সাহিত্য

নাগরীলিপির একটি সাহিত্যখনি আছে: মোস্তফা সেলিম

মোস্তফা সেলিম একজন গবেষক ও সম্পাদক। ১৯৭০ সালের ৮ জুন মৌলভীবাজারের বড়লেখায় জন্ম। লেখালেখির বিষয় ফোকলোর, নাগরীলিপির পুঁথিসাহিত্য এবং মুক্তিযুদ্ধ। মোস্তফা সেলিম নাগরীলিপি ও সাহিত্যের পুনরাবর্তনের উদ্দেশ্যে কাজ করে একে বিলুপ্তির কবল থেকে রক্ষা করেছেন। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে নাগরীলিপিতে রচিত আদিগ্রন্থ গোলাম হুসনের গান (১৭৭৪)। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া এবং বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষের অন্যতম গবেষক তিনি। সম্পাদনা করেন মাসিক ভ্রমণচিত্র। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘গিয়াসউদ্দিন আহমদ গীতিসমগ্র’, ‘সিলেটি নাগরীলিপি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’, ‘সিলেটি নাগরীলিপি সাহিত্যের প্রণয়োপাখ্যান’, ‘সিলেটি নাগরীলিপির সহজপাঠ’, ‘সিলেটি নাগরীলিপি নবজীবনের জার্নাল’, ‘সিলেটি নাগরীলিপি সাহিত্য চরিতাবিধান’, ‘সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষা’, ‘নাগরীগ্রন্থসম্ভার (যৌথ সম্পাদনা)’, ‘মুন্সী সাদেক আলীর মহব্বত নামা’, ‘মুন্সী সাদেক আলীর কেতাব হালতুননবী’, ‘মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা’, ‘বাংলাদেশ ভ্রমণসঙ্গী’, ‘ভারত নেপাল ভুটান ভ্রমণসঙ্গী’, ‘সিলেট বিভাগের লেখক অভিধান’, ‘আপন আলোয় আছদ্দর আলী’ প্রভৃতি। গুণী এই গবেষক ও সম্পাদকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ কবি ও গবেষক বঙ্গ রাখাল—

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনার বেড়ে ওঠা কোথায়? লেখালেখির জীবনে এই পরিবেশের প্রভাব কতটুকু বলে মনে করেন?মোস্তফা সেলিম: আমার জন্ম মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা উপজেলায়। বড়লেখা অনিন্দ্য সুন্দর এক সমৃদ্ধ জনপদ। টারশিয়ারী যুগের পাথারিয়া পাহাড়, প্রায় ২৫ কিলোমিটার যার দৈর্ঘ, সেই পাহাড়ের বুক চিড়ে প্রবাহিত মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি, দেড় ডজন চা বাগান, একাধিক নৃগোষ্ঠীর আবাস, আগর আতর শিল্প, হস্তশিল্প, মুঘল রাজ দরবারে সমাদৃত এই অঞ্চলের শীতল পাটি, সিপাহী বিদ্রোহ, কৃষক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ গৌরবময় রাজনৈতিক ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ এই জনপদে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত হলে আমি এই সবুজের মায়ামহল ছেড়ে কয়েক বছরের জন্য শহরবাসী হই। পড়ালেখা শেষে আবার এই মায়ামহলে ফিরেছি। তারপর একটা সময়ে চলে আসি নগর ঢাকায়। এই পাহাড়, টিলা, নদী-হাওর, সমতল ভূমির ত্রিবেণী সঙ্গমে বহু-সংস্কৃতি, নৃগোষ্ঠী এবং বাঙালি সংস্কৃতির মিলিত সমারোহে কেটেছে বেলা। এই মিথস্ক্রিয়ায় সহজিয়া জীবনবোধ তৈরি হয়েছে আমার। গ্রামে জন্মেছি বলেই আমি গ্রামীণ লোকজীবনকে ছেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। লোক মানুষের সঙ্গে একারণেই তৈরি হয়েছে আমার জীবনের গাটছড়া।

