সাহিত্য

রাজীব দাসের কবিতার ব্যবচ্ছেদ

লতিফ জোয়ার্দার

Advertisement

যখন আমার মন খারাপ হয়; তখন আমি কবিতা পড়ি। যখন আমার হৃদয় তোলপাড় করে; তখনও আমি কবিতা পড়ি। সে কবিতা কখনো আমাকে ভাবনার জগতে নিয়ে যায়। আমি কবিতার রহস্যজটে নিজেকে বন্দি করে রাখি। হতে পারে সে কবিতা মলাটবন্দি। আবার এসব কিছুর বাইরেও হতে পারে। পৃথিবীতে প্রথম কে কখন কবিতা রচনা করেছিল, তা আজ কেউ বলতে পারে না। তবে দিনে দিনে কবিতার ধরন পরিবর্তন হয়েছে। বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে। অক্ষরবৃত্ত অথবা মাত্রাবৃত্ত ছন্দ থেকে আমরা টানাগদ্যের দিকে হেঁটেছি। এই যে আজ আমার কিছু কথার ভূমিকা, তা-ও এক কবির জন্য। একজন কবির কবিতার জন্য। সে কবির সাথে আমার ভাবের বিনিময় মাধ্যম কবিতা। কবিতার স্বর, কবিতার রস আমাকে তার কাছে নিয়ে যায়। এতক্ষণে হয়তো আপনারা সেই কবির কথা ভাবছেন। তার কবিতার কথা ভাবছেন। যার কবিতা আজ আমি ব্যবচ্ছেদ করবো। যার কবিতা আজ আমি আলোচনায় আনবো। আলোচ্য কবির নাম রাজীব দাস।

অতিসম্প্রতি তার কিছু কবিতায় প্রথম আমি চোখ বুলিয়েছি। দ্বিতীয়ত তার কবিতা পাঠ করেছি আমি। কবিতা, প্রেম আর নারী আমার কাছে কেমন একই রকম মনে হয়। নারীর জন্য যে আলোকলতা আমরা হৃদয়ে ধারণ করি। তেমনই কবিতার জন্যও হৃদয় ব্যাকুল হয়। চোখের দেখা থেকে সেই কবিতার আমরা পাঠোদ্ধার করি। আসুন আমরা আলোচ্য কবির একটি কবিতা পাঠ করি। কবিতার শিরোনাম ‘প্রয়োজন’। ‘তোমার অন্তর্জাল প্রয়োজনের প্রহেলিকার কখনও বুঝতে পারিনি বলেই। একহারা চিন্তা সঙিনের তীব্র অপমান আকণ্ঠ বিষে বারবার হয়েছি জর্জরিত শিহরিত।’

কবি কবিতায় যা লেখেন, কবিতায় যা বলতে চান। সে কবিতা তার জীবনের না অন্য কারো জীবনের। তা বর্তমান না অতীতের। তা আছে না বিলীন হয়েছে। এসব তার কবিতার জন্য যথেষ্ঠ না হলেও কবিতার পাঠক কবিতায় খুঁজে পায় তার আপন ভুবন। সেখানে তার ব্যক্তিগত জীবন, ব্যক্তিগত সীমানা, প্রেম-প্রণয় পেয়ে থাকে বলে কিছু কবিতা পাঠযোগ্য হয়। পাঠকপ্রিয়তা পায়। তবে কবি কোনো কিছুর জন্য কবিতা লেখেন না। কোনো প্রাপ্তির কাছে কবি মাথা নোয়ায় না। তার কবিতায় সে পাঠককে এক প্রকার বার্তা দিয়ে যান। সে বার্তা একজন পাঠকের কাছে রূপকল্পময় হয়। তার ভাবনায় নাড়া দেয়। তাকে আবেগী করে। সেই কবিতায় পাঠক কখনো আশ্রয় প্রার্থনা করে।

Advertisement

আমরা কবি রাজীব দাসের আরও একটি কবিতার কাছে যাই। তিনি ‘অনুরাগে বাঁধিব তোমায়’ কবিতায় বলেছেন, ‘তোমার অনাসক্ত দুটি আঁখির নীল সরোবর আমায় দাও। আমি রাজহংস হয়ে জলকেলিতে শকদল মালা দিবো।’ কবি সব সময়ই প্রেমের কাছে পরাজিত। কবি প্রেমের কাজেই নিজেকে সমর্পণ করেছেন বারবার। প্রেমের কাছে ফিরেছেন বারবার। প্রেমেই যেন আলোচ্য কবির আশ্রয়। প্রেমের জন্য যেন জন্ম হয়েছে তার। তবে তিনি কেবলই নারী প্রেমের কাছে নিজেকে বেঁধে রাখেননি। প্রকৃতি প্রেম, দেশপ্রেম সবই আছে তার কবিতায়। সে কারণে আমার মনে হয়েছে, আমি এই কবির যতগুলো কবিতা পাঠ করেছি। প্রায় প্রতিটি কবিতাই তার প্রেম দ্বারা আশ্রিত। প্রেমের জন্য তার নিজের কবিতার ভুবনে কখনো রচনা করেছেন তাজমহল। সর্বোপরি তিনি প্রেমের কবি, প্রেমিক কবি। একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্য দিয়ে তিনি হেঁটে যান কবিতার কাছে। তবে একথা ঠিক, মাত্র পঁচিশটি কবিতা দিয়ে একজন কবিকে নির্ণয় করা যায় না। তাকে পুরোপুরি নির্ণয় করতে হলে তার আরও কিছু কবিতার কাছে যেতে হবে।

