সাহিত্য

সিনেমা-কবিতায় ভালো কাজ করার যোগ্যতা রাখি: মাসুদ পথিক

ড. মাসুদ পথিক একজন কবি ও রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাতা। তিনি কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণের কালজয়ী কবিতা ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ওই চলচ্চিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়া তার পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘মায়া: দ্য লস্ট মাদার’ ২০১৯ সালে ৮টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। তিনি কবিতায় ২০১৩ সালে ‘কালি ও কলম পুরস্কার’ অর্জন করেন।

Advertisement

তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কৃষকফুল’। এরপর ‘বাতাসের বাজার’, ‘ধানের গ্রীবার নিচে কিছু অভিমান’, ‘সেতু হারাবার দিন’, ‘ধানচোর’, ‘হাড়ের পাখালি’, ‘মাঠের কোল’, ‘একাকী জমিন’, ‘চাষার পুত’, ‘রোলকলের বাইরে থেকে জেনেছি এই কৃষক-জন্মের কারিকুলাম’, ‘চাষার বচন’, ‘শাপলা: জলের জন্মান্ধ মেয়ে’, ‘লাঙলের ভুবন’, ‘দাদার খড়ম’, ‘বাতাসের বীজতলা’, ‘আমন আউশ দুই বোন বা পণ্য অথবা প্রকৃতি আর যা যা’, ‘ঘামের মোকাম’, ‘সাধের লাউ’, ‘অনাহারী ধুলোগণ’, ‘চাষার কাম’, ‘কান্নার কুনাঘর’, ‘ধানবাজারে এইসব নন্দন বেপারি অ্যান্ড নিউ কলোনিয়াল কোলাহল’, ও ‘ভাতের হারিকিরি’ প্রভৃতি প্রকাশিত হয়।

কবিতা নিয়ে সিনেমা বানাতে ভালোবাসেন মাসুদ পথিক। এরই মধ্যে কবিতা নিয়ে তৃতীয় সিনেমার শুটিংও শেষ করেছেন। ‘বক: দ্য সোল অব ন্যাচার’ নামের সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা অবলম্বনে। এছাড়া সিনেমা নির্মাণ করছেন কবিদের নিয়ে। যেখানে অভিনয় করবেন দেশের ২৫ জন কবি। তার ‘স্ট্রিট ফিলোসফার’ সিনেমায় থাকবেন কবি নির্মলেন্দু গ‌ুণ, অসীম সাহা, কচি খন্দকার, ড. তপন বাগচী, আসলাম সানী, আসাদ মান্নান, হারিসুল হক, বদরুল হায়দার, সমর চক্রবর্তী, ইউসুফ রেজা, অচিন্ত্য চয়ন, ফখরুল হাসান, রাশেদ হাওলাদার, আলমগীর রেজা চৌধুরী, সরকার মাসুদ, সুমন মুস্তাফিজ প্রমুখ।

সম্প্রতি তিনি নাটক ও নাট্যসাহিত্য বিভাগে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কারপ্রাপ্তির অনুভূতি ও বইমেলা সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন লেখক ও গণমাধ্যমকর্মী সাজেদুর আবেদীন শান্ত—

Advertisement

জাগো নিউজ: সম্প্রতি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেলেন, অনুভূতি কেমন?মাসুদ পথিক: অনুভূতি ভালো। যে কোনো কাজের স্বীকৃতি সবার পেলে পরে যেমন ভালো লাগে, আমারও তেমন ভালো লাগছে। এটা তো ভালো লাগারই বিষয়। বাংলা একাডেমি সাহিত্যের বড় একটা পদক। এর অনুভূতি চমৎকার। এ স্বীকৃতি মানে হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও ভালো কাজ করার একটা অনুপ্রেরণা, একটা উৎসাহ। এজন্য আমার ভালো লাগছে। তবে আমি মনে করি যে, ভালো কাজগুলো করতে পারিনি এখনো। ভালো কাজ করাটা মাত্র চলমান। ভবিষ্যতে আমি আরও ভালো কাজ করতে পারবো। সিনেমায়-কবিতায় দুই ধারাতেই আমি ভালো কাজ করার যোগ্যতা রাখি। এটাই আমার বিশ্বাস।

