ফিচার

মঙ্গল গ্রহ নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ কেন?

মঙ্গল গ্রহ নিয়ে মানুষের আগ্রহ সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই। মঙ্গল গ্রহের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘মার্স’। নামটি এসেছে প্রাচীন যুগের রোমানদের যুদ্ধদেবতার নামানুসারে। দেখতে লাল রঙের বলে মঙ্গল গ্রহকে লাল গ্রহ বলেও ডাকা হয়। সূর্য থেকে দূরত্বের বিচারে চতুর্থ এবং ভরের বিচারে তৃতীয় গ্রহ মঙ্গল পৃথিবীবাসীর বড়ই প্রিয়। পরম নিকট আত্মীয়। রাতের আকাশে সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করে শুক্র গ্রহ। যাকে আমরা জানি শুকতারা নামে। উজ্জ্বলতায় শুক্র গ্রহের পরেই স্থান মঙ্গল গ্রহের।

Advertisement

মানুষ যাবে মঙ্গলে ২০২৩ সালেযুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ সংস্থা ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) ২০২৩ সালের জুনে চারজনকে মঙ্গল গ্রহে বসবাস করার জন্য প্রস্তুত করছে। নাসার বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, চারজন মানবসহ চারটি মঙ্গলযান মঙ্গল গ্রহে মানব অনুসন্ধান ভ্রমণে যাবে। পৃথিবীর নিকট প্রতিবেশী মঙ্গল গ্রহে মানুষ পাঠাতে আমেরিকান মহাকাশ সংস্থার দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা এটি। এর আগে নাসা নানা রকম ডিজিটাল অত্যাধুনিক সিস্টেম পাঠিয়েছে মঙ্গল গ্রহে। যেমন- নাসা স্যাটেলাইট, ইনসাইট ল্যান্ডার, পারসিভারেন্স রোভারের সাথে একটি রোভার মিশন, ইনজেনুইটি, ছোট রোবোটিক হেলিকপ্টার ইত্যাদি। লাল গ্রহ নামে পরিচিত মঙ্গলের বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ হিসেবেই এসব পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে চারজন স্বেচ্ছাসেবক মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তাদের আরও প্রস্তুত করার জন্য নাসা ১২ মাসের একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। নাসার প্রত্যাশা, মানুষ শেষ পর্যন্ত মঙ্গলে অবতরণ করবে। তারা সেখানে থাকবে এবং পরিস্থিতি বুঝে আবাসস্থল গড়বে।

মঙ্গল গ্রহের আবহাওয়া কেমন?মঙ্গল গ্রহের একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর দিনের হিসাব অনুসারে পৃথিবীর দ্বিগুণ সময় লাগে অর্থাৎ ৬৮৭ দিন লাগে। আর মঙ্গল গ্রহে ‘দিন’ স্থায়ী হয় পৃথিবীর চেয়ে সামান্য বেশি। ২৪ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট। অর্থাৎ ৬৮৭ দিনে সূর্যকে এবং ২৪ ঘণ্টা ৩৭ মিনিট এবং ১২ সেকেন্ডে নিজ অক্ষে একবার ঘোরে। সূর্য থেকে গড় দূরত্ব ২২.৮ কোটি কিলোমিটার। ব্যাস ৬৭৫৮ কিলোমিটার, পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘোরে। পৃথিবী থেকে মঙ্গলের দূরত্ব ৪৯ কোটি ৭০ লক্ষ কিলোমিটার, গড় তাপমাত্রা ৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা ৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। পানির পরিবর্তে আছে চিরতুষার পার্মাফ্রস্ট, অভিকর্ষ পৃথিবীর পাঁচ ভাগের দুভাগ অর্থাৎ প্রতিবর্গ সেকেন্ডে ৩৯৩ সেন্টিমিটার। বাতাসের চাপ পৃথিবীর সমুদ্রতলে বাতাসের চাপের তুলনায় একশ গুণ কম। এ গ্রহে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেশি। কোনো ওজোন স্তর নেই। বাতাসের বেগ ঘণ্টায় একশ কিলোমিটার। প্রায়ই মঙ্গল গ্রহে ঝড় ওঠে। যা মাসাধিক কাল স্থায়ী হয়। ভূমি থেকে ত্রিশ কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত ঘূর্ণাবর্তের সৃষ্টি করে।

