একুশে বইমেলা

চাষার পাঁচালি: ধ্যানমগ্ন কবির বয়ান

২০২৪ সালের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কবি ও নির্মাতা মাসুদ পথিকের কবিতার বই ‘চাষার পাঁচালি’। তার কবিতা যতবারই পড়ি; ততবারই নিজেকে আবিষ্কার করি। কেননা শৈশব-কৈশোরে আমিও কৃষক ছিলাম। আমার বাবাও শিক্ষকতার পাশাপাশি কৃষিকাজ করতেন। এই যে কৃষকের ঘামের গন্ধ কিংবা চাষার তৃপ্তির হাসি দেখি তার কবিতায়; এর জন্য নিজেকে আবিষ্কার করতে পারি অনায়াসে। ফলে বলা যায়, ‘চাষার পুত’ খ্যাত মাসুদ পথিকের কবিতায় যেন কৃষকের জবান ফুটে ওঠে। পাঠক নিজেরই জীবন পাঠ করেন। সুতরাং কবির ভাষায় বলা যায়—‘আমি বিশুদ্ধ নই এবং সবসময় সত্যও বলি নাআর অর্থ ও প্রাচুর্য সে আমার পূর্বপুরুষেরও ছিলো নাতারা ছিলো জাত চাষা—দিনমজুরপ্রতিদিনের অন্নের জন্য আমাদের প্রতিমুহূর্তে লড়াই করতে হতো, হয়;’(অন্ধের ভালোবাসা, পৃষ্ঠা-১২) কবি মাসুদ পথিকের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১ আগস্ট। তিনি একাধারে চলচ্চিত্র পরিচালক, গীতিকার এবং কবি। তিনি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। এ ছাড়া তার পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘মায়া: দ্য লস্ট মাদার’ ২০১৯ সালে ৮টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। তিনি কবিতায় ২০১৩ সালে ‘কালি ও কলম পুরস্কার’ অর্জন করেন। সম্প্রতি নাটক ও নাট্যসাহিত্য বিভাগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ পেয়েছেন।

Advertisement

এ পর্যন্ত তার ২৫টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে প্রকাশ হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কৃষকফুল’। এরপর ‘বাতাসের বাজার’ ২০০৭; ‘ধানের গ্রীবার নিচে কিছু অভিমান’ ২০০৮; ‘সেতু হারাবার দিন’ ২০০৯; ‘ধানচোর’ ২০১০; ‘হাড়ের পাখালি’ ২০১১; ‘মাঠের কোল’ ২০১২; ‘একাকী জমিন’ ২০১৩; ‘চাষার পুত’ ২০১৪; ‘রোলকলের বাইরে থেকে জেনেছি এই কৃষক-জন্মের কারিকুলাম’ ২০১৫; ‘চাষার বচন’ ২০১৬; ‘শাপলা: জলের জন্মান্ধ মেয়ে’ ২০১৬; ‘লাঙলের ভুবন’ ২০১৭; ‘দাদার খড়ম’ ২০১৭; ‘বাতাসের বীজতলা’ ২০১৮; ‘আমন আউশ দুই বোন বা পণ্য অথবা প্রকৃতি আর যা যা’; ‘ঘামের মোকাম’ ২০১৮; ‘সাধের লাউ’ ২০১৯; ‘অনাহারী ধুলোগণ’ ২০১৯; ‘চাষার কাম’ ২০২০; ‘কান্নার কুনাঘর’ ২০২১; ‘ধানবাজারে এইসব নন্দন বেপারি অ্যান্ড নিউ কলোনিয়াল কোলাহল’ ২০২২; ‘ভাতের হারিকিরি’ ২০২২; ‘এই বইটির নাম হতে পারতো লাঙলের হেজিমনি বা নিম্নবর্গের ভাষা তৈরি হয় যে বোবা আলে অথবা লাতাবোরো ও মিনতি ধানের শোক সংগীত কিংবা শস্যের ফ্যালাসি’ ২০২৩ এবং ‘চাষার পাঁচালি’ ২০২৪।

