ফিচার

মণিপুরী পাঙালদের বিয়ের রীতিনীতি

রফিকুল ইসলাম জসিম

Advertisement

পৃথিবীর সব সংস্কৃতিতেই বিবাহের অনুষ্ঠান সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতায় রকমভেদে অনুষ্ঠিত হয় বিবাহের অনুষ্ঠান। বিয়েকে ঘিরে পাঙাল বা মণিপুরী মুসলিমদের আছে নানা সংস্কৃতি, রেওয়াজ, আচার-অনুষ্ঠান। আসুন, বাংলাদেশে বসবাসরত মণিপুরী মুসলিমদের বিয়ের আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক।

বাংলাদেশের সর্বত্র বিয়েকে ‘বিয়ে’ কিংবা ‘বিবাহ’ নামে সম্বোধন করা হলেও মণিপুরীদের নিজস্ব ভাষায় বিবাহকে ‘লোহংবা’, ‘নুহংবা’ বলা হয়। ইসলামিকভাবে মণিপুরীরা ‘নিকাহ’ও বলে। মণিপুরী পাঙালদের সংস্কৃতিতে বিবাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্প্রতি প্রাচীনকালের সব আচার-প্রথা হারাতে বসলেও অধিকাংশই এখনো টিকে আছে। মণিপুরী মুসলিম পাঙাল সম্প্রদায়ের বিবাহরীতি বাঙালি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। বিবাহের আনুষ্ঠানিকতা কতগুলো পর্যায়ে বিভক্ত থাকে, তা হলো—

হায়জাবা কাবা বা পাকাকথাবিয়ের আনুষ্ঠানিক পর্বের শুরুতেই ছেলেপক্ষের নিকটাত্মীয়রা কনের বাড়িতে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। একে বলা হয় ‘হায়জাবা কাবা’। এ পর্বে দেনমোহর সংক্রান্ত কথাবার্তা ঠিক করা হয়।

Advertisement

কাপুবা বা মিষ্টিমুখ চূড়ান্ত বাগদান পর্বের জন্যে অনুষ্ঠিত হয় ‘কাপুবা’ বা মিষ্টিমুখ ব্যবস্থা। এ পর্বে ফল-মূল, মিষ্টি, পান, সুপারি ইত্যাদি নিয়ে বরপক্ষের লোকজন কনের বাড়িতে যায়। আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে বরপক্ষ থেকে দেনমোহর প্রদান করে।

পুরজাকএরপর আসে বিয়ের মূল আনুষ্ঠানিকতা। পূর্বে পুরজাকের আগে কার্ড ছেপে দাওয়াত পাঠানোর রেওয়াজ ছিল না। ছিল বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বর বা কনের বাবা মায়ের স্বশরীরী উপস্থিতিতে মৌখিকভাবে দাওয়াত দেওয়া। মজার ব্যাপার ছিল, বিয়ের দিনে মেহমানদের খাওয়ার আয়োজনের যাবতীয় কাজ করতেন মহল্লার লোকজন।

বিয়ের আগের দিন রাতব্যাপী কনের বাড়িতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এটাকে বলা হয় ‘পুরজাক’। পুরজাক অনুষ্ঠানে কনের পরনে থাকে কমিন (বিশেষ পোশাক), খেমচি ব্লাউজ, মাথায় থাকে ব্যতিক্রমী কাজ ও ফুল দিয়ে ঝালর দেওয়া ‘লৈত্রেং’ (গোলাকার)। সঙ্গে পরেন ঐতিহ্যবাহী স্বর্ণালংকার।

আজকাল মেয়ের বাড়িতে খাবারের বিশাল আয়োজন করা হয়। বড় গরু জবাই করে খাওয়ানো হয়। ইসলামে বিয়েতে মেয়েপক্ষের কোনোরূপ খরচ করার কথা না থাকলেও সৌজন্যমূলক আপ্যায়ন করা হয়।

Advertisement

পুরজাক অনুষ্ঠানে কনের বাড়ির অনুষ্ঠানে ও পরের দিন বরের বাড়িতে রাতব্যাপী চলে ঐতিহ্যবাহী গান। তরুণ-তরুণীসহ বিবাহিত লোকজনও গানের উৎসবে মেতে ওঠেন। সঙ্গে যুক্ত হয় ‘থাবাল চোংবা’ নামের বিশেষ নৃত্য। যুবকরা যৌথভাবে কিংবা আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

