আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে সম্প্রতি রাজস্ব আয় বাড়ানো এবং বাজেট ঘাটতি কমাতে ওষুধ, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি), টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, বিস্কুট, মোবাইলে কথা বলা, ইন্টারনেট, কোমলপানীয়, হোটেল-রেস্তোরাঁ, সিগারেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার।
Advertisement
বিষয়টি নিয়ে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। এই অর্থনীতিবিদের অভিমত, রাজস্ব আয় বাড়াতে বিভিন্ন পণ্যের ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পদক্ষেপ সুচিন্তিতভাবে নেওয়া হয়নি। আইএমএফের ঋণের কিস্তি যাতে আটকে না যায়, সেজন্য তড়িঘড়ি এমন পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এভাবে ভ্যাট না বাড়িয়ে কীভাবে বিকল্প উপায়ে রাজস্ব ব্যয় বাড়ানো যেত তার উপায়ও জানিয়েছেন জাহিদ হোসেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন জাগো নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সাঈদ শিপন।
জাগো নিউজ: অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাট বাড়ানোর প্রয়োজন কেন হলো?
জাহিদ হোসেন: এর একটা উত্তর হচ্ছে রাজস্ব আদায় বাড়ানো। ১২ হাজার কোটি টাকার কথা বলা হচ্ছে, আমাদের ঘাটতি আছে। ঘাটতিটা সহনীয় পর্যায়ে আনতে হলে ১২ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব লাগবে।
Advertisement
জাগো নিউজ: রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য এটাই কি একমাত্র উপায় ছিল? কর না বাড়িয়ে অন্য বিকল্প পথেও হাঁটা যেত কি?
জাহিদ হোসেন: রাজস্ব আদায় কেন বাড়াতে চাচ্ছি, সেই প্রশ্নের উত্তর একটা হচ্ছে- এটা যদি না করি বাজেট ঘাটতি অনেক বেড়ে যাবে। ঘাটতি বেড়ে গেলে ঘাটতির অর্থায়ন করতে হবে। অর্থায়ন করতে গেলে আবার বাজার থেকে ঋণ নিয়ে টাকা তুলতে হবে। বাজার থেকে ঋণ নিয়ে টাকা তুললে আবার ব্যক্তিখাতে তার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাহলে বিষয়টি ঠিক আছে, ঘাটতিই যদি আমার সমস্যা হয়, তাহলে ঘাটতিটাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে গেলে আমার ব্যয়ের ব্যবস্থাপনাও তো একটা বিকল্প। সেখানে কেন আমরা আরও জোরালো পদক্ষেপ নিচ্ছি না? শুধু করের হার বাড়িয়ে কেন? কর ফাঁকি বন্ধ করে রাজস্ব বাড়ানো তো একটা বিকল্প।
এই পদক্ষেপের কারণে ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে, আবার অন্যদিকে বললাম আপনার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। এই দুটি তো যায় না একসঙ্গে। আপনার ওই ১২ হাজার কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে। যারা বিক্রি করেন, তাদের মুনাফা কমিয়ে কি এই টাকা আসবে? এটা তো হাস্যকর
সবাই জানে ভ্যাট ভোক্তার থেকে যেটা নেওয়া হয়, তার পুরো অংকটা সরকারের কোষাগারে জমা হয় না। অনেকে ভ্যাট নিয়ে জমা দেন না। ওই ধরনের যে ফাঁকি, সেটা তো ভ্যাট অডিটিং কার্যক্রম শক্তিশালী করে.., সেখান থেকেও তো রাজস্ব আয় বাড়ানোর সুযোগ আছে। সম্ভব কতটা হবে, সেটা পরের বিষয়। চেষ্টা না করলে তো আমরা বুঝতে পারবো না। তো ওই ধরনের বিকল্পগুলো পুরোপুরি বিচার-বিবেচনা না করে তাড়াহুড়া করে এটা কেন করা হলো?
Advertisement
আমি ঠিক সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারবো না, তবে আমার অনুমান এটার জন্য আইএমএফের কর্মসূচির একটা ভূমিকা আছে। চতুর্থ কিস্তির (আইএমএফ ঋণের কিস্তি) ছাড়ের জন্য খুব অল্প সময়ের মধ্যে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কিছু পদক্ষেপ দেখাতে না পারলে কিস্তিটা হয়তো আটকে যেতে পারে। এ ধরনের একটা ঝুঁকি এড়ানোর জন্য এবং আইএমএফের কিস্তি যদি আটকে যায়, তাহলে বাজেট সহায়তার জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে প্রক্রিয়া চলছে, সেগুলোও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সেটাও হয়তো একটা কারণ। যার কারণে সব বিকল্প পুরোপুরি আমলে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো সময় পাওয়া যায়নি। এটা আমার অনুমান।
জাগো নিউজ: আমরা বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার কথা বলছি। সেখানে এই পদক্ষেপ সঠিক হলো কি না? কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ভ্যাট বাড়ানোর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে কি?
