শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এই সময়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দূষিত এলাকার তালিকায় উঠে আসে। বায়ুদূষণ শুধু পরিবেশ নয়, বরং মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
Advertisement
বায়ুদূষণের প্রতিকার ও করণীয় এবং কার্যকর সমাধান নিয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র ক্যাপসের চেয়ারম্যান আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাগো নিউজের নিজস্ব প্রতিবেদক রায়হান আহমেদ। আজ থাকছে সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব।
জাগো নিউজ: রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দূষণের মাত্রা কোথাও কম, কোথাও বেশি। এমনটি কেন হচ্ছে?
Advertisement
আহমদ কামরুজ্জামান: ঢাকা শহরের যে কোনো এক জায়গায় বায়ুদূষণ হলে সেটি খুব সহজে দ্রুত অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। তবে এখানে যেসব এলাকায় নির্মাণকাজ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বেশি, সেসব এলাকার বায়ু খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের ক্যাপসের গবেষণায় দেখা গেছে, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ যখন চলছিল, তখন ওইসব এলাকায় দূষণ বেশি ছিল। কিন্তু কাজ বন্ধ হওয়ার পর ওইসব এলাকায় দূষণ কমেছে।
আরও পড়ুনবায়ুদূষণ রোধে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আইনের প্রয়োগ জরুরি বায়ুদূষণের শীর্ষে ঘানার আক্রা, ঢাকা ৩ নম্বরে ঢাকায় বাইরের চেয়ে ঘরের বাতাসে মৃত্যুঝুঁকি বেশি একবছরে ঢাকায় গড়ে বায়ুদূষণ বেড়েছে ৯.৮ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ুদূষণ কেন এত বেশি?ঢাকা শহরে উচ্চ শ্রেণির মানুষ বেশিরভাগ গুলশান, বারিধারা কিংবা উন্নত এলাকায় বসবাস করেন। সেখানে কোনো নির্মাণ কাজ চললে প্রভাবশালীদের চাপ থাকে দ্রুত কাজ শেষ করার। এছাড়া সেখানে ধুলাবালি খুবই কম থাকে। অন্যদিকে অন্যান্য এলাকায় বিপরীতমুখী অবস্থা দেখা যায়।
জাগো নিউজ: বায়ুদূষণ রোধে সরকারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
আহমদ কামরুজ্জামান: যদি সব সংস্থা সংস্কার কাজের জন্য রাস্তা খননে একীকরণ প্রক্রিয়া বজায় রাখে, তবে সংস্কার বা উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে বায়ুদূষণ হ্রাস করতে পারে। শুষ্ক মৌসুমে দিনে দুবার সড়কে পানি দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপের মধ্যে রাস্তায় পানি ছিটানো বা স্প্রে করা অত্যন্ত কার্যকর। প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তায় প্রতি দুই থেকে তিন ঘণ্টা অন্তর নিজ উদ্যোগে পানি ছিটাতে বিল্ডিং কর্তৃপক্ষকে সিটি করপোরেশন অনুরোধ করতে পারে। এ কাজে বিল্ডিং কর্তৃপক্ষ এসি থেকে প্রাপ্ত পানি ব্যবহার করতে পারে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এবং কালো ধোঁয়া নির্গত যানবাহন আটক করা বায়ুদূষণ রোধে একটি কার্যকর কৌশল হতে পারে। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে গাড়ির জোড় ও বিজোড় নম্বর প্লেট অনুযায়ী অসম ড্রাইভিং বা বিকল্প দিনের চলাচলের প্রবর্তন করা যেতে পারে।
Advertisement
জাগো নিউজ: চলতি বছর পরিবেশ অধিদপ্তরে নতুন উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছেন। দূষণ রোধে তার কার্যক্রম কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আহমেদ কামরুজ্জামান: পরিবেশ উপদেষ্টা ইটভাটা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অবৈধ পলিথিন উৎপাদনের বিরুদ্ধে যে অভিযান চালাচ্ছে সেটাকে সাধুবাদ জানাই। তবে এগুলো এখন পর্যন্ত দূষণ নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত মনে হচ্ছে না। যদিও পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকবল সংকট ও লজিস্টিক সাপোর্টের অভাব রয়েছে। তবে চলমান দূষণবিরোধী অভিযান আরও বেশি টেকসই করতে হবে। এটাকে কন্টিনিউয়াস প্রসেস হিসেবে কাজ করতে হবে। শুধু শুষ্ক মৌসুমে যে অভিযান করবে তা নয়, সারা বছরই এই কাজগুলো করতে হবে। তবে এর সুফল জনগণ ভোগ করবে।
জাগো নিউজ: রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক কোন দিকগুলো বায়ুদূষণ রোধে সমস্যা সমাধানে বাধা তৈরি করছে?
