবে বেশি বোঝা পড়ে।
অন্যদিকে, আয়কর একটি প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা, যেখানে উচ্চ আয়ের মানুষের উপর বেশি কর ধার্য করা হয়। সরকার যদি আয়কর জাল প্রসারিত না করে শুধু ভ্যাটের উপর নির্ভর করে, তাহলে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, রাজস্ব আয় তখনই বাড়বে যখন অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। এমনিতেই ডলারের মূল্য বেশি এবং দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের এই পদক্ষেপ অর্থনীতির জন্য ভালো হবে না। সিপিডির ফেলো মোস্তাফিজুর রহমানও একই মত পোষণ করেন। তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে ভ্যাট বৃদ্ধি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।
আমদানি করা ফলের উপর উচ্চ করের কারণে (মোট করভার ১৩৬ শতাংশ পর্যন্ত) বাজারে আপেল ৩০০-৩৪০ টাকা, কমলা ২৬০-৩২০ টাকা এবং আঙুর ৪৫০-৪৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, শুল্ক-কর বাড়িয়ে বিদেশি ফল এখন ধনীদের খাবারে পরিণত করা হয়েছে। বিভিন্ন পণ্যে কর বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে। যেমন, আপেল, মাল্টা, কমলার উপর করভার ১৫ টাকা বেড়ে ১১৬ টাকা হয়েছে, ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের করভার ৭ টাকা বেড়ে ১০২ টাকা, ৬৫-৭০ টাকার ফেসিয়াল টিস্যুর প্যাকেটের করভার ৪ টাকা বেড়ে ৭-৮ টাকা, ১০০০ টাকার পোশাক ও রেস্তোরাঁর খাবারে করভার ৭৫ টাকা বেড়ে ১৫০ টাকা, মুঠোফোনে ১০০ টাকা রিচার্জে কর প্রায় ৩০ টাকা, ৫০০ টাকার ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বিলে করভার ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৭৭.৫০ টাকা, বিস্কুটের ২৫০ গ্রামের প্যাকেটের দাম ৬০ টাকা থেকে বেড়ে ৭০ টাকা হতে পারে, ৩০০ টাকার সিনেমা টিকিটে ভ্যাট ৩০ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা এবং শিল্পে ব্যবহৃত এলপিজির ১২ কেজির সিলিন্ডারে খরচ ৪৩ টাকা বেড়েছে।
Advertisement
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর মতে, বিশ্বব্যাপী সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে, যা দেশগুলোর রাজস্ব ঘাটতির ইঙ্গিত। উন্নত দেশগুলো সাধারণত জিডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ কর রাজস্ব সংগ্রহ করে, যেখানে স্বল্প আয়ের দেশগুলোতে এই হার ১০ থেকে ২০ শতাংশ। বাংলাদেশে কম কর আদায়ের পেছনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, অনানুষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্র, দুর্নীতি এবং কর সংস্কারের অভাব অন্যতম কারণ। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জন কোলম্যানের গবেষণা অনুযায়ী, অনেক দরিদ্র দেশে মাথাপিছু আয় কম হওয়া সত্ত্বেও করের হার বেশি। এর প্রধান কারণ দুর্নীতি। আজারবাইজানের অধ্যাপক ইব্রাহিম নিফতিইয়েফ এর মতে, অনেক সময় শাসকরা কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকায় কর আদায়ে আগ্রহী হন না।
উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত অনেক কম (প্রায় ১০%, যেখানে ওইসিডি দেশগুলোতে গড় ৩৪%)। তবে শুধু করের হার বেশি হলেই অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয় না। ডেনমার্কে কর-জিডিপি অনুপাত ৪৬% হলেও তাদের মাথাপিছু জিডিপি যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কম। এই পরিস্থিতিতে, সরকারের উচিত জনগণের উপর করের বোঝা না বাড়িয়ে বিকল্প উপায়ে রাজস্ব বাড়ানো এবং একটি টেকসই কর কাঠামো তৈরি করা।
কর আদায়ের দক্ষতা বাড়ানো, দুর্নীতি দমন, সরকারি ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা, শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সরকারের আকার ছোট করে ও দক্ষতা বাড়িয়ে খরচ কমানো– এই সবই রাজস্ব বাড়ানোর কার্যকর উপায় হতে পারে। পোল্যান্ডের গবেষক ড. দারিউস প্রকোপাইক্স এর মতে, অতিরিক্ত কর ‘ছায়া অর্থনীতি’ বাড়াতে পারে। তাই করের হার নির্ধারণে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে ভ্যাট বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। বিশেষত, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ, যারা সীমিত আয়ের মধ্যে জীবন ধারণ করে, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান আরও কমে যাবে যাতে সরকারের সাথে জনগণের আন্তরিক ও আবেগের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেটি বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। (এই প্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে একটা সবিনয় প্রশ্ন রাখতে চাই, এই যে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে, যারা ভ্যাট দিবে তাঁদের জন্য কিছু পাওনার ব্যবস্থা কি থাকছে? জানি উত্তর হবে না, তবুও জানতে ইচ্ছে করলো।)
পরিশেষে বলা যায়, বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভ্যাট বৃদ্ধি একটি সাময়িক সমাধান হতে পারে বলে হয়ত মনে হতে পারে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কর কাঠামোর সংস্কার, দুর্নীতি দমন এবং সরকারি ব্যয়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য। শুধু করের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নয়, বরং একটি সুষম এবং কার্যকরী কর ব্যবস্থার মাধ্যমেই রাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থাকে টেকসই করা সম্ভব বলে মনে করি।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।
এইচআর/এএসএম