আরও পড়ুন: নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ: কবিতার বাস্তব চিত্রায়ণ 

জাগো নিউজ: অমর একুশে বইমেলায় আপনার কয়টি বই প্রকাশিত হচ্ছে?মাসুদ পথিক: একটা বই আগেই প্রকাশিত হয়েছে। তবে সেটা বইমেলায় থাকবে। বইটির অনেক বড় নাম। বইটির নাম হলো ‘এই বইটির নাম হতে পারতো, লাঙলের হেজিমনি বা নিম্নবর্গের ভাষা তৈরি হয় যে বোবা আলে অথবা লাতাবোরো ও মিনতি ধানের শোক সংগীত কিংবা শস্যের ফ্যালাসি’। আরেকটি বই প্রকাশিত হচ্ছে, তা হলো ‘চাষার পাঁচালি’। আরেকটি হলো ‘নির্বাচিত কবিতা’—মোট এই তিনটি বই।

জাগো নিউজ: বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলা কেমন দেখতে চান?মাসুদ পথিক: বাংলা একাডেমি বইমেলা সব সময় সুন্দরই হয়। কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো ঘটতেই পারে। তবে সর্বোপরি বইমেলা সব সময় সুন্দর হয়। এখানে সব সময় লেখক-পাঠকের একটা সংযোগ হয়। বই চুজ করতে পারে সবাই। এই মেলাকে কেন্দ্র করে যারা লেখক আছেন, তারা বই প্রকাশ করেন। এটা একটা উৎসব। কালচারাল ভাবের মধ্য এটা একটা চমৎকার উৎসব হিসেবে আমাদের মাঝে ধরা দেয়। এবারও আশা করি বইমেলা ভালোই হবে। কারণ গতবারও বেশ গোছালো হয়েছিল, বড় পরিসরে হয়েছিল। এবারও সুন্দর হবে। আমি আশাবাদী আর কি।

Advertisement

জাগো নিউজ: পুরস্কারপ্রাপ্তির পর নিজের দায়িত্ব বা দায় কি বেড়ে যায়?মাসুদ পথিক: আমি তো অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছি। আপনারা জানেন প্রায় ৩৯টির মতো পদক পেয়েছি। কালি ও কলম সাহিত্য পদকসহ আরও অনেক পদক পেলাম। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি প্রায় ১৬টা। প্রত্যেকটা পদকই আমাকে অনুপ্রেরণা, উৎসাহ জোগায়। আনন্দ দেয়। পাশাপাশি একটা দায়বদ্ধতার জায়গায় ফিরে যাই। ভালো কিছু করা বা ভালো কিছু লেখা, ভালো সিনেমা বানানো। এটা একটা টনিকের মতো কাজ করে। আমার কাছে এমনই মনে হয়।

জাগো নিউজ: বইমেলায় বইয়ের বিক্রি বাড়ছে নাকি কমছে?মাসুদ পথিক: বইমেলায় বই তো বিক্রি হয় ভালোই। খারাপ না। কারণ বইমেলা কেন্দ্রিক বই বিক্রি বেশি হয় আমাদের দেশে। এখানে সরাসরি লেখকরা আসেন এবং পাঠকরাও আসেন। সরাসরি একটা কমিউনিকেশনের মধ্য দিয়ে ভালো বই বিক্রি হয়। প্রত্যেক বছরই তো মোটা অঙ্কের একটা বই বিক্রি হয়। এটা পাঠক ও লেখকদের জন্য চমৎকার এক মিলন উৎসব।

