জাগো জবস

মোহাইমিনুলের পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হওয়ার গল্প

মোহাইমিনুল ময় ৪০তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে (সুপারিশপ্রাপ্ত) প্রথম হয়েছেন। এটি তার প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও ক্যারিয়ার ভাবনা জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—

Advertisement

জাগো নিউজ: প্রথমেই আপনার পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাই—মোহাইমিনুল ময়: আমার পড়াশোনা শুরু গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলায়। এখানে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করি। তারপর পারিবারিক কারণে ঢাকায় চলে আসি। আমি ২০১০ সালে শেরে বাংলা নগর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১২ সালে নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করি। তারপর ২০১২-২০১৩ সেশনে বুয়েটে ভর্তি হই এবং পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করি।

জাগো নিউজ: আপনার শৈশবের দিনগুলো কেমন ছিল?মোহাইমিনুল ময়: আমার শৈশব কেটেছে মফস্বল শহর গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলায়। প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব ও খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটতো। তেমন চাকচিক্যময় জীবন ছিল না। মস্বফলে অন্যদের মতো সাধারণভাবে জীবন কেটেছে। তবে ছোটবেলায় বই পড়ার একটা ঝোঁক ছিল। তিন গোয়েন্দার বই অনেক বেশি পড়তাম। সেটার অনেক প্রভাব আছে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও। বই জোগার করা অনেক কঠিন ছিল। বই কালেকশনের জন্য অনেক মেমোরি রয়েছে।

জাগো নিউজ: প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রথম হওয়ার অনুভূতি কেমন?মোহাইমিনুল ময়: এটি আসলে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। কারণ প্রথম হবো এটি একদমই আশা করিনি। তবে রিটেন ও ভাইবা দেওয়ার পর আশা ছিল ভালো রেজাল্ট আসবে। প্রথম যে হবো তখন এটি চিন্তাই করিনি। মনে মনে ভেবেছি, হয়তো ভালো কিছুই হবে। প্রথম হওয়ার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ, যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনার পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?মোহাইমিনুল ময়: সত্য বলতে পড়াশোনার জন্য তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়নি। কারণ আমার বাবা একজন ব্যাংকার ছিলেন। তিনি বর্তমানে অবসরে। পড়াশোনার জন্য সব সময় আমাকে সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পরিবার থেকে উৎসাহ দেওয়া হতো। তাই বলা যায়, পড়ালেখার জন্য আমাকে কোনো প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়নি।

জাগো নিউজ: বিসিএস নিয়ে স্বপ্ন দেখলেন কবে থেকে?মোহাইমিনুল ময়: ছাত্রাবস্থায় বা গ্র্যাজুয়েশনের আগে বিসিএস নিয়ে তেমন চিন্তা করিনি। তখন বিসিএস দেবো এরকম ইচ্ছে জাগতো না। গ্র্যাজুয়েশনের পর ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা-ভাবনা শুরু থাকি। জানি, বর্তমানে অন্যান্য চাকরির চেয়ে বিসিএস সবচেয়ে ভালো। এখানে কাজের পরিবেশ উন্নত এবং সুযোগ-সুবিধাও বেশি। তখন থেকেই বিসিএস দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ভাবি, অন্য যাই করি না কেন, বিসিএসকে মেইন ফোকাসে রেখে এগিয়ে যাবো। পাশাপাশি চেষ্টা করি, যাতে প্রথম বিসিএসেই একটা ভালো রেজাল্ট চলে আসে।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?মোহাইমিনুল ময়: বিসিএসের সিলেবাসে বিভিন্ন বিষয়ের টপিক থাকায় প্রথমে কাজটি একটু কঠিন মনে হয়েছে। কোন অংশ পড়ব, কোন অংশ বাদ দেবো তা নিয়ে কিছুটা সংশয় ছিল। এরপর বিসিএসের সিলেবাস বাদ দিয়ে প্রশ্ন অ্যানালাইসিস করতে শুরু করি। তখন বুঝতে পারি, কোন টপিকে কম এবং কোন টপিকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ দিতে হবে। পাশাপাশি কোন বিষয়ে কতটুকু বেসিক জানতে হবে। বেসিক জানার জন্য বাজারের বইয়ের তুলনায় বোর্ড বইগুলো বেশি ফলো করি। এমসিকিউর জন্য বাজারের বই থেকে প্রচুর অনুশীলন করেছি। প্রিলিতে এমসিকিউ কনফিডেন্টলি দাগানোর চেষ্টা করতাম। রিটেনের ক্ষেত্রে অনেক ভালো পড়েও লেখা যায়। আবার না পড়েও লেখা যাবে। রিটেনের প্রশ্নগুলো সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকে। কিন্তু এই অল্প জানা থেকে ভালো নম্বর তোলা যায় না। রিটেনের প্রিপারেশনের জন্য বাজারের বই বাদে ইন্টারনেটের সহযোগিতা নিয়েছি। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর জন্য বিভিন্ন প্রবন্ধ ও কলাম ফলো করেছি। লিখিতে প্রত্যেকটা টপিক একটু আলাদাভাবে খাতায় দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ভাইবার ক্ষেত্রে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না। এখানে পরীক্ষার্থীর গোছানো লুক ও কথা বলার স্টাইল ফলো করা হয়। ভাইবায় আমি যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী থাকার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি ক্যাডার চয়েস, পঠিত বিষয়, নিজ জেলা, সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়গুলো আগে থেকেই জেনে গেছি। স্যারদের প্রশ্নের উত্তর ভিন্নভাবে গুছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

