ধর্ম

ইরানের দৃষ্টিনন্দন ৫ মসজিদ

ইরানের দৃষ্টিনন্দন ৫ মসজিদ

ইরানের স্থাপত্যশিল্প শুধু মুসলিম বিশ্বে নয়, সারা বিশ্বেই নন্দিত। পারস্য সভ্যতার শিকড় থেকে শুরু করে ইসলামি রুচির সূক্ষ্ম শিল্প—সবকিছু একত্র হয়েছে তাদের মসজিদ-নির্মাণে। রঙিন টাইলস, জ্যামিতির নিঁখুত খেলায় গড়া খিলান আর শিল্পিত গম্বুজ—ইরানের মসজিদগুলো দুনিয়ার সবচেয়ে পরিশীলিত স্থাপত্যরীতির জীবন্ত সাক্ষী।

Advertisement

এই নিবন্ধে আমরা ইরানের এমন পাঁচটি মসজিদ ঘুরে দেখব, যেগুলো শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়—ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন হিসেবেও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কাড়ে।

মসজিদে জামে ইসফাহান

এ মসজিদটি কেবল ‘ইবাদতখানা’ নয়, বরং সভ্যতার উত্থান-পতনের জাদুঘর। কারণ এই মসজিদটির ভিত্তি স্থাপন থেকে বর্তমান রূপ পেতে সময় লেগেছে প্রায় ১২শ বছর!

Advertisement

৭৭১ খ্রিষ্টাব্দে আব্বাসি খলিফা মনসুরের আমলে এই মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। তখন এর আয়তন ছিল ৫২×৯০ মিটার। ৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আল মুতাসিম একে ৮৮×১২৮ মিটার সম্প্রসারিত করে। এরপর বুওয়াইহি শাসনে এর সম্মুখভাগে সংস্কার হয়, সেলজুক আমলে গম্বুজ ও ‘মুকারনাস’ স্থাপন করা হয়। যুগে যুগে খলিফা, সুলতান ও শাহের সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে বর্তমানে এর আয়তন প্রায় ২০,০০০ বর্গমিটার।

ইরানে শিয়া শাসন জারি হলে তারা মসজিদে নিজেদের রীতি মোতাবেক সংস্কার করে। এভাবে পরিবর্তন-পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে ১৯৭০ সালে এই মসজিদটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। এ কারণে মসজিদে এত আলাদা আলাদা নির্মাণশৈলী চোখে পড়ে যে পর্যটকরা এক অংশ থেকে অন্য অংশে গেলে ইতিহাসের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যায়।

নাসিরুল মুলক মসজিদ

এ মসজিদটি গোলাপি মসজিদ নামেও (Pink Mosque) প্রসিদ্ধ। ইরানের প্রসিদ্ধ তিন কবি—শেখ সাদি, উরফি ও হাফিজের জন্মশহর শিরাজে এই মসজিদের অবস্থান। ১৮৮৮ সালে কাজার শাসনামলে মির্জা হাসান আলি নাসিরুল মুলক এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। এর আয়তন ২,৪১৪ বর্গমিটার।

Advertisement

সূর্যোদয়ের সময় এই মসজিদের রঙিন কাঁচের জানালায় আলো পড়ে মেঝেতে যে জ্যামিতিক রঙিন ছায়া পড়ে, তা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় নেই। ইরানি মুকারনাস, ফুলেল নকশা ও জাফরি জানালা এই মসজিদকে করে তুলেছে পৃথিবীর সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন মসজিদগুলোর একটি।

শেখ লুৎফুল্লাহ মসজিদ

ইসফাহানে অবস্থিত এই মসজিদটি নির্মিত হয় ১৬১৯ সালে। নির্মাতা ছিলেন শাহ আব্বাস প্রথম, আর নকশা করেন প্রধান স্থপতি মুহাম্মদ রেজা ইসফাহানি। আয়তন প্রায় ৪৪×৩০ মিটার। এটি ছিল রাজপরিবারের নারীদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত। একটি গোপন সুড়ঙ্গপথে আলী কপুর প্রাসাদ থেকে এই মসজিদে যাওয়া যেত। প্রবেশপথটি সরাসরি না হয়ে ঘুরপথে যেন বাইরের কারও চোখে নারীরা না পড়ে।