আরও পড়ুন: জলে ভাসে ডাঙায় চলে

Advertisement

মঙ্গলের দুটো চাঁদের রহস্য কী?মঙ্গলের শক্ত পৃষ্ঠ আছে। পৃথিবী থেকে গ্রহটিকে দেখায় লাল রঙের। এ কারণেই একে বলা হয় লাল গ্রহ। আসলে মঙ্গল গ্রহের মাটির রং লাল-খয়েরি বা গোলাপি। মঙ্গলের উপগ্রহ রয়েছে দুটো। আকারে খুব ছোট ছোট। নাম ফোবোস আর ডিমোস। গ্রিক ভাষায় ডিমোস অর্থ সন্ত্রাস আর ফোবোস অর্থ ভয়। ১৮৭৭ সালে মার্কিন জ্যোতির্বিদ আসাফ এ দুটো উপগ্রহ আবিষ্কার করেন। তবে ১৬১০ সালেই জোহান কেপলার ধারণা করেছিলেন মঙ্গলের হয়তো দুটো উপগ্রহ থাকতে পারে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, মঙ্গল যখন পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে থাকে; তখন উপগ্রহ দুটোর মধ্যে দূরত্ব দাঁড়ায় ৫ কোটি ৫০ লাখ কিলোমিটার। দুই উপগ্রহকে বলা হয় মঙ্গলের দুটো চাঁদ। কিন্তু মঙ্গল তেমন জোৎস্না পায় না। কারণ দুটো চাঁদের কোনোটাই তেমন আলো দিতে পারে না। মজার ব্যাপার হলো, দুটো চাঁদের কোনোটাই গোল নয়।

আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, গালিভার ট্রাভেলসের তৃতীয় পর্বের লেখক জোনাথন সুইফট ডিমোস ও ফোবোসের বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, মঙ্গলকে দুটো উপগ্রহ প্রদক্ষিণ করে, কাছেরটা মঙ্গলের কেন্দ্র থেকে নিজের ব্যাসের তিনগুণ দূরে অবস্থান করে, আর অন্যটা নিজের ব্যাসের পাঁচগুণ দূরে অবস্থান করে। প্রথমটা মঙ্গলকে দশ ঘণ্টায় ও দ্বিতীয়টা মঙ্গলকে একুশ ঘণ্টায় একবার প্রদক্ষিণ করে। মঙ্গলের চেয়ে জোরে ঘোরে ডিমোস। ফোবোস কিন্তু মঙ্গলে একদিনে দুবার ঘোরে। দুটো উপগ্রহই মঙ্গলের বিষুবরেখা বরাবর মঙ্গলকে প্রদক্ষিণরত। ফোবোসের পৃষ্ঠদেশ শক্ত। কোনো জীবের অস্তিত্ব নেই, পাতলা বায়ুমণ্ডল আছে। পানিযুক্ত মেঘও আছে। নিয়মিত ঋতু পরিবর্তন করে। তুষারপাত হয়। বিখ্যাত গিরিখাদ এ মঙ্গলেই অবস্থিত। যার নাম হলো অলিম্পাস মানস। কিন্তু ফোবোসের এমন কিছুই নেই। তাই ১৯৬৬ সালে কার্ল সাগান এবং রুশ বিজ্ঞানী সক্লোভস্কি দাবি করেছিলেন ফোবোস ফাঁপা। কারণ এটি যেভাবে ঘোরে তাতে একে ফাঁপা বলেই মনে হয়। এর ত্বরণ কৃত্রিম উপগ্রহ স্যাটেলাইটের মতোই। জোনাথন সুইফট যে আশ্চর্যটি প্রদর্শন করেছিলেন তা হলো, মঙ্গলের কেন্দ্র থেকে উপগ্রহ দুটো তাদের আবর্তনকালের বর্গফল ও মঙ্গলের কেন্দ্র থেকে তাদের দূরত্বের ঘনফল প্রায় সমানুপাতিক। এ তথ্য আবিষ্কৃত হয় জোনাথনের বই বের হওয়ার দেড়শ বছর পর। কিছু কিছু মহাকাশচারী ও বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, তারা মঙ্গল গ্রহে লম্বা টানা টানা রেখা দেখে এসেছেন। যেগুলোকে নদী, খাল বলেই মনে হয়। আর এ থেকেই প্রশ্ন জাগে যে, মঙ্গল গ্রহে কি কোনোকালে বুদ্ধিমান জীবের বসবাস ছিল? বা এখনো কি আছে? আর ওই খালগুলো কি ওইসব জীবের দ্বারাই তৈরি? প্রায় একশরও বেশি বছর আগে আবিষ্কৃত হওয়া এ গ্রহে সামান্য হলেও পানির অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু বর্তমানে উন্নত টেলিস্কোপ বা মহাকাশযানগুলোর নেওয়া ছবিতে খালের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। মঙ্গল গ্রহের উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু আইস-ক্যাপ দিয়ে ঢাকা। আসলে মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল খুব পাতলা। এখানে আছে অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেন গ্যাস। গবেষকদের ধারণা, মঙ্গলের মাটির তলায় তরল অবস্থায় পানি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তাই আবহাওয়ায় পরিবর্তন ঘটে মঙ্গলে।

