জাতীয়

ইউনূস-মোদীর বৈঠকে সম্পর্কের বরফ কি গলবে?

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আসন্ন বৈঠক নিয়ে জোর আলোচনা দুই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। কার্যত ৫ আগস্টের পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক অনেকটা শীতল। ভিসা জটিলতা এখনো কাটেনি। যদিও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে খুব বেশি প্রভাব পড়েনি। এর মধ্যে এই বৈঠককে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছেন বিশ্লেষকরা।

Advertisement

থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে আগামী শুক্রবার (৪ এপ্রিল) অনুষ্ঠিত হবে বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক) সম্মেলন। এ সম্মেলনের সাইডলাইনে প্রতিবেশী দুই দেশের সরকারপ্রধানের এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে বলে নিশ্চিত করেছে দিল্লি। এ খবর জানিয়েছে বার্তা সংস্থা ইউএনবি। সব ঠিক থাকলে ড. ইউনূস দায়িত্ব নেওয়ার পর এটা হবে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রথম বৈঠক। এ বৈঠক থেকে সম্পর্কের বরফ কিছুটা হলেও গলবে কি না তার দিকে তাকিয়ে আছে দুই দেশের মানুষ।

এর আগে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা বিষয়ক উপদেষ্টা ও বিশেষ দূত ড. খলিলুর রহমান বুধবার (২ এপ্রিল) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দুই দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার জোর সম্ভাবনার কথা জানান। সপ্তাহখানেক আগেও একই ভেন্যুতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা দেখছেন না বলে জানালেও আজ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বৈঠকের সম্ভাবনা ও এর কারণ ব্যাখ্যা করেন তিনি।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের মুখে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও ভারতের মধ্যে অঘোষিত শীতল সম্পর্ক শুরু হয়। কূটনৈতিকভাবে দুই দেশের সরকার এ সম্পর্কের কথা স্বীকার না করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। আসন্ন বিমসটেক সম্মেলনে সাতটি দেশের সরকারপ্রধান অংশগ্রহণ করলেও মূলত সবার নজর থাকবে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান অধ্যাপক ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকে। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ বৈঠক বেশ গুরুত্ববহ।

Advertisement

যে কারণে ইউনূস-মোদীর বৈঠকের সম্ভাবনা বেশি

বাংলাদেশ বিমসটেকের পরবর্তী চেয়ারম্যানশিপ পাচ্ছে। সরকারপ্রধান হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ৪ এপ্রিল চেয়ারম্যানের দায়িত্ব বুঝে নেবেন। চেয়ারম্যানের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর প্রচলিত প্রথা ও রীতি অনুযায়ী তিনি সদস্য দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সঙ্গে বিমসটেকের উন্নয়নে আগামী দিনগুলোতে করণীয় কার্যক্রম নিয়ে সাইডলাইনে আলোচনা করবেন। এরই অংশ হিসেবে ইউনূস-মোদী বৈঠকের জোর সম্ভাবনার কথা বলেন ড. খলিলুর রহমান।

আরও পড়ুন

বাংলাদেশে ‘অস্থিরতা’ তৈরির হুমকি ত্রিপুরার নেতার সেভেন সিস্টার্স নিয়ে ড. ইউনূসের মন্তব্যে ভারতে তীব্র প্রতিক্রিয়া চীনের মডেলে ‘শিল্পায়নের কেন্দ্রস্থল’ হতে চায় বাংলাদেশ

প্রধান উপদেষ্টা ও নরেন্দ্র মোদীর বৈঠক প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার মনে হয় না বৈঠকের মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন হবে। ভারতের সঙ্গে এমনি আমাদের ওয়ার্কিং রিলেশন তো আছেই। এমন না যে কোনো কিছু থেমে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক যে ভারতের কম্ফোর্টেবল জোনটা চলে গেছে। সেটা তো একটা বড় ব্যাপার আছেই। তবে ভারতের মিডিয়ায় যা হচ্ছে সে ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সব মিডিয়া তো এক নয়। কিছু কিছু মিডিয়া এমনটা করছে। অফিসিয়াল বিষয়গুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রিলেশনশিপগুলো চলছে, বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখছি না।’

Advertisement

আমেনা মহসিন এটাও মনে করেন, ‘বাংলাদেশের জন্য পলিসি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারা আগামী নির্বাচন বাংলাদেশে কীভাবে হয় সেটা পর্যন্ত দেখতে চাচ্ছে। কারণ, ভারতেরও বাংলাদেশের প্রয়োজন রয়েছে। এটা দ্বিপাক্ষিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপার। ওরা কখনোই বাংলাদেশের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক হোক তা চাইবে না। তারা একটি নির্বাচনী সরকারের জন্য অপেক্ষা করবে।’

একই ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) প্রধান উপদেষ্টা ও একটি বড় দল ব্যাংককের বিমসটেক সম্মেলনে যাবেন। আঞ্চলিক দেশগুলোর অংশগ্রহণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সফর হবে।

