ফিচার

রক্তদান: জীবন বাঁচানোর অনন্য সুযোগ

তানজিদ শুভ্র

Advertisement

আজ ১৪ জুন, বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। ২০০৪ সালে দিবসটি প্রথম পালিত হয়। নিরাপদ রক্ত নিশ্চিতকরণ ও স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উৎসাহ করতেই বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে দিবসটি। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে-‘গিভ ব্লাড, গিভ প্ল্যাজমা, শেয়ার লাইফ, শেয়ার অফেন’। সহজ বাংলায় এর অর্থ দাঁড়ায়-‘রক্ত দান করুন, দান করুন প্লাজমা, যতবার সম্ভব গ্রহণ করুন জীবন বাঁচানোর এ অনন্য সুযোগ।’ আন্তর্জাতিকভাবে এবছর বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজক দেশ আলজেরিয়া।

আজকের এই বিশেষ দিনে কয়েকজন তরুণ রক্তদাতার সঙ্গে কথা বলে তাদের অনুভূতি আর অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছেন তানজিদ শুভ্র-

গণমাধ্যমকর্মী নজরুল ইসলাম জুয়েল একজন নিয়মিত রক্তদাতা। নজরুল ইসলাম জুয়েলের রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। রক্তদান করতে ভালো লাগার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন চিন্তা করি আমার রক্ত দেওয়ার মাধ্যামে একজনের জীবন বেঁচে গেছে, তখন অজানা তৃপ্তি পাই। রক্ত দেওয়ার পর রোগীর স্বজনদের হাসিমুখই আমার পরম প্রাপ্তি।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘রক্তদানের ব্যাপারে আরেকটা ভালো লাগার বিষয় হলো যখন আমার রক্তদানের কথা শুনে আরেক স্বেচ্ছাসেবী ভাই অনুপ্রাণিত হয়। যখন কেউ এসে বলে- আপনার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে আজ আমি ব্লাড নিয়ে কাজ করছি। তখন মনের অজান্তেই আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয়ে যাই।’

রক্তদান করতে গিয়ে বিড়ম্বনা নিয়ে তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘মাঝে মাঝে রক্ত দিতে গিয়ে অনেক খারাপ লাগে, রোগী পাওয়া যায় না কিংবা যার রক্ত লাগবে না, তার স্বজনরা শুধু শুধুই রক্তদাতাদের নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে দেয়।’

জুয়েল আরও জানান, ১৫ তম বার রক্ত দেওয়ার জন্য এ রকম ৭ বার ঘুরে আসতে হয়ছিল কিন্তু আল্লাহ তায়ালার রহমতে ২৪ বার দিয়েছি আর ২৫ তম বার দেওয়ার অপেক্ষায় আছি। ইচ্ছা আছে রক্তদানে সেঞ্চুরি করা।

আরেক স্বেচ্ছাসেবী হযরত আলী। তার রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। এরই মধ্যে ১০ বার রক্তদান করেছেন। তিনি বলেন, রক্তদানের পরে মনে হয় অসহায় মুমূর্ষু মানুষের জন্য সামান্য বা ক্ষুদ্রতম কিছু করতে পেরেছি। তিনি আরও বলেন, আমি কোনো রোগীর আত্মীয়দের কাছ থেকে এক ফোঁটা পানিও খাই না। তবে সম্ভবত এক বা দুইবার রোগীর আপনজনদের অনুরোধ ফেলতে পারিনি, তাই ডাবের পানি খেতে হয়েছে ইচ্ছার বিরুদ্ধে আবার অনেক রোগীর আত্মীয়রা ব্লাড দেওয়ার পর একটা বারও জিজ্ঞেস করেনি বাসায় ঠিকভাবে আসতে পেরেছি কি না। অনেক মেডিকেলের স্টাফদের ব্যবহার এতো বাজে যা বলার মতো ভাষা নাই। একবার সাভারের এক মেডিকেলে ব্লাড দিতে গিয়ে খাবার পানি চেয়েছিলাম মুখের উপর বলে দিয়েছে পানি নাই এখানে রোগীর লোকের কাছে বলেন পান্স করার জন্য, পান্স চেয়েছিলাম কিন্তু তারা তা নিয়ে অনেক কথা শুনিয়েছিল। এটা নিয়ে বাক বিতন্ডাও হয়েছে অনেক। এমন অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে রক্তদান করতে গিয়ে।