জাগো নিউজ: সিলেটি নাগরীলিপি নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন, এই আগ্রহ তৈরির পেছনের কারণ কী?মোস্তফা সেলিম: সিলেটি নাগরীলিপি বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে চালু হয়েছিল চতুর্দশ শতকে, বাংলা বর্ণমালাকে সম্পাদনা করেই। এ ছিল সহজ ও সংক্ষিপ্ত এক লিপিমালা। বাংলা বর্ণমালার ১৭টি বর্ণকে বাদ দিয়ে ৩৩টি বর্ণ নিয়ে এই বর্ণমালা গৃহীত হয়েছিল। বর্ণাকৃতি মৌলিক এবং বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এই বর্ণমালা প্রবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল ভাষা চর্চায় গতি বৃদ্ধি। উদ্ভাবনকারীরা ফলও পেয়েছিলেন হাতেনাতে। বঙ্গের উত্তরাঞ্চলে একটা সময়ে ব্যাপক চর্চা ছিল এই লিপির। এই লিপিতে দুই শতাধিক পুঁথি রচিত হয়েছিল। চারটি ছাপাখানা এই নাগরীলিপির পুঁথি ছাপার কাজে ব্যস্ত ছিল। নাগরীলিপির প্রভাবে সিলেট অঞ্চলে বাংলালিপি অনেকটাই গুটিয়ে ছিল। বাংলালিপির ব্যাপক প্রভাবে গত শতাব্দীতে প্রায় লুপ্ত হয়ে যায় সিলেটি নাগরীলিপি। আমার জানা ছিল, এই নাগরীলিপির একটি সাহিত্যখনি আছে। এই খনি উপেক্ষিত। এই খনির মণিমাণিক্য পাঠকের সামনে উপস্থাপনের জন্য সিলেটি নাগরীলিপি গবেষণা ও প্রকাশনার মাধ্যমে এর নবজাগরণের কাজে হাত দিয়েছিলাম ২০০৯ সালে। নাগরীলিপি ভাষালিপির ইতিহাসে যুক্ত করেছে এক গৌরবের পালক।