মণিপুরী মুসলিমদের ধার্মিক পরিবারে কোনো ধরনের নাচ-গানের আয়োজন করা হয় না। একসময় প্রচলিত ছিল, বিয়ের রাতে ‘কাসিদা’ নামে পরিচিত একধরনের লোকঐতিহ্যবাহী বিয়ের গানের অনুষ্ঠান হতো। মণিপুরী ভাষার এ ঐতিহ্য দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে।

বরযাত্রাপুরজাকের পরদিন বিকেলে বর বাঙালিদের ন্যায় পায়জামা, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি ইত্যাদি পরিধান করে বন্ধু-বান্ধবসহ পঞ্চায়েতের লোকজন নিয়ে (পঞ্চায়েতের লোকজন বাধ্যতামূলক) বরযাত্রীর দল রওয়ানা দেয়। এ সময় মা-বাবা ও মুরব্বিদের সালাম করে দোয়া নিয়ে মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী চাদর ‘কাংথমফিদা’র ওপর পা দিয়ে যাত্রা করার রেওয়াজ আছে। বর কনের বাড়িতে পৌঁছায়। মুরব্বিদের অনুমতি পাওয়ার পর প্রবেশ করে। কনের বাড়ির উঠানে কাংথমফিদায় বরযাত্রীদের বসানো হয়। মহল্লার ইমাম সাহেব ইসলামি তরিকায় বিয়ে পড়ান। নিকাহ বা বিবাহ বিভিন্ন ইসলামি অনুষ্ঠান ও উৎসব আয়োজনের মাধ্যমে পালন করা হয়।

নিকাহ অনুষ্ঠানপবিত্র কোরআন তেলওয়াতের মাধ্যমে শুরু করে তওবা ও ইস্তিগফার পাঠ করে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। তিনজন ‘গাওয়া-উকিল’ (১ জন উকিল ও ২ জন সাক্ষী) থাকে। উকিলের হাতে থাকে একটি লাঠি। বর ও কনে আলাদাভাবে নিচুস্বরে কবুল বলে থাকে এবং গাওয়া-উকিল তার সাক্ষী হন। বর ও কনে উভয়কেই তিনবার প্রশ্ন করেন, তারা পরস্পর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি আছে কি না। উভয়ে সম্মতি প্রকাশ করার পর তাদের নিকাহনামা বা বিবাহচুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বলা হয়। এরপর তারা তাদের বয়োজ্যেষ্ঠ ও শ্রদ্ধাভাজনদের কাছ থেকে দোয়া ও আশীর্বাদ নেন। উভয়ের পরিবারের সদস্যরা পুরো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। প্রত্যেকেই নিজের ভূমিকা পালন করেন।

যেদিন নিকাহ পড়ানো হয়। সেদিন কনেকে মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক-পরিচ্ছদ ও অলঙ্কারে সাজানো হয়। প্রচলিত ছিল, কনে ও বর ‘তলায়’ নামে পালকিতে বসার পর চারজন লোক তাদের বহন করে নিয়ে যায়। এছাড়া গাড়ি ব্যবহার করে বিশেষ আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে বরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কনের পরিবার কনেকে সংসার সাজানোর জন্য বিভিন্ন আসবাবপত্র দেয়। বিয়ের পর কনে সাধারণত স্বামীর পরিবারের সঙ্গে থাকেন। তার নিজের পরিবার বরের বাড়িতে পণ্য ও আসবাবপত্র সরবরাহ করে।

ওলিমা বা বউভাতবিয়ের পর ছেলেপক্ষ তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী ও গরিব-মিসকিনদের নিয়ে সামর্থ অনুযায়ী আপ্যায়ন করে। যাকে বাঙালিরা ‘ওলিমা’ বা বউভাত বলে। বিয়ের দিন বরযাত্রী কনেসহ কিছু আত্মীয়-স্বজন বরের বাড়িতে নিয়ে যায়। তখন এশার নামাজ কাছাকাছি সময় চলে আসে। এলাকার গণ্যমান্য মুরব্বিরা নামাজ শেষে বরের বাড়িতে এসে ধনি-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে একত্রে মাটিতে বিছানো মাদুরে (ফিদা) বসে। পঞ্চায়েতের কোনো মুরব্বির বিসমিল্লাহ বলার মাধ্যমে সবাই বিসমিল্লাহ পড়ে খাওয়া শুরু করেন। খাওয়া শেষে মহল্লার ইমাম মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ করেন। মণিপুরী মুসলিমদের খাবারে গরু ও মুরগির মাংস ইত্যাদির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী তরকারি ‘য়ামথাকপা’ (হালিমের মতো) ও ‘এরি’ (মাংসের ঝোল) পরিবেশন করা হয়।

লেখক: মণিপুরী গণমাধ্যমকর্মী।

এসইউ/জেআইএম