কবির জীবনের সাথে কবিতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটা যেন আরেকটার পরিপূরক। কবিতার সাথে কবির ব্যক্তিজীবন, কবি কখনো কখনো আলাদা করতে পারেন না। অধিকাংশ কবির জীবন হয় বাউ­ণ্ডুলেময়, হয় আবেগময়। তাই কবিতা লেখাকে কেন্দ্র করে প্রতিটি সংসারে অশান্তির তা­প প্রতিনিয়ত দেখা যায়। কবিতা লেখাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন এমন পরিবার খুব কমই আছে বলে মনে হয়! সব মিলে কবি যেন অন্য মানুষ। অদেখা অন্য গ্রহের কষ্টদানব। তারা শুধু কষ্ট পেতেই ভালোবাসেন যেন। আর কষ্ট লালন করে যান সারাটি জীবন ধরে। নিজেকে আড়াল করে প্রতিটি ক্ষণে বুকের তাজা খুন দিয়ে রচনা করে যান দীর্ঘশ্বাসের কাব্য।

কবিতার মুগ্ধতায় আমার চারপাশ কেঁপে ওঠে। আমি চোখ মেলে কবিতার কাছে যাই। কবিতার সুর ও ছন্দে বিমোহিত হই। এক নান্দনিক যাত্রায় নিজেকে উপস্থিত করি। কিছু সময়ের জন্য নিজেকে কবি ভাবতে ইচ্ছে করে আমার। তবে ইচ্ছে করলেই তো সবাই সবকিছু হতে পারেন না। হয়তো আমি কবি অথবা কবি নই। তবে আমি বিশ্বাস করি। আমার হৃদয়ে ধারণ করি, আমার হৃদয়ে যে কাব্যপ্রেম আছে, তা অনাদিকালের। হাজার বছর ধরে আমি কবিতার সাথে আছি। কবিতার পথে হাঁটছি। কবিতার প্রেমে জড়িয়ে আছি। আমি হাসতে হাসতে প্রতিদিন কবিতার প্রেমে পড়ি। কবিতাই যেন আমার প্রেমিকা। তার ভালোবাসায় বিমুগ্ধ বিশ্বাস স্থাপন করি। আমি নেড়েচেড়ে দেখি আমার কবিতা। বিনম্র উচ্ছাসের ভেতর কবিতা হারায় কখনো।

যে উৎস থেকে কবিতার সৃষ্টি হয়, তা আমি কখনো দেখিনি। তবে যে ভাবযন্ত্রণায় বাক্য তৈরি হয়। কবিতার পঙক্তি তৈরি হয়। আমি অনুভব করি কবিতার আগমন বার্তা। কখনো মনে হয় আমি যা লিখি! যে উপমা তৈরি করি, তা আমার নিজের নয়। কেউ আমাকে দিয়ে যেন লিখিয়ে নিচ্ছেন কবিতা। আমি ইচ্ছে করলেই কবিতা লিখতে পারি না। কবিতা যেন আমার ওপর কখনো কখনো নাজিল হয়। বারবার কবিতা লেখার পর মনে হয়, এই কবিতা তো আমার নয়। আমি কখনো কোনোদিন লিখিনি এ কবিতা। অদৃশ্য কেউ আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে এ কবিতা।

Advertisement

আলোচ্য কবি রাজীব দাসকে আমার আমার মতোই মনে হয়েছে। আমাকে দেখলে যেন আমি তাকে দেখতে পাই। আসুন এই কবির আর একটি কবিতার পঙক্তি পড়তে পড়তে কবিতার ভাব সাগরে ডুবে যাই। কবিতার শিরোনাম ‘বোধের বিদ্রুপ’। কবি বলেছেন, ‘যাদের খুশি, সুখী রাখতে নিজের প্রাণময় সুখ মাড়িয়ে, তাড়িয়ে—আমি তুমি সে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত শুধুই অর্থ বিত্তের, প্রাচুর্য চিন্তাতে বিভোর থেকেছি।’

এসইউ/এমএস