আরও পড়ুন: সুশৃঙ্খল একটি মেলা দেখতে চাই: চাণক্য বাড়ৈ 

জাগো নিউজ: কবি নাকি নির্মাতা? নিজের কোন পরিচয় আগে রাখবেন? মাসুদ পথিক: আপনারা জানেন, আমার সিনেমা এবং কবিতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আমার প্রত্যেকটি সিনেমা তৈরি হয়েছে কবিতা থেকে। আমি যখন কোথাও পরিচয় দিই, নিজেকে কবি হিসেবেই পরিচয় দিই। আমি বলি, ‘আমি প্রথমত কবি, দ্বিতীয়ত কবি, তৃতীয়ত চলচ্চিত্রনির্মাতা’। মানে আমি ‘কবি, কবি তারপর চলচ্চিত্রনির্মাতা’। আমি যে তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ ফিল্ম নির্মাণ করে ফেলেছি, তিনটিই কবিতা থেকে করেছি। ‘বক: সোল অব ন্যাচার’ সিনেমাটি জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতা থেকে করেছি। ‘স্ট্রিট ফিলোসফারে’র মধ্যে কবিতা এবং ফিলোসফিক্যাল ট্রিটমেন্ট আছে। এটি নির্মিত হচ্ছে ফরাসি ও জার্মান দার্শনিক মিশেল ফুকো ও বের্টোল্ট ব্রেখটের চিন্তা বিশ্ব অবলম্বনে। আর ‘দ্য অগাস্ট’ যেটা করছি, সেটি কবি নির্মলেন্দু গুণের ‘সেই রাত্রির কল্পকাহিনি’ কবিতা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে করছি। এর আগে ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ও নির্মলেন্দু গ‌ুণের ‘নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ’ কবিতা থেকে নির্মাণ করেছি। ‘মায়া: দ্য লস্ট মাদার’ করেছি কবি কামাল চৌধুরীর ‘যুদ্ধশিশু’ কবিতা অবলম্বনে। এই যে কবিতা থেকে ফিল্ম বানাচ্ছি এবং সামনে আরও সিনেমা হবে কবিতা থেকে। যেমন ‘দ্য ওল্ড ইজ অ্যালোন’ নামে একটি ফিল্মের স্ক্রিপ্ট রেডি করা আছে। যেটি আফ্রিকান লেখক চিনুয়া আচেবের একটি কবিতা থেকে হচ্ছে। এ রকম আরও ৮টি ফিল্ম আছে। যা আমি দুই বাংলার সেরা ৮ জন কবির কবিতা থেকে করছি। প্রত্যেকটি কবিতার কাহিনি উৎস থেকে নিচ্ছি। এটিকে আমি ‘পোয়েটিক র রিয়ালিজিম’ তৎপরতা বলছি। এই তৎপরতাকে আমার স্লোগান হিসেবেও নিয়েছি। আর সিনেমাকে আমি একটু অন্যভাবে দেখি, আপনারা নিশ্চয়ই জানবেন। তা হলো সিনেমা কোনো কন্টেন্ট নয়, বেসিক্যালি সিনেমা হচ্ছে ফিলোসফিক্যাল কমিটমেন্ট এবং ‘কাব্যিক র রিয়ালিজিম তৎপরতা’। এটি আমার সিনেমার প্রথমদিকেই থাকবে। কারণ সিনেমাকে আমি কন্টেন্ট বলছি না। বলছি ‘ফিলোসফিক্যাল কমিটমেন্ট’। মানে হচ্ছে যে, আমি কমিটমেন্টের জায়গা থেকে সিনেমা করছি, নট দ্যাট এন্টারটেইনমেন্ট। এন্টারটেইন হচ্ছে অতিরিক্ত। এই জিনিসটার ভেতর দিয়ে যে কেউ এন্টারটেইন নিতে পারে। বা নিবে। আর কারো ভালো না লাগলে ভালো লাগবে না। কিন্তু আমার মূল দায়িত্ব হচ্ছে কমিটমেন্ট। মানে পলিটিক্যাল অ্যান্ড ফিলোসফিক্যাল কমিটমেন্ট। সিনেমাকে আমি কন্টেন্ট হিসেবে দেখতে চাই না। কন্টেন্ট হচ্ছে একটি ব্যবসায়িক চিন্তা। আমি ওই ব্যবসাটাকে মুখ্য মনে করছি না আমার সিনেমার জন্য। কারণ আমি একজন যোদ্ধা, ফাইটার। আমি আমার কমিটমেন্ট ফুলফিল করার জন্য ফাইট করছি। আমার টাকা নেই। আমি নিজের জমি বিক্রি করে টাকা নিচ্ছি, ধার করছি, মায়ের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছি। বিভিন্ন ভাবে আমি টাকা কালেক্ট করে ছবি বানানোর চেষ্টা করছি। আমি অব্যাহত ভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি।