জাগো নিউজ: আপনি তো পুঁথিসাহিত্য নিয়েও কাজ করছেন। এটি আমাদের জীবনে কতটুকু গুরুত্ব বহন করে? কিংবা এ থেকে আমরা কী তথ্য পেতে পারি বলে মনে করেন?মোস্তফা সেলিম: পুঁথিসাহিত্য হচ্ছে আমাদের আত্মপরিচয়ের একটি আয়না। এই আয়নায় পুরো মধ্যযুগকেই আমরা অবলোকন করতে পারি। মধ্যযুগের সাহিত্য সাধনা ছিল পুঁথি বা কাব্যরীতিতে। তখন তো গদ্যসাহিত্য বিকশিত হয়নি। বড় কাহিনিকে আখ্যান কাব্যে প্রকাশ করেছিলেন সে সময়ের কবিরা। এই পুঁথি সাহিত্যই মধ্যযুগের সাহিত্যের নির্দশন বহন করে। জীবন, জগৎ এবং সে সময়ের মানুষের দার্শনিকতা উঠে এসেছে কাব্যগুলোতে। আমাদের সাহিত্যের যে পরম্পরা; সেই পরম্পরাটা পুঁথিসাহিত্যকে বাদ দিয়ে কল্পনাও করা যাবে না। পুঁথি আমাদের সংস্কৃতির ধারক-বাহক। পুঁথি সাহিত্যের মধ্যে মধ্যযুগকে দেখা ছাড়া উপায় নেই।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনি ভেলা শাহ ফকিরকে নিয়ে কাজ করেছেন, তাঁর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাই—মোস্তফা সেলিম: ভেলা শাহ আমাদের মরমি জগতের ধ্রুবতারা। এই মরমি কবি ও সাধক সিলেটি নাগরীলিপিতে তাঁর সমুদয় পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন। তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমী মানুষ। তাঁর বাড়ি সিলেট জেলার বালাগঞ্জ উপজেলার ‘চক পিরপুর’ গ্রামে। সংসারবিবাগী এই মহাজন রচনা করেছেন অসাধারণ সব গান। বাড়ির পাশে বড়ভাগা নদীতেই ভেলায় চড়ে সমস্ত দিন ভেসে বেড়াতেন তিনি। সেখানেই বস্তুজগৎ থেকে আলাদা হয়ে ভাবের মধ্যে প্রবেশ করে উদাসীন চিত্তে গান রচনা করে গাইতেন। তাঁর গানে ছিল অসাম্প্রাদায়িক এক আধ্যাত্ম সুর। ধর্মনির্বিশেষে তিনি পরমাত্মাকে বন্ধু হিসেবে পাওয়ার ব্যাকুলতায় গান লিখেছেন। তাঁর একটি বই ‘খবর নিশান’। এই দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছি ২০১৮ সালে। সিলেটি নাগরীলিপির পাশাপাশি বাংলালিপিতে লিপ্যন্তর যোজন করে বইটি উপস্থাপন করেছি। ভেলা শাহের জন্ম ও মৃত্যু সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে তিনি যে ঊনিশ শতকের কবি—এর প্রমাণ অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধির শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (১৯১০) গ্রন্থটি, গ্রন্থে ভেলা শাহের উল্লেখ পাই। ভেলার শাহের একটি গানের দিকে চোখ বোলালেই তাঁর দর্শন বোঝা যায় অতি সহজে। তাঁর একটি গান: ‘মনে উটে অনেক জ্বালা/ ভাবিতে চিন্তিতে রাদার তনু কালা/ ঘরে বএরি দারুন ননদিনি রে/ শশুড়ি হইল পরানের বএরি/ ঘরের বার না হইতে পারি/ লুকে বুলে রাদা কলংকিনি রে/ মুই নারি ওবুলা/ দএআ কর শাম কালা রে/ শংগে নেও অবুলা রাদারে/ গকুলের লুকে বলে আর/ পিরিতি হইল রাদার গলার হার।’

জাগো নিউজ: বাংলা মরমি গানের আদি পাণ্ডুলিপি গোলাম হুসনের গান আপনি সম্পাদনা করেছেন। এটি কীভাবে আবিষ্কৃত হলো? এই গোলাম হুসনের গানের সন্ধান কীভাবে পেলেন?মোস্তফা সেলিম: গোলাম হুসনের গান সম্পাদনা আমার জীবনের এক বড় ঘটনা। বাংলা মরমি গানের আদি এই পাণ্ডুলিপি সিলেটি নাগরীলিপিতে রচিত। মূল পাণ্ডুলিপির নাম তালিব হুসন। এই পাণ্ডুলিপির গানগুলোকে আমি সংকলন করেছি গোলাম হুসনের গান নামে। এটি উৎস প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে। গান এবং নসিহত সম্বলিত পূর্ণাঙ্গ তালিব হুসন প্রকাশিত হবে সহসাই। এর সম্পাদনা কাজে গত কয়েক বছর আমি ছিলাম উদয়াস্ত ব্যস্ত। গোলাম হুসন (১৬৯৪) তালিব হুসন রচনা করেছেন ১৭৭৪ সালে। ২৪৬ বছর সেই পাণ্ডুলিপিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। এটি ছিল অন্তরালে, লোকচক্ষুর আড়ালে। ২০১৮ সালে আমি লন্ডন সফরকালে বার্মিংহাম শহরের বাসিন্দা মোহাম্মদ আব্দুল হামিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করি পাণ্ডুলিপিটি। চারশ’র বেশি পৃষ্ঠা সম্বলিত পাণ্ডুলিপিটি বাংলা মরমি গানের ইতিহাস বদলে দিয়েছে। মরমি গানের ইতিহাসে গোলাম হুসন এখন নব আবিষ্কৃত এক মহাজন, যিনি বৃহৎবঙ্গের মরমি গানের উৎসমুখ। পথিকৃৎ মহাজন। মহামতি লালন সাঁইয়ের পূর্বে যে কয়েকটি নাম বসে, এই তালিকার সর্বাগ্রে স্থান নিয়েছেন তিনি। মহামহিম হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর হাজার বছরের পুরান বাংলা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোঁহা যেমন বাংলালিপির আদি নিদর্শন; তেমনই সিলেটি নাগরীলিপির আদি নমুনা গোলাম হুসনের গান। দুটো পাণ্ডুলিপির বিষয়েও রয়েছে দারুণ মিল, দুটোই অধ্যাত্ম সংগীত। একটি বৌদ্ধ সহজিয়াদের হাতে রচিত, অন্যটি মুসলমান মরমি কবির রচনা।