আরও পড়ুন: বাংলাদেশ যেভাবে হলো বিশ্বশান্তির রোল মডেল

মঙ্গলে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা কতটা?গবেষকদের মতে, পৃথিবী সূর্য থেকে গড়ে পনেরো কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছে। যদি পৃথিবী মাত্র এক কোটি কিলোমিটার সামনে এগিয়ে যায়, তবে সূর্যের প্রখর উত্তাপে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার এক কোটি কিলোমিটার পেছনে সরে গেলেও বিপদ। অর্থাৎ হ্যাবিটাল জোন হলো সেই এলাকা; যেই নির্দিষ্ট অবস্থানে গ্রহ-উপগ্রহ বিচরণ করলে প্রদক্ষিণরত নক্ষত্র তাপ, সেই গ্রহ-উপগ্রহ সুষম মাত্রায় পায় পানি। যাতে অধিক উত্তপ্ত বা বরফ হয়ে না যায়। উদ্ভিদের সালোক সংশ্লেষণ যাতে ব্যাঘাত না হয়। মঙ্গলকে ধরা হয় হ্যাবিটাল জোনে। এ হ্যাবিটাল জোন বা ইকোস্ফীয়ার হলো সেই গ্রুপ, যে গ্রুপে মানুষের বাসযোগ্য গ্রহ-উপগ্রহগুলো বিচরণ করে থাকে। যেমন- পৃথিবী এমন একটি অবস্থানে আছে, যার একটু এদিক-সেদিক হলেই মানবকুল ধ্বংস হয়ে যাবে। পৃথিবী ঠিক এমনই একটি অবস্থানে রয়েছে। এতদিন শুক্র, পৃথিবী ও মঙ্গল এ জোনে অন্তর্ভুক্ত। তবে শুক্রের অত্যাধিক উত্তাপের জন্য একে ইকোস্ফীয়ার থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অপরদিকে মঙ্গলকে কিন্তু এখনো এ জোনে আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। কারণ বিজ্ঞানীদের ধারণা, মঙ্গলের বাহ্যিক পরিবেশ বসবাস উপযোগী। তবে ঈষৎ ঠান্ডা। এর প্রমাণও রয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে। ১৯৮৪ সালে একদল বিজ্ঞানী অ্যান্টার্কটিকায় একখণ্ড উল্কাপিণ্ড খুঁজে পান। বহু গবেষণার পর ১৯৯৬ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেন, উল্কাপিণ্ডটি মঙ্গল থেকে আগত। এর গঠনগত বৈশিষ্ট্য, অক্সিজেন আইসোটোপের বণ্টন এবং অন্য বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতিতে বিজ্ঞানীরা একে মঙ্গলের অংশ বলেই চিহ্নিত করেন। উল্কাপিণ্ডটির ওজন ১.৯ কেজি। এতে ৩৮০ ন্যানোমিটার দীর্ঘ অনুজীবের ফসিল পাওয়া গিয়েছিল। যা পরে পাথফাইন্ডার কর্তৃক বিশেষায়িত মাটির অনুরূপ ধর্ম প্রদর্শন করেছে। এতে কার্বন-১৩ আইসোটোপের আধিক্য দেখা গেছে। আরও পাওয়া গেছে ম্যাগনেসাইট, সাইডেরাইট, জৈব যৌগ পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বন ইত্যাদি। যা একমাত্র মঙ্গলেই প্রাপ্ত।

Advertisement

অ্যারিস্টাকার্স (খ্রিষ্টপূর্ব ২৩০-৩১০), টাইকো প্রভৃতি স্কলার মনীষী কর্তৃক প্রণীত মহাকাশ নকশায় মঙ্গলের অবস্থান সর্বদাই চতুর্থ স্থানে দেখা যায়। ১৮৭৭ সালে ইতালীয় জ্যোতির্বিদ গিওভার্নি শিয়ারাপ্যার্লি তো ঘোষণাই করে বসেন-তিনি নাকি টেলিস্কোপ দিয়ে মঙ্গলের বুকে প্রচুর সমান্তরাল রেখা দেখতে পেয়েছেন। তার সোজাসাপ্টা কথা-মঙ্গলের মানুষ মঙ্গলের বুকে অনেক লম্বা লম্বা খাল কেটেছে। অবশ্য এ মতবাদ পরে মিথ্যা প্রমাণিত হলেও একটি বিষয়ে সব এক্সবায়োলজিস্টরা এখনো একমত। তাদের মতে, বহুকাল পূর্বে মঙ্গলে একটি সুসভ্য জাতির বসবাস ছিল। কোনো কারণে হয়তো তারা ধ্বংস হয়ে গেছে। যদিও এর কারণ এখনো অজানা। তবে নাসার আগামী বছরের মিশন সফল হলে খুব শিগগিরই মানুষ তা জানতে পারবে।

লেখক: বিজ্ঞান লেখক ও গবেষক, এমফিল স্কলার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এসইউ/এমএস