জাগো নিউজ: বিসিএস পররাষ্ট্র ক্যাডারে কেন এলেন?মোহাইমিনুল ময়: এত এত ক্যাডারের মাঝে পররাষ্ট্র ক্যাডারকে প্রথম দেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ, আমার যে পারসোনালিটি রয়েছে, সেটি পররাষ্ট্র ক্যাডারের কাজের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। নিজ দেশের সংস্কৃতিকে এবং নিজের দেশকে অন্য দেশে উপস্থাপনের যে সুযোগ পররাষ্ট্র ক্যাডার দেয়; সেটি ব্যক্তিগতভাবে আমাকে আকর্ষণ করে। এ জন্য পররাষ্ট্র ক্যাডারকে নিজের প্রথম ক্যাডার হিসেবে বেছে নিই।

Advertisement

জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রস্তুতি কীভাবে শুরু করবেন?মোহাইমিনুল ময়: প্রথমেই প্রিলির জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। বিসিএসের সিলেবাস সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে। পাশাপাশি টপিক অনুযায়ী পড়াশোনা এগিয়ে নিতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো ভালোভাবে পড়তে হবে। কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোয় কম সময় দেওয়াই শ্রেয়। যে কোনো টপিকের বেসিক সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। বেসিক জানা থাকলে যে কোনোভাবে প্রশ্ন আসলে দেওয়া যায়। বেসিকের জানার জন্য বোর্ড বই, ইন্টারনেটে তথ্য খোঁজা ও নিয়মিত পত্রিকা পড়া উচিত। এমনভাবে পড়তে হবে, যাতে যে কোনো টপিক পড়ার পর অন্যদের সে সম্পর্কে পড়াতে পাড়েন। পাশাপাশি নিয়মিত এমসিকিউ অনুশীলন করতে হবে। বাজারের বই কিনে সময় ধরে প্র্যাক্টিস চালিয়ে যেতে হবে। এতে প্রশ্ন সম্পর্কে ও টাইম মেনেজমেন্ট নিয়ে ভালো ধারণা হয়।

জাগো নিউজ: বিসিএস লিখিতের জন্য কোন বিষয়গুলো ফোকাস করা উচিত? মোহাইমিনুল ময়: বিসিএস লিখিতের সাথে প্রিলির যথেষ্ট মিল রয়েছে। লিখিতের প্রশ্নগুলো সম্পর্কে সবাই পরিচিত থাকে। কিন্তু খাতায় লেখার ক্ষেত্রে কোয়ালিটিফুল লেখা জরুরি। লিখিতের টপিক দেখে অনেকেই কিছু বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকায় সহজ ভেবে এড়িয়ে যান। কিন্তু এখানে এসএসসি বা এইচএসসির মতো লিখলে ভালো মার্ক পাওয়া যাবে না। লেখার প্রেজেন্টেশন, খাতার স্কিল ও টাইম ম্যানেজমেন্ট মাথায় রাখতে হবে। লেখায় ডাটা বা তথ্য প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করতে হবে। লেখার প্রেজেন্টেশন অন্যদের থেকে একটু আলাদা লেখার চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিকের জন্য নিজের মতো করে ভালো লিখতে হবে। পত্রিকার প্রবন্ধ ও কলাম পড়ে নিজের দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি ম্যাথের ওপর গুরুত্ব দিয়ে নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে।

জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়া কি কোনোভাবে কাজে এসেছে? মোহাইমিনুল ময়: আমার বিসিএস জার্নিতে সোশ্যাল মিডিয়ার বড় একটি ভূমিকা রয়েছে। কারণ বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া কোনো কিছু চিন্তা করা যায় না। তবে সোশ্যাল মিডিয়া সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে। ফেসবুকে অসংখ্য বিসিএস রিলেটেড গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপে প্রতিনিয়ত পরীক্ষার আপডেট, নোট, বিভিন্ন তথ্য ও দিকনির্দেশনামূলক বিভিন্ন লেখা পড়া হতো। গ্রুপগুলো থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতাম। এ ছাড়াও আউট নলেজ অর্জনের ক্ষেত্রে ফেসবুক একটি বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। ভালো ভালো মানুষের ফলো করে তাদের থেকে বিভিন্ন উপদেশমূলক ও দরকারি তথ্য নিয়ে নিজের জ্ঞান বাড়ানোর চেষ্টা করেছি। বিসিএস প্রস্তুতির সময় আমি চাকরিতে ছিলাম। তখন বই সাথে নিয়ে নিয়ে পড়াটা একটুু কঠিন ছিল। তাই ফেসবুকে বিসিএস রিলেটেড গ্রুপগুলোয় ঢুকে বিভিন্ন বিষয় পড়ার চেষ্টা করতাম। সোশ্যাল মিডিয়া আবার পড়াশোনায় বড় একটি ভূমিকা পালন করেছে। তবে বিসিএস পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলবো, সোশ্যাল মিডিয়া প্রকৃতভাবে ব্যবহার করার জন্য। এর নেগেটিভ দিক বাদ দিয়ে পজিটিভ দিকে সময় দেওয়া উচিত।

জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? মোহাইমিনুল ময়: বিসিএস দেওয়ার আগে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে নানা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেত। কী করবো, না করবো দ্বিধায় ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে যেহেতু একটি অবস্থানে আসতে পেরেছি; সেহেতু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা আলাদাভাবে কিছু নেই। বাংলাদেশ সরকার থেকে যেই কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। আমি চেষ্টা করবো দেশের মানুষের জন্য সততার সাথে সেই কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য। একজন পররাষ্ট্র ক্যাডার হিসেবে নিজের দেশকে যেভাবে তুলে ধরা এবং ভবিষ্যতে নিজের দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করা যায়, সেই চেষ্টা থাকবে। সততা ও নিষ্ঠার সাথে সবার দোয়া নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

এসইউ/এএসএম