জাগো নিউজ: গিয়াস উদ্দিন আহমেদের গান সংগ্রহের পেছনের ঘটনা জানতে চাই—মোস্তফা সেলিম: গিয়াসউদ্দিন আহমদ (১৯৩৫) মরমি জগতের গুরুত্বপূর্ণ সাধক ও কবি। গিয়াসউদ্দিন আহমদ মৃত্যুবরণ করেন ২০০৫ সালে। আমার সম্পাদিত ‘গিয়াসউদ্দিন আহমদ গীতিসমগ্র’তে সংকলিত গানের সূত্র লেখকের পরিবার। তারাই আমাকে সরবরাহ করেছেন তার পাণ্ডুলিপি। মরমি গীতিকবি গিয়াসের কিছু গান বিশেষত কেচ্ছা গান, সিলেটে বেতারের আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত।

আরও পড়ুন

Advertisement

বইয়ের মূল্য সাশ্রয়ী হওয়া উচিত: রাসেদ শিকদার বইকে আমি সন্তান মনে করি না: নির্জন

জাগো নিউজ: নাগরীলিপি বা লোকসাহিত্য আমাদের কী উপকারে আসবে বলে মনে করেন?মোস্তফা সেলিম: নাগরীলিপির সাহিত্য বলে যে সাহিত্যকে অনেকেই আলাদা করে দেখতে চাইছেন, আদতে এটি বাংলা সাহিত্যই। তফাৎ শুধু এই—সিলেটি নাগরীলিপিতে লেখা। সৈয়দ শাহনূর বা গোলাম হুসনের গানের ভাষা সিলেটি বাংলা। লিপিবদ্ধ হয়েছে সিলেটি নাগরীলিপিতে। সৈয়দ শাহনূরের ‘বন্ধুর তোর লাগিয়ারে আমার তনু জর জর/ মনে লয় ছাড়িয়া যাইতাম থুইয়া বাড়ি ঘর’ গানটিকে কীভাবে বাংলাভাষার মানুষের অধিকার থেকে সরিয়ে ফেলবেন। এই গানটিই তো গৌতম ঘোষ তাঁর মনের মানুষ সিনেমায় ব্যবহার করেছেন বাংলাভাষি মানুষদের দর্শনের জন্য। হূমায়ুন আহমেদ তাঁর ঘেটুপুত্র কমলা সিনেমায় ব্যবহার করেছেন নাগরীলিপির সাধক কবি শীতালং ফকিরের ‘শুয়া উড়িল জীবেরও জীবন’ গানটি। বৃহৎবঙ্গের এক বিরাট অঞ্চলের মানুষের সাহিত্য ও জীবনচর্চা তো নাগরীলিপিতেই হয়েছে। এগুলোকে আলাদা করা মানেই আমাদের চিন্তার পরম্পরাকে বিভক্ত করা। বাংলার ভাষালিপির গৌরবকে খাটো করা।

