ফিচার

আষাঢ়ের প্রথম দিনে বর্ষার আগমনী গান

আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন। আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে জুন-জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে আষাঢ় মাস। আষাঢ় নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। ঋতুবৈচিত্র্যে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। ছয় ঋতুর মধ্যে দ্বিতীয় ঋতু। নানা কারণে আষাঢ় বা বর্ষা গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টি হয়। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো বলতে হয়, ‘আবার এসেছে আষাঢ়, আকাশ ছেয়ে’। তাই তো বর্ষার আগমনী গান শোনায় গাঙশালিক। একটানা ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ ডেকে যায় কোলার ব্যাঙ।

Advertisement

আষাঢ় বা বর্ষা এলে নদী-নালা, খাল-বিল জলে টইটুম্বুর হয়ে যায়। মরা নদীতে জোয়ার আসে। বিলের জলে দেখা যায় শাপলার হাসি। নৌকায় চড়ে খাল-বিল পেরিয়ে বহুদূর চলে যাওয়া যায়। ঢেউয়ের তালে তালে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নেচে ওঠে মন। কখনো হঠাৎ আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা। আকাশ ছাপিয়ে বৃষ্টির ধারা নেমে আসে। বৃষ্টির জলে অবগাহনে মনে অফুরান আনন্দের শিহরণ জেগে ওঠে। ঘরের টিনের চালে বৃষ্টির রিমঝিম ছন্দ শুনতে পাওয়া যায়। জানালা খুলে বিছানায় শুয়ে বৃষ্টির শীতল পরশ অনুভব করা যায়।

ঋতুবৈচিত্র্যের মাঝে বর্ষাকে আলাদা বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত করা যায়। যুগে যুগে কবিরা বর্ষাকে প্রেম-বিরহ ও সৃজনক্রিয়ার ঋতু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বর্ষাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক প্রেম ও বিরহের কবিতা। আর এসব কারণেই বর্ষাকে বিরহের কাল বলা হয়ে থাকে। প্রেমিকের জীবনে বর্ষা আসে বিরহ নিয়ে। কী জল কী বর্ষা; বাদলের ধারায় বেদনার্ত হয়ে ওঠে মন। ঝরে বেদনাশ্রু।

তাই তো বর্ষাবিহীন বাংলাদেশ ভাবাই যায় না। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে নকশীকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে বর্ষার অপরূপ রূপ বর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত ও চিরকালীন হয়ে আছে। মধ্যযুগের কবি জয়দেবের কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়েছে—‘মেঘৈর্মে দুরম্বরং, বণভুব শ্যামাস্ত মালদ্রুমৈ।’ বৈষ্ণব কবির ভাষায়—‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুং’।

Advertisement

বর্ষা নিয়ে মহাকবি কালিদাস রচনা করেছেন বিখ্যাত মহাকাব্য ‘মেঘদূত’। মেঘকে সেখানে যক্ষের বন্ধু বলা হয়েছে। যক্ষ তার প্রিয়ার কাছে মেঘকে দূত করে খবর পাঠাতেন। কী করে একখণ্ড মেঘ কবির কল্পনায় হয়ে উঠছে বিরহীর বার্তাবাহক প্রাণবন্ত-জীবন্ত দূত! মেঘদূত ছাড়াও বৈষ্ণব পদাবলীতেও বিরহের সঙ্গে বর্ষার একটি নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেছেন পদকর্তারা। পদাবলী সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ মহাজন বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, জ্ঞানদাস, গোবিন্দদাস আর বিহারীলালের কবিতায় বর্ষা এসেছে একাধিকবার। তাদের বিরহের কবিতায় ও গানে বর্ষা ও বিরহ একাকার হয়ে গেছে।

মধ্যযুগে চণ্ডীদাসের কোনো কোনো কবিতায় বর্ষা এসেছে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের ইন্ধন হিসেবে। মধ্যযুগের কবিরা বর্ষাকে অভিসার ও বিরহ পর্বে ‘প্রেমের আগুনে ঘিয়ের ছিটা’ হিসেবে কল্পনা করেছেন। কবি বলেছেন—‘এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটাকেমনে আইল বাটেআঙ্গিনার মাঝে বধূয়া ভিজিছেদেখিয়া পরাণ ফাটে।’আঙিনায় বর্ষাসিক্ত রমণী দেখে কবিমনে প্রেমাবেগ জাগ্রত হয়েছে। রমণীর ভেজা শরীরের স্পর্শ পেতে উতলা হয়ে উঠেছে মন। তবে ছুঁতে না পারার আকাঙ্ক্ষায় প্রাণ যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের উদ্দেশে লিখেছিলেন—‘কবিবর, কবে কোন্ বিস্মৃত বরষে/কোন পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে/লিখেছিলে মেঘদূত। মেঘমন্দ্র শ্লোক বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক/রাখিয়াছ আপন আঁধার স্তরে স্তরে/সঘন সংগীত মাঝে পূঞ্জীভূত ক’রে।’ অপরদিকে কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন, ‘ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি’।

বর্ষা হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে। বর্ষা ভাবায়, বর্ষা ভালোবাসায়। বর্ষা মানেই গর্জে ওঠা নদী। দু’কূল ছাপিয়ে তলিয়ে দেওয়া গ্রামের পর গ্রাম। সুখ-দুঃখে একাকার হয়ে ভেসে বেড়ানো পালতোলা নৌকা। বিরহী সুর জেগে ওঠা মাঝির ভাটিয়ালি গান। কলা গাছের ভেলায় ভেসে যাওয়া ক্ষুদ্র জীবন। আজও বৃষ্টি এলে নিজের অজান্তেই মুখ ফুটে বেরিয়ে আসে ‘বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’। আমরা আশায় থাকি, বর্ষার ধারায় শুদ্ধ হবে মানবমন।

Advertisement

কবিতার কথা বাদ দিলেও সাহিত্যের অন্যান্য শাখা—উপন্যাস, গল্প, নাটকেও বর্ষা এসেছে বিভিন্ন উপলক্ষে। শিল্প-সংস্কৃতির শক্তিশালী মাধ্যম চলচ্চিত্রের প্রায় সব নির্মাণেই বর্ষাকে পাই নানাবিধ কৌশলে। কেননা জনজীবনে বর্ষার ব্যাপক প্রভাব। বর্ষা কৃষকের আরাধনার ঋতু। গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ ফুটে ওঠে এই বর্ষায়। কৃষাণ-কৃষাণীর মুখে ফোটে হাসি। ঘরের কোণে নকশিকাঁথায় আর বাড়ির দহলিজে আড্ডায় কাটে অলস সময়।

একেকজনের দৃষ্টিতে বর্ষা একেক রকম। কখনো কোমল, কখনো বিদ্রোহী, কখনো কাম-বাসনার আকড়, কখনো আনন্দদায়িনী। আর তাই তো পৃথিবীতে বর্ষা আসবে। আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে চলে যাবে। রেখে যাবে নানা অনুভূতি।

এসইউ/