কবিতা লেখার পাশাপাশি কবিতা নিয়ে সিনেমা বানাতে ভালোবাসেন মাসুদ পথিক। এরই মধ্যে কবিতা নিয়ে তৃতীয় সিনেমার শুটিংও শেষ করেছেন। ‘বক: দ্য সোল অব ন্যাচার’ নামের সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা অবলম্বনে। এ ছাড়া সিনেমা নির্মাণ করছেন কবিদের নিয়ে। যেখানে অভিনয় করবেন দেশের ২৫ জন কবি। তার ‘স্ট্রিট ফিলোসফার’ সিনেমায় থাকবেন কবি নির্মলেন্দু গুণ, অসীম সাহা, কচি খন্দকার, ড. তপন বাগচী, আসলাম সানী, আসাদ মান্নান, হারিসুল হক, বদরুল হায়দার, সমর চক্রবর্তী, ইউসুফ রেজা, অচিন্ত্য চয়ন, ফখরুল হাসান, রাশেদ হাওলাদার, আলমগীর রেজা চৌধুরী, সরকার মাসুদ, সুমন মুস্তাফিজ প্রমুখ। এ ছাড়া কবি নির্মলেন্দু গুণের আরেকটি কবিতা ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’ অবলম্বনে ‘দ্য আগস্ট’ নামে আরেকটি সিনেমা নির্মাণ করবেন।

কবিতার চাষা হিসেবেও মাসুদ পথিক ঘরে তুলে নিয়েছেন শ্রমের ফসল। মাটি ও মননে পোস্ট কলোনিয়াল কবি হিসেবে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। এক কথায় বলতে হয়, বাংলা কবিতায় নতুন এক ধারা তৈরি করেছেন মাসুদ পথিক। অনেকেই মনে করেন, ‘শব্দের বীজ মাসুদ পথিকের হাতে পড়ে হয়ে উঠেছে কবিতাবীজ। সাম্প্রতিককালের কবিতা চাষের এই একনিষ্ঠতা আর কোনো কবির মধ্যে আমরা দেখতে পাই না। কবির কবিতার জমিন এতটাই উর্বর—যতটুকু জমি কর্ষিত হয়েছে, সেখানে ততটুকুই সোনা হয়ে ফলেছে।’ (প্রকাশক, চাষার পাঁচালি) মাসুদ পথিক এ কারণেই খাঁটি ও আদি-আসল চাষার পুত। মাটি ও চাষাকেন্দ্রীক এই ধারাটি বাংলা ও বাংলার মানুষের আবহমান চিন্তা ও সাধনার অংশ। ফলে তার কবিতা বাঙালির চিন্তার নতুন এক গঠনশৈলী তৈরি করেছে। কেননা কবিমনে জাগ্রত হয় চাষার বাসনা। তাই তো কবি বলেছেন—‘লাঙল জোয়াল পড়ে আছে পরিত্যক্ত গোয়ালেভাবি, চাষ করিবো বন্দে মন জমিন জোয়ালে’(পিরিতের আহাজারি: পুঁথি ০৬, পৃষ্ঠা-২৬)