জাগো নিউজ: লোকসাহিত্যের ভবিষ্যৎ কেমন হবে বলে মনে করেন?মোস্তফা সেলিম: মানুষ শেষমেষ শেকড়েই ফেরে। মধ্যে সে বিভ্রান্ত উপত্যকায় ঘেরাটোপে বন্দি একটা সময় কাটিয়ে আত্মপোলব্ধিতে পৌঁছে, সে তার শেকড়কে সত্য ও অনিবার্য বলে বুঝতে শেখে। আমাদের লোকসংস্কৃতি হচ্ছে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতিরই প্রকাশ। এখানেই তার পরিচয়, এখানেই তার সমৃদ্ধি। একটু মনস্ক হয়ে তাকালেই দেখতে পাবেন মানুষ ফের শেকড়েই ফিরতে শুরু করেছে। আপনি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতেই দেখুন, তারা টিআরপির জন্য ফিরেছে লোকগানে। প্রতিটি চ্যানেলে রাতে আয়োজন হয় লোকগানের আসর। রাতে মানুষ এখন ঘুমাতে যায় তার চিরচেনা লোকসুরের গান শুনে। দারুণভাবে একটা ইউটার্ন হচ্ছে মানুষের। পশ্চিমা অনুগামী সংস্কৃতিতে বাঙালি মনের সুখ পায় না। বাংলার মানুষের মন ভরে সহজিয়া সুরে, অনাড়ম্বর বাণীতে। পল্লির গান তার মর্মে বিঁধে। লোকমানুষের সংস্কৃতি তার বড় আপন। ফলে যা কিছু আমদানি হয়েছিল, তার এখন অন্তিমকাল চলছে। সামনেই সুদিন। লোকসাহিত্যই আমাদের পথ দেখাবে। আমাদের লোকসাহিত্যের বৈচিত্র্যই বলে দেয়, জাতি হিসেবে আমরা কতটা সমৃদ্ধ।

জাগো নিউজ: এটি নিয়ে এখনো সেভাবে গবেষকদের আগ্রহ সৃষ্টি না হওয়ার কারণ কী বলে মনে করেন?মোস্তফা সেলিম: বাঙালির লোকসংস্কৃতির প্রতি নিদারুণ অবহেলা গেছে বিগত কয়েক দশকে। একে নিদান কালই বলবো। আমাদের পল্লির গানকে সরিয়ে ডিস্কো, রক, ব্যান্ড ইত্যাদি স্থান করে নেওয়ার প্রয়াস ছিল। কিন্তু সেই স্রোত এখন ম্রিয়মান। মানুষের নিজের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কোনো আয়োজনই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এ তো আমরা চোখের সামনেই দেখছি। এখন লোকসংস্কৃতির প্রতি নতুনভাবে মানুষ আকৃষ্ট হচ্ছেন। দেশে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ফোকলোর বিভাগ চালু হয়েছে। গবেষকের সংখ্যা বাড়ছে। লোকসংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ প্রকাশিত হচ্ছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। বইপত্রও প্রকাশিত হচ্ছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, বাঙালি তার লোকসংস্কৃতির মূলে আবার ফিরতে শুরু করেছেন। মানুষ যতই মূলে প্রত্যাবর্তন করবে, ততই লোকসংস্কৃতির চর্চা বাড়বে।

