কৃষি ও প্রকৃতি

লক্ষ্মীপুরে শুরুতেই ৮০ কোটি টাকার বীজ উৎপাদন

মেঘনা উপকূলীয় জেলা লক্ষ্মীপুর। এর ব্র্যান্ডিং নাম ‘সয়াল্যান্ড’। এ জনপদের উর্বর ভূমিতে দেশের ৭০ ভাগ সয়াবিন উৎপাদন হয়। বছরে একই মৌসুমে দু’বার সয়াবিন উৎপাদন করেন চাষিরা। রবি মৌসুমের শুরুতে বীজ উৎপাদনের জন্য চাষ হয় এবং মধ্যভাগে উৎপাদিত সয়াবিন বীজসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। লক্ষ্মীপুরে এবার প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন বীজ উৎপাদন হবে, তা-ও জেলার রায়পুর উপজেলার জেগে ওঠা চরের বুকে। যার বাজার মূল্য প্রায় ৮০ কোটি টাকা।

Advertisement

চাষি ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বীজের জন্যই এ অঞ্চলে রবি মৌসুমের (কার্তিক) শুরুতেই রায়পুরের টুনুর চর, চর ঘাষিয়া, চর কাচিয়া, কানিবগার চরে সয়াবিন চাষ করা হয়। প্রথম পর্যায়ে প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন সয়াবিন উৎপাদন হয়। সয়াবিনগুলো বীজ হিসেবেই বাজারজাত করা হয়। প্রতি মেট্রিক টন বীজ প্রায় ২ লাখ টাকা করে বিক্রি করা হয়। সে হিসেবে ৪ হাজার মেট্রিক টন বীজ সয়াবিন বীজ থেকে শুরুতেই লেনদেন হয় ৮০ কোটি টাকা। মৌসুমের মাঝামাঝি সময় (মাঘ) দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিন চাষ করা হয়। এসব জমির উৎপাদিত সয়াবিন দিয়ে বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য তৈরি হয়।

তারা জানিয়েছেন, প্রতি মণ সয়াবিন দেড় হাজার থেকে ২,৫০০ টাকা দরে বিক্রি হয়। এ সময় উৎপাদিত ফসলে জেলাজুড়ে ৫০০ কোটি টাকা লেনদেন হয়। এতে মৌসুমে চরাঞ্চল ও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙা থাকে। শেষ পর্যায়ে উৎপাদিত সয়াবিন থেকে স্বল্প পরিমাণ বীজ হিসেবে সংগ্রহ করেন কৃষকরা।

আরও পড়ুন: মাগুরায় রঙিন ফুলকপি চাষের আগ্রহ বাড়ছে 

Advertisement

এদিকে ৩ বছর আগে নোয়াখালী কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নত জাতের বীজ উৎপাদনের জন্য রায়পুর উপজেলার চরকাছিয়া গ্রামের টুনির চরে সয়াবিন চাষ করা হয়। গবেষণার জন্য সেখানে উৎপাদিত বীজে ভালো ফলন হয়। বীজের জন্য সেখানকার সয়াবিন দেশব্যাপী জনপ্রিয়। এখানকার বীজ লক্ষ্মীপুরের চাহিদা মিটিয়ে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রায়পুর উপজেলার টুনির চর, চর কাচিয়া, ঘাষিয়ার চর, চর খাসিয়া, কানিবগার চর, চরবংশী এবং পার্শ্ববর্তী ভোলার চরের কৃষকরা সয়াবিনের বীজ চাষাবাদ করেন। মেঘনার উপকূলীয় এলাকা হওয়ায় এসব চরের পলি মাটি এবং আবহাওয়া সয়াবিন বীজ চাষের জন্য উপযোগী। এ ছাড়া কৃষকরা লাভবান হওয়ায় এ অঞ্চলের চরগুলোয় বীজ সয়াবিনের চাষাবাদ বেশি হচ্ছে।

রায়পুর উপজেলার দক্ষিণ চরবংশী ইউনিয়নের চর ঘাষিয়া নৌ-ঘাটে সরেজমিনে দেখা যায়, ৭-৮ জন লোক সয়াবিন সংগ্রহ করছেন। তারা জানান, বীজ হিসেবে এ সয়াবিন ব্যবহার করা হয়। এ জন্য খুব সাবধানতায় সয়াবিন দানাগুলো পরিষ্কার করছেন। মণপ্রতি এ সয়াবিন তারা ৮ হাজার টাকা করে বিক্রি করেন। ভালো দাম ও লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক মৌসুমের শুরুতেই সয়াবিন চাষে ঝুঁকছেন।

আরও পড়ুন: লালশাক চাষ করার সহজ উপায় 

Advertisement

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, রবি মৌসুমের মধ্যভাগে (জানুয়ারির শুরু) লক্ষ্মীপুর সদর, কমলনগর, রায়পুরে প্রায় ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিনের চাষাবাদ হয়। এরমধ্যে রামগতি উপজেলারও কিছু অংশ আছে। সয়াবিন ঘিরে তখন ৫০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। দেশের প্রায় ৭০ ভাগ সয়াবিন পাওয়া লক্ষ্মীপুর জেলার ব্র্যান্ডিং নাম দেওয়া হয়েছে ‘সয়াল্যান্ড’। এ সয়াবিন উৎপাদনের জন্য চলতি মৌসুমে ২,২০০ মেট্রিক টন বীজ প্রয়োজন। বিএডিসি ও বিভিন্ন গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে সংগ্রহ করে কৃষকদের সরকারি মূল্যে ১২০ টাকা দরে বীজ সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে ৫ মেট্রিক টন বীজ স্বল্পমূল্যে সরকারিভাবে কৃষকদের দেওয়া হয়।

রায়পুরের চর ঘাষিয়া গ্রামের কৃষক মিজান বেপারী বলেন, ‘এ বছর ১২০ শতাংশ জমিতে সয়াবিন বীজ উৎপাদন করেছি। ভালো ফলন হয়েছে। এখন বীজ সংগ্রহের কাজ চলছে। গেল বছর আমার প্রায় ১০০ মণ সয়াবিন বীজ উৎপাদন হয়েছিল। তখন দ্বিগুণ লাভ হয়েছে।’

একই উপজেলার টুনির চরের কৃষক ইব্রাহিম হোসেন মিয়া জানান, আশ্বিন মাসের শেষের দিকে বীজের জন্য ৩০ হাজার টাকা খরচ করে ১ একর জমিতে তিনি বীজের জন্য সয়াবিন আবাদ করেন। পৌষ মাস থেকেই সয়াবিনগুলো সংগ্রহ করা হয়। ৩০ মণ সয়াবিন বীজ উৎপাদন হবে। পরে এ সয়াবিন থেকে একই জমিতে মাঘ মাসের শেষদিকে বীজ বপন করা হবে।

আরও পড়ুন: ক্যাপসিকাম এখন ভোলার কৃষকদের গলার কাঁটা 

লক্ষ্মীপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. জাকির হোসেন জানান, বপনের জন্য সাড়ে ৫ মেট্রিক টন সয়াবিন বীজ সরকারিভাবে বিএডিসির মাধ্যমে কৃষকদের মাঝে সরবরাহ করা হবে। বিএডিসিসহ বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্র থেকে এ বীজ সংগ্রহ করা হয়। বাকি বীজ সয়াবিন কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন করা হয়। রায়পুরের চরাঞ্চলে প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে সয়াবিনের বীজ চাষ করা হয়েছে।

কাজল কায়েস/এসইউ/জিকেএস