আহমদ কামরুজ্জামান: দূষণ রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি মন্ত্রণালয় কীভাবে দূষণ নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটি সেই রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট বা মেনিফেস্টোর প্রতিফলনে বোঝা যায়। কাজেই সরকার এসব কাজে কতটা আগ্রহী বা আন্তরিক সেটা তার বার্ষিক বাজেটে বোঝা যায়। আমরা লক্ষ্য করছি, জাতীয় বাজেটে পরিবেশের জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের চেয়ে বরাদ্দ কম। ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা দিয়ে এনফোর্সমেন্ট খুবই কষ্ট। তাই রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরি। অন্যদিকে আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতাও জরুরি।
আরও পড়ুন
দেশে অকাল মৃত্যুর ২০ শতাংশেরই কারণ বায়ুদূষণ: বিশ্বব্যাংক বায়ু দূষণে ভারতে মিনিটে দু’জনের মৃত্যু বায়ুদূষণ রোধে অভিযানে ২০ ইটভাটাকে কোটি টাকার বেশি জরিমানা নববর্ষের প্রথম দিন ঢাকার বায়ু ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ নববর্ষ উদযাপনে ৭ বছরে বায়ুদূষণ বেড়েছে ১৯ শতাংশসামাজিকভাবে যেখানে দূষণ দেখবে সেখানে আন্দোলন তৈরি করতে হবে। কারণ যে সংস্থা কাজ করবে, তারা যদি কমিটেড অনুযায়ী পরিবেশবিধি মেনে চলে তাহলে সে অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হবে। তাই সিভিল সোসাইটির সতর্কতা খুবই জরুরি। কার্যকরী এনভায়রনমেন্টাল অডিট জরুরি।
জাগো নিউজ: জনগণ কীভাবে ব্যক্তিগতভাবে বায়ুদূষণ রোধে ভূমিকা রাখতে পারে?
আহমদ কামরুজ্জামান: জনগণকে ব্যক্তিপর্যায়ে দূষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। বায়ুদূষণের তথ্য-উপাত্ত সম্পর্কে নিজেকে আপডেট রাখতে হবে। বায়ুদূষণের ছয়টি উৎসের মধ্যে অন্যতম মেজর ফ্যাক্টর হলো বর্জ্য পোড়ানো। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিপর্যায়ে বর্জ্য পোড়ানোর অনেক প্রবণতা আছে। এসব কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে।
জাগো নিউজ: বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে উন্নত দেশগুলোর কোনো সফল উদ্যোগ কি বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করা সম্ভব?
আহমদ কামরুজ্জামান: যেসব রাষ্ট্র দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে সফল হয়েছে এবং যারা ব্যর্থ হয়েছে সবার অভিজ্ঞতা দেখতে হবে। আমরা পর্যালোচনা করে দেখেছি, ১৯ শতকে আমেরিকান টেরিটরিতে কয়লাভিত্তিক কার্যক্রমের কারণে দূষণ বেশি ছিল। পরে তারা তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করে দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। একই অবস্থা ছিল ইউরোপেও। পরে তারাও ১৯৫০ এর পর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। ২০০০ সালের দিকে দূষণ শিফট হয় চীন ও ভারতে। এরপর ২০১০ সালের দিকে আমরা দেখেছি, নীতি বাস্তবায়ন ও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে চায়নিজ সিটিগুলো বিশ্বের অন্যতম বিশুদ্ধ শহরে পরিণত হয়েছে। তাদের মধ্যে জনসচেতনতা ছিল। বাংলাদেশ উন্নত বিশ্বের মডেল প্রয়োগ করতে পারে বা বিশেষজ্ঞ এনে আমাদের পরিস্থিতি বুঝে পলিসি তৈরি করতে পারে।
আরও পড়ুন
শিশুদের শরীর-মনে প্রভাব ফেলছে বায়ুদূষণ, বাড়ছে রোগবালাই শীতে বেড়েছে ঠান্ডাজনিত রোগের প্রকোপ, বেশি ভুগছে শিশুরা ছুটির দিনেও খুবই অস্বাস্থ্যকর ঢাকার বায়ু বায়ুদূষণে বাড়ছে হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি, বলছে গবেষণা রাজশাহীতে তিন বছরে বাতাসে ধূলিকণা বেড়েছে ৬৪ শতাংশজাগো নিউজ: বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বায়ুদূষণের সম্পর্ক কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?