জাগো নিউজ: এত বিষয় থাকতে লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করছেন কেন?মোস্তফা সেলিম: লোকজীবন থেকেই উঠে এসেছি। আমরা গ্রামের সন্তান। কাদা মাটি আমার শরীরের কোষে কোষে। এটা আমি ভুলি কী করে! আমার জন্ম একটা প্রান্তিক এলাকায়। এই প্রান্তের মানুষের জীবনচর্চা ও জীবনবোধ থেকেই আমি প্রাণিত হয়েছি। তাদের দেখেই শিখেছি কীভাবে জীবনকে সহজভাবে কিন্তু তৃপ্ত হয়ে উদযাপন করা যায়। দেখেছি কত সহজে লোকমানুষ প্রকাশ করতে পারেন তাদের চিন্তা ও ভাব দর্শন। বিষয়টি আমাকে গভীরভাবে টেনেছে। ফল হচ্ছে, লোকজীবনের সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। শেকড়ের মানুষের সঙ্গে পরিচয়সূত্রে আমার লোকসংস্কৃতি চর্চায় নিয়োজিত হওয়াই ছিল অবধারিত। এবার বলি মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে। ছাত্রজীবনে আমি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম। মদন মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্র সংসদে ‘সাহিত্য ও বিতর্ক সম্পাদক’ এবং ছাত্রাবাসের ‘অধিনায়ক’ নির্বাচিত হয়েছিলাম। ছাত্ররাজনীতিই মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে সহায়তা করেছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুগত করেছে। তার মহিমা উপলব্ধির শিক্ষাটা দিয়েছে। এই সূত্রেই আমার প্রথম গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক, মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা (১৯৯৯)। তখন আমি ছিলাম তরতাজা যুবক। তারপর যখনই সুযোগ পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছি। এই কাজের মধ্যে অনাবিল আনন্দ পাই।

জাগো নিউজ: আপনার সম্পাদনায় রণাঙ্গন থেকে প্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য পত্রিকা ‘জন্মভূমি’ ও ‘মুক্ত বাংলা’ প্রকাশিত হয়েছে; এটি নিয়ে কাজ করার পেছনের গল্প জানতে চাই— মোস্তফা সেলিম: মুক্তিযুদ্ধে কলমসৈনিকদের একটা বড় ভূমিকা ছিল। বিশেষত সাংবাদিক সমাজের। মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র হিসেবে প্রায় শ’খানেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল মুক্তাঙ্গন এবং দেশের বাইরে থেকে, বিশেষত ভারত থেকে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের এই অমূল্য দলিলগুলো আমরা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর প্রকৃত চিত্র ধারণ করেছে এই সংবাদপত্রগুলো। এ রকম দুটো পত্রিকা জন্মভূমি ও মুক্ত বাংলা। সাপ্তাহিক এই দুটো কাগজ নিয়মিত প্রকাশ হয়েছিল। এই মহামূল্যবান কাগজ দুটো দুষ্প্রাপ্য সংরক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশের কোনো গবেষক বা কোনো প্রতিষ্ঠানে এগুলোর কোনো সংগ্রহ ছিল না। দুটো পত্রিকাই বের হতো ভারত থেকে। আমি দুটো পত্রিকা সংগ্রহ করে প্রকাশের উদ্যোগ নিই। পাঠক সমাবেশ থেকে আমার সংকলন, সম্পাদনা ও ভূমিকায় জন্মভূমি প্রকাশিত হয় ২০২২ সালে। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী বঙ্গবন্ধুর অবৈতনিক পিএস ও ফটোগ্রাফার এবং মুক্তিযুদ্ধকালের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানীর একান্ত সচিব মোস্তফা আল্লামা। মুক্ত বাংলা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা সাদাত খান ও আকাদ্দস সিরাজুল ইসলাম। আমার সংগ্রহে আরও দুটো মূল্যবান সংবাদপত্রের সংগ্রহ আছে। এগুলোও আমি প্রকাশের জন্য কাজ করছি।

জাগো নিউজ: আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট থেকে এ বছর আপনার লেখা সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষাগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চয়ই নতুন মাত্রা যোগ করবে?মোস্তফা সেলিম: নিশ্চয়ই। কারণ এ প্রকাশনার মাধ্যমে নাগরীলিপির প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার পথ অবারিত হলো। নাগরীলিপির স্বীকৃতি ছিল না কোনো প্রতিষ্ঠানে, এমনকি যখন তার স্বর্ণযুগ ছিল তখনো না। সেকালে ন্যূনতম প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন ছিল না নাগরীর। তারপরও গণমানুষের সমর্থনে এটি টিকে ছিল। প্রবল প্রতাপে বাংলালিপির সঙ্গে লড়ে নিজের অস্বিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। কিন্তু নবজাগরণের কালে এখন এটি প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি পাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট যোগ দিয়ে এর গতিকে বেগবান করলেন। সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষাগ্রন্থটি পূর্ণাঙ্গ একটি প্রাইমার। বাংলালিপির সঙ্গে সিলেটি নাগরীর মিল, অমিল, নৈকট্য, দূরত্ব ইত্যাদি ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে এ গ্রন্থে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বইটি প্রকাশ করে তার একটি স্বীকৃতির জায়গা তৈরি করে দিয়েছে।

