ভ্রমণ

ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার ‘রকেটে’ একদিন

রুবেল মিয়া নাহিদ

Advertisement

উপকূলীয় জেলা পিরোজপুরের মঠবাড়িয়াতে বাড়ি হওয়ায় জলপথে স্টিমার ‘রকেট’ ভ্রমণের আছে মজার মজার অভিজ্ঞতা। কালের সাক্ষী প্যাডেল স্টিমার যা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে রকেট হিসেবে পরিচিত। শত বছর আগে ব্রিটিশ আমলে চালু হওয়া নৌপথের বিলাসবহুল নৌযান এখন অনেকটাই ব্যবহার অনুপযোগী।

প্যাডেল স্টিমারের নাম অনেকেই শুনেছেন। যারা শোনেননি, তাদের জন্যে বলি এই জলযানের বয়স প্রায় ১০০ বছর, কোনোটা হয়তো সেঞ্চুরি পূরণ করে ফেলেছে আরও অনেক আগেই। দুপাশে দুটো প্যাডেল দিয়ে পানি কেটে সামনে এগিয়ে যায় বলেই এগুলোর নাম প্যাডেল স্টিমার। বিশ্বজুড়ে এই প্যাডেল স্টিমার আছে হাতেগোনা অল্প

একদিন যাত্রী হয়েছিলাম প্যাডেল স্টিমার ‘রকেটের’। ঢাকা থেকে যাত্রা করে আসা স্টিমারগুলোর সর্বশেষ গন্তব্য পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার মাছুয়া ঘাট হয়ে খুলনা বিভাগের মোড়ল গঞ্জের সন্ন্যাসী ঘাটে।আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল মাছুয়া ঘাট থেকে।

Advertisement

মাছুয়া ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া স্টিমারগুলো ঘাটে এসে পৌঁছায় বেলা ১১টায়। এর আগে স্টিমারগুলোর প্রথম যাত্রা শুরু হয় মোড়লগঞ্জের সন্ন্যাসী ঘাট থেকে। ঘাটে এসে স্টিমার ভিড়তেই মানুষের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় স্টিমারে ওঠার। যদিও আমার তাড়াহুড়া ছিলো না।

আমার কেবিন পূর্বেই বুকিং দেওয়া ছিলো। যাত্রীরা ডেকে বিছানা পাতায় ব্যস্ত ছিলেন। যে যার প্রয়োজন ও পছন্দ অনুযায়ী জায়গায় বিছানা পেতে নিয়ে বসে গেছে। আমিও আমার ব্যাগপত্র নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করে ফ্রেশ হয়ে সকালের নাস্তা সেরে একটু বিশ্রাম নিলাম।

পরক্ষণেই আমার মনটা আনচান করতে লাগলো পুরো স্টিমারটি ঘুরে দেখার। ছোটবেলায় নানা-দাদুদের মুখে স্টিমার ভ্রমণের আনন্দের কথা অনেক শুনেছি। জেনেছি স্টিমারের পূর্ব ও বর্তমান ইতিহাস।

বিলম্ব না করে একটি পানির বোতল হাতের মোবাইল ফোনটি ও কিছু টাকা নিয়ে বের হলাম পুরো স্টিমার ঘুরে দেখতে। বেলা সাড়ে ১১টায় মাছুয়া ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো বয়সের ভারে প্রবীণ হওয়া লেপচা স্টিমারটি।

Advertisement

আমি ঘুরে ঘুরে খুঁটিনাটি দেখতে শুরু করলাম। কেবিন থেকে বের হয়ে প্রথমেই প্রবেশ করলাম ডেকে। প্রতিটি বিছানায় ৪-৫ জন করে যাত্রী। কেউ যাচ্ছেন পরিবার নিয়ে কেউ কেউ যাচ্ছেন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে। নদীর শীতল হাওয়ায় গা ভাসিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক শিশু ও বৃদ্ধরা। ভ্রমণকে আরো একটু আনন্দময় করতে লুডু বা তাস খেলতে বসে গেছেন অনেকেই।

ডেক রুম কাটিয়ে আমি চলে গেলাম ইঞ্জিন রুমের পাশে। বিশাল আকৃতির দুটি ও ছোটো ছোটো কয়েকটি ইঞ্জিনে ভরা রুমটি। যে কোনো প্রকার সমস্যার সমাধান কিংবা ইঞ্জিন বন্ধ করার জন্য সার্বক্ষণিক ইঞ্জিন রুমের পাশে অবস্থান করে দুজন কর্মচারী।

শুরুর দিকে এই স্টিমারগুলো কয়লায় চলত। কয়লা থেকে উৎপন্ন হওয়া স্টিমে এই নৌযান গুলো চলার কারণে এর নাম হয় স্টিমার। তবে কালের বিবর্তনে আধুনিকায়নের ফলে এই স্টিমারগুলো এখন চলে ডিজেলে। শুরুর দিকে এই নৌযান গুলো দ্রুততম হওয়ার কারণে স্টিমারের পাশাপাশি এগুলো ‘রকেট’ নামেও বেশ পরিচিতি লাভ করেছে।

ইঞ্জিন রুম দেখা শেষ হতেই যে জিনিসটা আমার নজর কেড়েছে সেটি হলো স্টিমারের দু’পাশে অবস্থিত বিশাল আকৃতির দুটি প্যাডেল। ইঞ্জিন থেকে উৎপন্ন হওয়া শক্তিতে চলে এই প্যাডেল দুটি। আর এই প্যাডেলের গতিতে নদীর বুক চিড়ে গন্তব্যের দিকে ছুটে চলে রকেট।

স্টিমারের আশপাশ দিয়ে কিছুক্ষণ পরপরই লঞ্চ আসা-যাওয়া করছে। তার চেয়েও মনমুগ্ধকর দৃশ্য হলো, নদীতে ইলিশ ধরার দৃশ্য। প্রচণ্ড ঢেউয়ে জেলেদের নৌকা যেন ডুবুডুবু করছে। দেখে ভয়ে আমার শরীর শিউরে উঠলো। ছোট ছোট নৌকাগুলোতে নিভু নিভু করে বাতি জ্বলছে। এ সময়ের মধ্যে অনেক যাত্রীর সঙ্গেই আমার পরিচয় হয়ে গেল। খুবই ভালো লাগছিল তাদের সঙ্গে কথা বলে।

তখন বিষখালী ও কীর্তনখোলা নদী হয়ে স্টিমার ছুটে চলছে পরের ঘাট চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে। খুব ভোরে আমরা পৌঁছে গেলাম সদরঘাটে। নদীর ঢেউ, জ্যোৎস্নার আলোর খেলা দেখতে দেখতেই শেষ হলো আমার স্টিমার ভ্রমণ।

জেএমএস/জিকেএস