জাগো নিউজ: পুরস্কারপ্রাপ্তি এবং নিজের বইয়ের প্রচারণাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন?মাসুদ পথিক: এখন প্রচারের মাধ্যমই হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যম—যেটা ফেসবুক, অনলাইন। এখন যুগ পরিবর্তন হচ্ছে। প্রিন্টিং যে পত্রিকাগুলো আছে, তা আজকে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। সব এখন অনলাইন হয়ে গেছে। মানুষ আর পত্রিকা পড়ে না। যে পত্রিকার সার্কুলেশন আগে পাঁচ লাখ ছিল তা কমে এখন ২০ হাজার। তার মানে হচ্ছে যে মার্কেটিংটা চলে এসেছে ফেসবুক বা অনলাইনে। তার মানে আমাদের বইটা যে আসতেছে তা ফেসবুকে বলতে হয়। তার মানে ফেসবুকটাকে আমি প্রচারপত্রই মনে করি। ফেসবুকটাকে আমি ব্যক্তিগত কিছু মনে করি না। আপনারা দেখবেন যে ফেসবুকে আমি ব্যক্তিগত কিছু বলি না। আবার কারো সমালোচনাও করি না। আমি মনে করি না যে, এখানে বেশি আমার সমালোচনা করা দরকার। আমার কাজের মধ্যেই সমাজের, রাষ্ট্রের সমালোচনা আছে। সেটা কখনো কখনো সরাসরি কখনো সুরের স্পিড বাড়ায়ে, কখনো মিউজিক রিয়ালিজম ধারায় একটা সমালোচনা অটোমেটিক চলে আসে। একজন শিল্পীর সরাসরি বলতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি রূপক, মেটাফোর দিয়ে বলতে পারি। সিম্বল, এলিগরি দিয়ে বলতে পারি। এজন্যই ফেসবুক প্রচারমাধ্যম ও সহায়ক। এজন্যই ফেসবুকে আমি বিজ্ঞাপন দিচ্ছি, বইয়ের প্রচার করছি। আমার হয়তো টাকা নেই। তাই হয়তো বইয়ের প্রচার অন্য জায়গায় দিচ্ছি না। তাই এটা ভালো পজিটিভ। আর যারা ভালো মনে করবেন, তারা কিনবেন। আর যারা ভালো মনে করবেন না, তারা কিনবেন না। ফ্রিডমটা আছে আর কি।

আরও পড়ুন: বায়তুল্লাহ্ কাদেরীর কবিতা কেন ভালো লাগে? 

জাগো নিউজ: আপনার এবং বইমেলার পাঠকের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?মাসুদ পথিক: পাঠকরা তাদের অভিরুচির ওপর বই কিনবেন এবং বই খুঁজে নিবেন। কার বই কার পছন্দ সেটা বিষয় বা বই কেনার জন্য যদি আকৃষ্ট করতে পারে বা বিজ্ঞাপন বা ওরাল যে বিজ্ঞাপন যেমন ‘মাসুদ ভাইয়ের এই বইটা ভালো’ এটা যখন হবে; তখন পাঠক কিনবেন। ভালো পাঠকের জন্য ভালো বই লাগবে। আবার ভালো লেখকের জন্য ভালো পাঠক লাগবে। এটা পরিপূরক। কারণ দায়টা শুধু লেখকেরও না আবার পাঠকেরও না। এটা পারস্পরিক। এ জন্য একটা উচ্চমানের বোধের জায়গা থেকে একটা সোসাইটির কালচার তৈরি করতে হবে। যাতে মানুষের মধ্যে বোধের জায়গাটা আরও বিস্তৃত হয়। আরও সুদৃঢ় হয়। যেন আরও কমিউনিকেট করতে পারে। বুঝতে পারে।

এসইউ/জিকেএস