জাগো নিউজ: আপনি ভ্রমণসাহিত্য নিয়েও কাজ করেন। ভ্রমণ নিয়ে পত্রিকাও করেন। এই কাজে আসার কারণ জানতে চাই—মোস্তফা সেলিম: আমি ছাত্রজীবনেই সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়ে পড়েছিলাম। দৈনিক সিলেটের ডাকের মদন মোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ক্যাম্পাস প্রতিনিধি ছিলাম। এরপর কয়েক বছর সাপ্তাহিক সিলেট কণ্ঠ, দৈনিক যুগভেরীতে কাজ করেছি। যখন প্রকাশনায় এসেছি, এই সূত্রেই তখন ভ্রমণচিত্র নামে একটি পত্রিকার ডিক্লারেশন নিয়ে এর প্রকাশনা শুরু করি ২০১০ সালে। পত্রিকাটি একসময়ে পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়েছিল। আমি ব্যতিক্রমী কাজ পছন্দ করি। আমার মনে হয়েছিল কাজটি জরুরি অথচ গুরুত্ব দিয়ে কেউ এখানে কাজ করছেন না। বাংলাদেশের যে দুটি জায়গায় প্রকৃতির অফুরান দান রয়েছে, তার একটি হচ্ছে উর্বর কৃষিজমি, কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক চেহারাই বদলে দেওয়া সম্ভব। অন্যটি হচ্ছে পর্যটন। প্রকৃতি অকৃপণ হয়ে আমাদের এই ব-দ্বীপকে মনোরম চেহারায় সাজিয়েছেন। নদী, পাহাড়, সমুদ্র, খাল, বিল, সবুজ শ্যামলিমা এই দেশের রূপের মৌলিকত্ব তৈরি করেছে। এত এত ইউনিক ট্যুরিজম প্রোডাক্ট আছে বাংলাদেশের, অথচ দেশটার মানুষের এই উপলব্ধি নেই। এই ‘চোখ থাকিতে অন্ধ’দের সামনে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে তুলে ধরার আকাঙ্ক্ষা থেকেই ভ্রমণচিত্র সম্পাদনা করেছি। এ ছাড়া ভ্রমণ বিষয়ে আমার দুটি বই আছে।

জাগো নিউজ: ভবিষ্যতে আর কী কী নিয়ে কাজ করবেন বলে মনে করেন?মোস্তফা সেলিম: খুব পরিকল্পনা করে কিছুই আমার করা হয়ে ওঠেনি। সময়ই আমাকে কিছু বিষয়ের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেগুলোই তখন আমার এজেন্ডাভুক্ত হয়। আমি কি কখনো ভেবেছি, বাংলাদেশের ভাষা গৌরবের এক অমলিন অধ্যায় সিলেটি নাগরীলিপি নবজাগরণটা হবে আমার হাতে! কখনো কি ভেবেছি, বাংলা মরমি সাহিত্যের আদি (১৭৭৪) পাণ্ডুলিপিটা আমি সম্পাদনা করবো! কিংবা ভেবেছি মুক্তিযুদ্ধের দুষ্প্রাপ্য দুটো সংবাদপত্র হাজির করতে পারবো জাতির সম্মুখে! কেউ একজন অন্তরীক্ষে বসে এই কাজগুলো আমাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। তবে যে কাজেই থাকি, শেকড়ের প্রতি আমার অঙ্গীকার চিরকালই একরকম থাকবে।

এসইউ/এমএস