Advertisement

আগেই জানিয়ে রাখা উচিত, মাসুদ পথিক তার বইটি উৎসর্গ করেছেন চাষাদের করকমলে। তিনি বলেছেন, ‘তর্ক ও বিতর্ক—আমাদের চির সন্তান/ কষ্ট ও অসুখের উজ্জ্বল কলতান।’ ভূমিকায় কবি বলেছেন, ‘তুই আমার বীজধান—যত্নে বুনেছি ঠোঁটে/ ক্ষুধার্ত হালিকের মৃত্যু হলো চুম্বনের চোটে।’ আবার এ-ও বলেছেন, ‘আমি পুরোটাই গেরাম/ কান্নাপুর তার নাম/ গোত্রের নাম অশ্রু/ বাড়ি বেদনা’র ধাম।’ তার দার্শনিক তত্ত্ব সমৃদ্ধ বইটিতে মোট ৬৭টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে পাঁচালি রয়েছে তিনটি। পুঁথি রয়েছে ১০টি। গ্রামবাংলার আবহমান সংস্কৃতির সঙ্গে তা একাত্মতা ঘোষণা করেছে। আধুনিকায়নের দৃষ্টিতেও গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরাই মাসুদ পথিকের মননশীল চিন্তার প্রতিফলন।

কবিতায় মাসুদ পথিক নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন একজন চাষা হিসেবে। এই পরিচয়ে তার কোনো দ্বিধা বা কুণ্ঠা নেই। তিনি বলেছেন, ‘আমি মূলত একজন চাষা, আচার আচরণ এবং অভ্যাসে এটাই প্রকাশিত/ তথাপি আমাকে দেখলে অনেকে নাক সিটকায়, দূরে থাকে’ (পুরস্কার, পৃষ্ঠা-৯)। তার বেশিরভাগ কবিতায় কৃষিকে উপজীব্য করেছেন। কৃষককে তুলে এনেছেন মানুষের জীবিকার কারিগর হিসেবে। উপমা, রূপক, অলংকার, ভাষায় কৃষকই হয়ে উঠেছেন তার প্রধান আলোচ্য বিষয়। বইটিতে তা খুঁজে পেতে খুব বেশি কষ্ট হবে না। যদি একটু চোখ বুলাই—১. তোকে আজ ‘ধান ধান’ লাগছে, আরআমিও এখন শীতে পোড়া, ‘ছারখার’!(চাষার পাঁচালি ০৩, পৃষ্ঠা-১৯)

২.বাউল বাতাসে মেলে ধরিস তোর যোনি ও আঁচল, আরআমিও চাষার পুত, প্রেম বুনেছি গহীনে, গোলা করে উজার(আউশ ধানের বিবাহ ০১: পুঁথি ০২, পৃষ্ঠা-২১)

৩. ওরে ধান কাটা হলে শেষ আসবে আবার নবান্ন সময়ঘরে ঘরে, সকলে মাথিয়া উঠিবে সুখে,—পিঠাপুলিময়(বন্দনা: পুঁথি ০৪, পৃষ্ঠা-২৩)

Advertisement

৪.যদিও চাষ করতে আসা কৃষককূলঅতীতের বীজ বুনে তার ভূমিতে ভবিষ্যতের আশায়(চাষবিন্দু, পৃষ্ঠা-৩৮)

আরও পড়ুন

নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ: কবিতার বাস্তব চিত্রায়ণ মাসুদ পথিকের কবিতায় কৃষকের জবান

৫.মালা হাতুন রোয়া বোনে, আরঢেকিতে জাগলি ধান ভানেঘামে ভেজা শরীর ও আঁচলধরে,—টানে দুটি সন্তানে(জাগলি ধান ও মালা হাতুন, পৃষ্ঠা-৩৯)

৬.হাঁটু মুড়ে আমি এখনো বসে আছি কাদার জমিনেবপন করবো বলে আমাদের ইতিহাসের বীজকতো প্রেমের কিংবদন্তি শস্য হয়ে দেয় ইশারাহাওয়ার হৃদপিণ্ডে ছড়ায় আবহমান উচ্ছ্বাস(ভালোবাসার স্যুরিয়াল যাত্রা, পৃষ্ঠা-৪৬)

৭.ধান, এইভাবে মিছিল করছে কেনো?রূপা আমনটেপি বোরোলাতা বোরোজাগলি, পাইজাম, হাইট্টা, বালাম ধান আরআউশেরা দলে দলে ছুটে আসছে সড়কে,সচিবালয় প্রেস ক্লাব পেরিয়ে টিএসসি হয়ে শাহবাগ মোড়(ধানেরা মিছিল করছে, পৃষ্ঠা-৫০)