Advertisement

ডোমারের তরুণ স্বেচ্ছাসেবক সুজন। নানা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ কাজ করে আসছেন তিনি। সুজনের রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ। ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৪৪ বার বি পজেটিভ ভালোবাসা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন। প্লাটিলেট ০৩ বার, রক্ত ৪১ বার, এ নিয়ে সর্বমোট ৪৪। সুজন বলেন, ‘এই অনুভুতি প্রকাশ করার মতো নয়। রক্তদান নিয়ে আমার কয়েকটি ছোট্ট নাটিকা লেখা আছে যা ভবিষ্যতে প্রকাশ করবো’।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বাঁধনের জাবি ইউনিটের নিয়মিত রক্তদাতা ও কর্মী জিল্লুর রহমান রিয়াদ। রিয়াদের রক্তের গ্রুপ এ পজিটিভ। ১৪ জুন, আন্তর্জাতিক রক্তদাতা দিবস। তিনি শুরুতেই আজকের দিবস প্রসঙ্গে বলেন, ‘অনেক প্রতিষ্ঠিত মিডিয়ায় দিনটিকে রক্তদান দিবস হিসেবেও উল্লেখ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক একটা দিবস নিয়ে আমাদের এরকম বিভ্রান্তি খুবই সঙ্কটের বিষয়। যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি উদযাপন করা হলে, স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের একটু উৎসাহিত করা গেলে, রক্তদান সম্পর্কিত গঠনগুলোকে কিছুটা প্রণোদনা প্রদান করা হলে দিবসটির যথার্থতা সবার বোধগম্য হবে মনে হয়’।

নিজের রক্তদানের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালের আগস্ট থেকে নিয়মিত বিরতিতে ১৯ বার রক্তদান করার পর আমার উপলব্ধি হচ্ছে, ভালো মন্দ সব কাজের ক্ষেত্রেই পরিবারের একটা প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে। আমি কী কাজ করব, কাদের সঙ্গে মিশব, কীভাবে নিজের জীবন পরিচালনা করব এসব ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কিশলয়’ এর রক্তের গ্রুপ নির্ণয় কর্মসূচীতে প্রথম আমার রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করি। আব্বু তখন কিশলয়ের উপদেষ্টা আর তিনিই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ১৮ বছর বয়স হলে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মত রক্তদান করি’।

রিয়াদের রক্তদানের উৎসাহের পেছনের কথা স্মরণ করে জানান, ‘রক্তদানের এই ধারাবাহিকতা কিন্তু হুট করেই আমার মাঝে তৈরি হয়নি। আমার আব্বু নিজে ছিলেন একজন রক্তদাতা। আমাদের এলাকারই একজন প্রসূতি নারীকে তিনি রক্তদান করেছিলেন। আমার ভাইয়া নিয়মিত রক্ত দিয়ে থাকেন। অনেকটা পারিবারিক আবহেই আমার রক্তদান কার্যক্রম চলছে। গতবছর থেকে ছোট ভাইও নিয়মিত রক্তদান করছে। প্রথমবার রক্তদানের পর জ্বরসহ হালকা অসুস্থ হয়ে গেছিলাম। তখন ডা. উজ্জ্বল ভাইয়ের পরামর্শে কোনো ঔষধ সেবন ছাড়াই শুধু বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ হয়ে যাই’।

তিনি আরও যোগ করেন, ‘রক্ত নিয়ে ঠিক কবে থেকে কাজ করছি সেটা মনে নাই। তবে ২০১৬ এর ডিসেম্বরের এক শীতের সকালে বন্ধু তামিমকে বাসায় গিয়ে রাজি করিয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেলে নিয়ে গিয়েছিলাম প্রথমবার রক্তদানের জন্য। এরপর ঠিক কতজনের প্রথম রক্তদানের স্মৃতিতে কোনো না কোনোভাবে আমার নামটি জড়িয়ে আছে সেটা বলতে পারব না। তবে এই ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিক রক্তদাতা দিবসে সব রক্তদাতাদের জানাই সশ্রদ্ধ সালাম’।

লেখক: ফিচার লেখক

কেএসকে/এএসএম