এটা ঠিক যে ভারতের কম্ফোর্টেবল জোনটা চলে গেছে। তবে ভারতের মিডিয়ায় যা হচ্ছে সে ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সব মিডিয়া তো এক না। কিছু কিছু মিডিয়া এমনটা করছে। অফিসিয়াল বিষয়গুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে রিলেশনশিপগুলো চলছে, বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখছি না।- আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন

এসময় প্রধান উপদেষ্টার সম্মেলনে অংশগ্রহণ ও বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি।

শফিকুল আলম জানান, আগামীকাল (৩ এপ্রিল) ও শুক্রবার (৪ এপ্রিল) বিমসটেক সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য প্রধান উপদেষ্টা ব্যাংকক যাচ্ছেন। সম্মেলনে অংশগ্রহণ ছাড়াও তিনি আরও কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। এর মধ্যে বিমসটেক ইয়াং জেনারেশনস প্রোগ্রামে তিনি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন। এছাড়া তিনি টিআইএন ওয়ার্ল্ড, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, ব্যাংকক পোস্টসহ বেশ কয়েকটি মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেবেন।

তিনি বলেন, ‘এবারের সম্মেলনের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত, বিমসটেক ২৫ বছর ধরে বিদ্যমান থাকলেও তার কর্মকাণ্ড আরও বিস্তৃত ও শক্তিশালী হওয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেই উদ্দেশ্যে বিমসটেক ব্যাংকক ভিশন-২০৩০ কৌশলপত্র এবারের সম্মেলনে গৃহীত হবে। এর মূল লক্ষ্য সমৃদ্ধ, স্থিতিশীল ও উন্মুক্ত বিমসটেক গড়ে তোলা। এর প্রায়োরিটি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্য নিরসন, সমস্যা সমাধান, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ, পারস্পরিক সহযোগিতা ও ক্লাইমেট অ্যাকশন।’

‘বিমসটেকের দিকনির্দেশনার জন্য একটি ইমিনেন্ট পার্সন গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল। তার রিপোর্টটি এ সম্মেলনে গৃহীত হবে। সেখানে সাতটি কর্মক্ষেত্র বা পিলার চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো- কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা, সংযুক্তি, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন, পারস্পরিক যোগাযোগ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন, নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন।’ সম্মেলনের শেষ দিন থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে ন্যস্ত হবে।

এরপর থেকে বিমসটেক পরিচালনার প্রধান ভূমিকায় থাকবে থাকবে বাংলাদেশ। সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা বিমসটেকের সদস্য দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন। এছাড়া তিনি দুটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সময় উপস্থিত থাকবেন। বিমসটেকের চুক্তি হলো মেরিটাইম ট্রান্সপোর্ট কো-অপারেশন। একই সঙ্গে থাইল্যান্ডের সঙ্গে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সমঝোতা স্মারক সই হবে। এসময় প্রধান উপদেষ্টা ও থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন।

নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সাইডলাইনে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বৈঠকের জন্য সরকারিভাবে অনুরোধ করেছি। আমাদের আশা করার সঙ্গত কারণও রয়েছে। বৈঠকটি হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আঞ্চলিক জোটগুলো সব দেশের শক্তি এক জায়গায় করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে প্রচেষ্টা করে। প্রথমত, আমাদের এ অঞ্চলে কানেক্টিভিটি একটি প্রধান বিষয়। আঞ্চলিক সহযোগিতা ছাড়া এটা করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে সেটাও এ অঞ্চলের ছোট ছোট দেশগুলোর পক্ষে এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। যখন জোটবদ্ধভাবে সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন তাতে সমাধানের সম্ভাবনা বাড়বে।’

‘যদিও গত ২৫ বছরে বিমসটেকের উল্লেখযোগ্য ফুটপ্রিন্ট দেখতে পাইনি তবুও এবার কিছু কিছু ফোকাস এরিয়া নির্দিষ্ট রয়েছে। আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে বাস্তবসম্মত কার্যক্রম তৈরি করার মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে এগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। আঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে যা করা যায় তা একক রাষ্ট্রের পক্ষে করা খুবই দুরূহ।’ বলেন শফিকুল আলম।

প্রেস সচিব আরও বলেন, ‘কানেক্টিভিটি এ অঞ্চলের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। বিশেষ করে যাদের সমুদ্রে অ্যাক্সেস পাওয়া কঠিন, আমরা কিন্তু কানেক্টিভিটি কারও ওপর জোর করে চাপিয়ে দেবো না, দেওয়ার অবস্থা আমাদের নেই।’

১৯৯৭ সালের ৬ জুন ব্যাংকক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাতটি দেশ (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ড) নিয়ে বিমসটেক আঞ্চলিক জোট গঠিত হয়।

এমইউ/এএসএ/এমএস