আহমদ কামরুজ্জামান: বায়ুদূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন একই মুদ্রার দুটি পিঠ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো আবার দূষণের কারণ। যেমন: মিথেন অন্যতম একটি সোর্স। আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ঘাটতির কারণে প্রচুর পরিমাণে মিথেন জেনারেট হচ্ছে। আর এই মিথেন কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে ৮০ গুণ শক্তিশালী একটি গ্রিনহাউজ গ্যাস। এই মিথেন শরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা যদি বায়ুদূষণের একেকটা সোর্স পর্যালোচনা করি দেখব যে, এগুলো প্রতিটি সোর্স প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের করালগ্রাস কমাতে হলে বায়ুদূষণ কমাতে হবে। কারণ এই দূষণগুলোই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ধারণ করে। এর প্রভাবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যায়, দুর্যোগ সৃষ্টি হয়, মানুষ অভিবাসী হয়ে যায়।
জাগো নিউজ: শহরে অতিরিক্ত মানুষ বায়ুদূষণের জন্য কতটা দায়ী?
আহমদ কামরুজ্জামান: শহরের মানুষ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর অন্যতম সোর্স হলো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে অভিবাসীর সংখ্যা। শহরে মানুষ এলে তাদের জন্য ঘরবাড়ি প্রয়োজন হয়। ইট উৎপাদনে দূষণ হয়, সিমেন্ট উৎপাদনে দূষণ হয়। আবার যত বেশি মানুষ, তত বেশি রান্না-রান্নার ধোঁয়া। শহর যখন অতি ঘনবসতিপূর্ণ হয়, তখন প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে আবার কয়লা, জ্বালানির দরকার হয়, যেটা দূষণের অন্যতম কারণ। আবার বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিলে প্রচুর জেনারেটর দরকার হয়। জেনারেটর চালাতে গিয়ে ফুয়েল বার্ন করতে হয়। এসব কারণেই দূষণ বেশি বাড়ে। এই টোটাল বিষয়টা একটা দুষ্টচক্র।
আরও পড়ুন
বায়ুদূষণ রোধে কাজ করবে টাস্কফোর্স: পরিবেশ উপদেষ্টা ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবলে দিল্লি, বন্ধ হলো প্রাথমিকে সশরীরে ক্লাস বায়ুদূষণে পাকিস্তানের ১ কোটি ১০ লাখেরও বেশি শিশু ঝুঁকিতে: ইউনিসেফ গাঢ় ধোঁয়াশায় ঢাকা দিল্লিতে প্লেন চলাচল বিঘ্নিত, বায়ু মান ‘গুরুতর’ কর্মকর্তাদের সন্তানরা বিদেশে, তাই বায়ুদূষণ নিয়ে মাথাব্যথা নেইজাগো নিউজ: আন্তঃসীমান্ত দূষণের প্রভাব কমানোর উপায় কী?
আহমদ কামরুজ্জামান: আমাদের দেশে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দূষিত বাতাস আসে। ফলে আমাদের দূষণ আরও বেড়ে যায়। ভারতের মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, দিল্লিতে যখন শস্য তোলার পর শস্যের খড় পোড়ানো হয়, তখন দূষিত বায়ু হাজার কিলোমিটার দূরে চলে আসে। আমাদের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে আগে আক্রান্ত হয়। এরপর ধীরে ধীরে ঢাকায় আসে। এই দূষণের পরিমাণ বার্ষিকভাবে কোনো অংশে ১০ শতাংশের কম নয়। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ করতে হবে। এছাড়াও পাকিস্তান, নেপাল থেকেও দূষিত বাতাস দেশে প্রবেশ করে। এই জন্য আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা খুবই জরুরি।
আরএএস/এমএমএআর/জেআইএম