মসজিদটির পেইন্টেড গম্বুজে সূর্যের আলো পড়লে এক ময়ূর আকৃতি প্রকাশ পায়, যা স্থাপত্যশিল্পের এক বিস্ময়। দেয়ালে আরবি ক্যালিগ্রাফি, সূক্ষ্ম মুকারনাস, হাফত-রঙি টাইলস আর আরবেস্ক মোটিফে ইরানি মিনিয়েচার—সব মিলিয়ে এটি মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন।

মসজিদে জামে ইয়াজদ

ইরানের ইয়াজদ শহরে অবস্থিত জামে মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৪ শতকে, ইলখানিদের শাসনামলে। মূল কাঠামো নির্মাণের নির্দেশ দেন রুকনুদ্দিন মুহাম্মদ। এর আগে মসজিদটির জায়গায় একটি অগ্নিমন্দির ছিল।

মসজিদটির আয়তন প্রায় ৯,৮০০ বর্গমিটার। এই মসজিদের মিনার (৫২ মিটার) ইরানে সবচেয়ে উঁচু মিনার হিসেবে প্রসিদ্ধ। এর প্রবেশপথে রয়েছে অসাধারণ উচ্চতার ‘ইওয়ান’, যার নীল টাইলস, কুফি ও নসখ লিপির শিলালিপি এবং জ্যামিতিক অলংকরণ নান্দনিকতা ও রুচির এক অনন্য প্রকাশ। আজারি শৈলীর এই মসজিদে ইলখানি ও মোজাফফারিদ আমলের সৌন্দর্য একত্র হয়েছে।

গম্বুজ, ইওয়ান আর দেয়ালের নিখুঁত রেখায় ক্যালিগ্রাফি—ইতিহাস, শিল্প ও আধ্যাত্মিকতার সংমিশ্রণে এই মসজিদ অনন্য সৌন্দর্যের নিদর্শন।

মসজিদে কাবুদতাবরিজ শহরের এই মসজিদ ‘ব্লু মসজিদ’ নামে বেশি প্রসিদ্ধ। এর নির্মাণ শুরু হয় ১৪৬৫ সালে, কারা কয়নলু শাসক জাহানশাহ ও তার স্ত্রী খাতুন জান বেগমের নির্দেশে।

এটি শুধু মসজিদ নয়, বরং একটি মসজিদ-মাজার কমপ্লেক্স, যার সঙ্গে ছিল খানকা, মাদরাসা, হাম্মামখানা ও বাগান।

এই মসজিদেই রয়েছে ইরানের টাইলশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন, যেখানে গাঢ় নীল, সোনালি ও সাদা রঙের ‘লাস্টারওয়্যার’ ও গিল্ডেড কাবল্ট টাইলস ব্যবহৃত হয়েছে। গম্বুজকক্ষের দেয়ালে ছিল গাঢ় নীল ষষ্ঠভুজ টাইল যার সৌন্দর্য পরে ইসফাহানের শেখ লুৎফুল্লাহ মসজিদেও অনুরণিত হয়। খুঁদে গম্বুজ ও প্রধান গম্বুজের সমন্বয়ে এর গঠন স্মরণ করায় এক ইরানি চত্বরঘেরা নকশা, তবে কিছু অটোমান প্রভাবও লক্ষণীয়।

১৭৮০ সালের ভূমিকম্পে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মসজিদটির ‘ইওয়ান’ আজও অক্ষত রয়েছে। তৈমুরীয় ও মধ্য এশীয় নকশার শৈল্পিক সমন্বয়ে নির্মিত এই স্থাপনাটি এক ঐতিহাসিক বিস্ময়—ইরানের শেষ তুর্কমান গৌরবের এক জীবন্ত স্মারক।

ওএফএফ/এমএস