৮. কৃষক রোয়া বুনতে বুনতে জেনে গেছেকোথায় আছে তিলা ডুফির দেশ(ধনী গরিব, পৃষ্ঠা-৫৪)এমন অনেক কবিতায় চাষি ও কবির সম্মিলন ঘটেছে। চাষার মুখে ধানের কথায় মানুষের জয়গানই ফুটে উঠেছে। বেঁচে থাকার মন্ত্র উচ্চারিত হয়েছে।

একজন কৃষকের আড়ালে কবি নাগরিক যন্ত্রণাকেও তুলে ধরেছেন। আধুনিক জীবনযাপন নাড়া দেয় তাকে। ছেলে হারানো শোক, প্রেমিকা হারানো হতাশা, জীবনের টানাপোড়েন কবিকে চিন্তামগ্ন করে রাখে সারাক্ষণ। কবি কখনো কখনো বলে ওঠেন—‘এই কোলাহল ভেঙে ভেঙে সন্তানের লাশ কাঁধেছুটে যাচ্ছে হাসপাতালবাকস্বাধীনতার অধিকারে পথেপথে করছে মিছিল বেগানা কুকুর’(বিষণ্ন আপেল, পৃষ্ঠা-৮০)

তার কবিতায় উঠে আসে চাষাদের ব্যথা। একা বসে থাকে নীল হরিয়াল। বয়ে চলে কোনো নদী। কবির সৃষ্ট শব্দমালা নতুন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে। আবেগ-অনুভূতির জন্ম দেয়। আমাদের টেনে নিয়ে যায় মাঠে, ঘাটে কিংবা হাটে। সেসব শব্দ আমাদের আবেগের সঙ্গে মিশে থাকে— ১. মেঘের দাফন, পৃষ্ঠা-৭৯২. মেট্রোপলিটন মন, পৃষ্ঠা-৮০৩. মসৃণ গোবর, পৃষ্ঠা-৭৬৪. কাদার স্তন, পৃষ্ঠা-৭৪৫. শ্রমজীবী বিল, পৃষ্ঠা-৪৫৬. গুচ্ছ গুচ্ছ ভাত, পৃষ্ঠা-৪৩৭. ভাইরাল কুকুর, পৃষ্ঠা-৪২৮. ফসলের গান, পৃষ্ঠা-৩১৯. কসাইয়ের খোঁয়াড়, পৃষ্ঠা-১৪১০. কান্নার সন্তান, পৃষ্ঠা-১০ প্রভৃতি।এমনই অসংখ্য শব্দমালা মাসুদ পথিকের কবিতাকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে। শিল্পসম্মত কবিতায় রূপান্তর করে। কবিতার অন্তর্নিহিত ভাব পাঠকের মর্মমূলে আঘাত করে।

পোস্ট কলোনিয়াল কবি মাসুদ পথিক একের পর এক চাষার কাব্য সৃষ্টি করে চলেছেন। শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে আসছেন। তার কবিতা শুধু কবিতা নয়, চাষিদের স্লোগান। খেটে খাওয়া মানুষের আহাজারি। পরনির্ভরশীল উদ্ভিদের কান্না। ব্যর্থ প্রেমিকের হাহাকার। সন্তানহারা বাবার আর্তনাদ। ফলে বইটি সহজেই পাঠকের আগ্রহ কাড়তে সক্ষম হবে। আমি বইটির বহুল পাঠ ও প্রচার কামনা করছি।

বইয়ের নাম: চাষার পাঁচালিকবির নাম: মাসুদ পথিক প্রচ্ছদশিল্পী: আল নোমানপ্রকাশনী: জাগতিক প্রকাশনমূল্য: ৩০০ টাকা।

এসইউ/এএসএম