জাহিদ হোসেন: দারিদ্র্যসীমার ওপরে যারা আছেন, তারা যে খুব স্বস্তিতে আছেন তা তো নয়। কাজেই নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের আক্রান্ত করে এবং সামনে রমজান মাস আসছে, তারপর ঈদের মৌসুম। এ সময় তো মানুষ কেনাকাটা করতে চাইবে বেশি। এ সময়ে কাপড়, সাবান, ডিটারজেন্ট, ফলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর কর বাড়ালে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ অবশ্যই বাড়বে।
মানুষ যদি কেনাকাটা কমিয়ে দেয়, তাহলে হার বেড়ে বেজ তো কমে গেলো। যার ওপর বসাচ্ছেন, সেটা সংকুচিত হয়ে গেলো। তাহলে আপনার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি কতটা হবে? এই হিসাব-নিকাশ কি করা হয়েছে প্রতিটি আইটেম ধরে ধরে। সুচিন্তিতভাবে এটা করা হয়েছে, দেখে কিন্তু তা মনে হয় না
এই পদক্ষেপের কারণে ১২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে, আবার অন্যদিকে বললাম আপনার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। এই দুটি তো যায় না একসঙ্গে। আপনার ওই ১২ হাজার কোটি টাকা আসবে কোথা থেকে। যারা বিক্রি করেন, তাদের মুনাফা কমিয়ে কি এই টাকা আসবে? এটা তো হাস্যকর। বাস্তবতাকে স্বীকার করলে অসুবিধা কি? হাস্যকর বক্তব্য না দিলেই ভালো। হ্যাঁ আমি রাজস্ব আদায় বাড়িয়েছি, মূল্যবৃদ্ধি হবে কিন্তু আমার টাকা দরকার, না হলে বাজেট ঘাটতি হবে, অন্য সমস্যা হবে।
আরও পড়ুন যারা ভ্যাট বসাচ্ছেন তারা পণ্যের কস্ট অ্যানালাইসিস করেননি যেসব পণ্য কেনায় গুনতে হবে বাড়তি টাকা ইন্টারনেটসহ শতাধিক পণ্যে খরচ বাড়লোজাগো নিউজ: সাধারণ মানুষের ওপর যাতে চাপ না বাড়ে সে ধরনের পণ্যগুলো বাদ দিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেত কি?
জাহিদ হোসেন: যেমন সিগারেটের ওপর বাড়ানো নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই। প্লেনের টিকিট নিয়ে কারও কোনো আপত্তি নেই। এসি, হোটেল, রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রে ঠিক আছে। যারা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবার খান, তাদের হয়তো একটু অতিরিক্ত বিল দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু ফল, ওষুধ, সাবান, কাপড় এসব জায়গায় হাত দেওয়া ঠিক হয়নি। এখান থেকে রাজস্ব খুব বেশি পাবেন, তা আমার মনে হয় না। মানুষ যদি কেনাকাটা কমিয়ে দেয়, তাহলে হার বেড়ে বেজ তো কমে গেলো। যার ওপর বসাচ্ছেন, সেটা সংকুচিত হয়ে গেলো। তাহলে আপনার রাজস্ব আয় বৃদ্ধি কতটা হবে? এই হিসাব-নিকাশ কি করা হয়েছে প্রতিটি আইটেম ধরে ধরে। সুচিন্তিতভাবে এটা করা হয়েছে, দেখে কিন্তু তা মনে হয় না।
জাগো নিউজ: একদিকে করহার বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে মহার্ঘভাতা বাড়ানো হচ্ছে। এটা কি ঠিক আছে?
জাহিদ হোসেন: একদিকে করহার বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে মহার্ঘভাতাও বাড়ছে এটা দেখতে লাগে কেমন। এটা তো আমার চোখে লাগে। কার জন্য আপনি টাকা তুলছেন? মনে হচ্ছে আমলানির্ভরতাটা বেড়ে গেছে।
একদিকে করহার বাড়ানো হচ্ছে, অন্যদিকে মহার্ঘভাতাও বাড়ছে এটা দেখতে লাগে কেমন। এটা তো আমার চোখে লাগে। কার জন্য আপনি টাকা তুলছেন? মনে হচ্ছে আমলানির্ভরতাটা বেড়ে গেছে।
জাগো নিউজ: আইএমএফের চাপে যদি এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়, সেটা দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের জন্য এক ধরনের চ্যালেঞ্জ কি না?
জাহিদ হোসেন: আমি বলবো আমরা ঠিকমতো নেগোসিয়েশন করতে পেরেছি কি না। আইএমএফ কি বলেছে- কাপড়ের ওপর কর বাড়াও? আইএমএফ হয় তো বলেছে রাজস্ব আদায় বাড়াও বা ঘাটতি কমাও। কীভাবে কমাবে বা না কমাবে সেটা তোমাদের সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমার বটম লাইন হচ্ছে এই- রাজস্ব বাড়াতে হবে বা বাজেট ঘাটতি কমাতে হবে। আমার মনে হয় না আইএফএম ওই পর্যায়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে দিয়েছে, তবে আইএমএফের একটা চাপ ছিল এটা অনুমেয়।
জাগো নিউজ: একদিকে মূল্যস্ফীতি কমানোর কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে বিভিন্ন পণ্যের ভ্যাটের হার বাড়ানো হলো। এই পদক্ষেপের কারণে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে কি?
জাহিদ হোসেন: একদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক অবস্থানে আছে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য। অন্যদিকে রাজস্ব নীতিতে এ ধরনের পদক্ষেপ। এটা একটু সমন্বয়হীনতার একটা লক্ষণ এখানে দেখা যাচ্ছে।
এমএএস/এএসএ/এএসএম