কৃষি ও প্রকৃতি

পেঁয়াজের ক্ষেতে শেষ সময়ের পরিচর্যায় ব্যস্ত চাষিরা

আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে নতুন হালি পেঁয়াজ বাজারে পাওয়া যাবে। এখন ভালো দামে মুড়ি বা কন্দ পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। সেজন্য চাষিরা আশায় বুক বেঁধে আছেন, তারা হালি পেঁয়াজের ভালো দাম পাবেন। তবে আশঙ্কা করছেন পেঁয়াজ আমদানি হলে বাজারে দরপতন হবে। এতে তারা ক্ষতির মুখে পড়বেন। এসব হিসেবে কষে পেঁয়াজ চাষিরা শেষ সময়ের মতো ক্ষেতের ফসল পরিচর্যায় এখন ভীষণ ব্যস্ত। কৃষি বিভাগ বলছে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি পেঁয়াজ চাষ হয়েছে।

Advertisement

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, পাবনা জেলায় এবার ৫৩ হাজার ৩০৫ হেক্টর জমিতে হালি (চারা) পেঁয়াজ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এবার চাষের লক্ষ্যমাত্র ছাড়িয়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার পাবনা থেকে অন্তত সাত লাখ ৪৯ হাজার ৩৪ মেট্রিক টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হবে।

কৃষি তথ্য সার্ভিস পাবনার আঞ্চলিক অফিস জানায়, গত বছর পাবনা জেলায় ৫২ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯ ৯৭ মেট্রিক টন।

কৃষি কর্মকর্তারা জানান, জেলার চাষিরা দুটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ করে থাকেন। এর একটি কন্দ ( মূলকাটা বা মুড়ি) ও অন্যটি চারা (হালি) পদ্ধতি। মূলকাটা পদ্ধতিতে পেঁয়াজের আবাদ শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ও হালি পদ্ধতিতে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে। মুড়ি পদ্ধতিতে আবাদ করা নতুন পেঁয়াজ জানুয়ারি মাসে হাটে উঠতে শুরু করে।

Advertisement

মুড়ি পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় না। মুড়ি পেঁয়াজ ২-৩ মাস বাজারে থাকে। আর হালি পদ্ধতিতে চাষ করা পেঁয়াজ বাজারে ওঠা শুরু করে মার্চের মাঝামাঝি বা মার্চের শেষ থেকে। হালি পেঁয়াজ চাষি বা ব্যবসায়ীরা ঘরে সংরক্ষণ করেন। তা সারা বছর বাজারে কেনা-বেচা হয়।

পাবনার সাঁথিয়া ও সুজানগর উপজেলার বিল গ্যারকা পাড়, বিল গাজনা পাড়, নাগডেমরা, সেলন্দা, ঘুঘুদহ বিলপাড়, কুমিরগাড়ী, বামনডাঙ্গা, বামনদি, ইসলামপুর প্রভৃতি মাঠে গিয়ে দেখা যায় চাষিরা ক্ষেতে শেষ সময়ের পরিচর্যায় ব্যস্ত। পেঁয়াজ ঘরে ওঠা পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলে বেশি ফলন পাওয়া যাবে বলে তারা আশাবাদী।

সম্প্রতি দেশের অন্যতম বড় পেঁয়াজের হাট সাঁথিয়ার বনগ্রাম হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতি মণ কন্দ পেঁয়াজ এখন ২০০০ থেকে ২২০০ টাকা দরে কেনা-বেচা হচ্ছে। হাটে পেঁয়াজের আড়তদার ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ‘মাস দুয়েক আগেও প্রতি মণ পেঁয়াজের দাম কম ছিল। ৯০০ থেকে ১১০০ টাকা মণ দরে মুড়ি পেঁয়াজ কেনা-বেচা হয়েছে। এখন পেঁয়াজের বাজারে মন্দা হাওয়া কেটে দর ঊর্ধ্বমুখী।

সাঁথিয়া উপজেলার খিদির গ্রামের চাষি আমিনুল হক, আব্দুল আলিম, চক মধুপুর গ্রামের আমজাদ বিশ্বাস, বামনডাঙ্গা গ্রামের জসিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জমিতে পেঁয়াজ চাষ করতে হলে শুরুতেই পেঁয়াজ বীজ কেনা, চারা উৎপাদনের জন্য বীজতলা ভাড়া করতে হয়।

Advertisement

জমি চাষ সেচ, সার, গোবর, নিড়ানি, শ্রমিক ও উত্তোলন খরচ মিলিয়ে বিঘাপ্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। এর পাশাপাশি যারা অন্যের জমি লিজ নিয়ে আবাদ করেন তাদের বিঘা প্রতি বাৎসরিক ১০ হাজার টাকা লিজমানি জমি মালিককে দিতে হয়। এজন্য তাদের খরচ হয় আরো বেশি। এছাড়া অনেক চাষি চড়া সুদে মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েও পেঁয়াজ চাষ করেন।

পেঁয়াজ চাষ প্রধান এলাকা সাঁথিয়ার বিল গ্যারকা পাড়ের চাষি সাগর আহমেদ জানান, পেঁয়াজের দাম বাড়লে জমির বার্ষিক লিজ মানিও বাড়ে। গ্যারকা বিল পাড়ের জমিতে বাৎসরিক লিজমানি এবছর প্রায় ১৫ হাজার টাকা। এর সঙ্গে রয়েছে উৎপাদন খরচ বিঘা প্রতি ৩০ হাজার টাকা।

তারা জানান, এক বিঘায় পেঁয়াজের গড় ফলন হয় ৪০- ৫০ মণ। সে হিসেবে ৬০০ বা ৭০০ টাকা মণ দরে পেঁয়াজ বিক্রি করলে চাষির উৎপাদন খরচ ওঠে না। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, পেঁয়াজ উৎপাদন খরচ কেউ হিসেব করেন না, হিসেব করেন শুধু কত টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।

তারা আরও বলেন, বছরের পর বছর ধরে পেঁয়াজের দাম কম থাকবে, এ ধারণাটা চাষিদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে। দেশে সব কিছুর দাম বাড়ছে, জনগণের আয় বাড়ছে। তাই মসলা জাতীয় ফসল পেঁয়াজের দামও প্রতিবছর বাড়লেই কেবল চাষিরা লাভবান হতে পারবেন। তবে সরকার যদি পেঁয়াজ আমদানি করে তাহলে দাম কমে যাবে। এতে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বাংলাদেশ ফার্মার্স এসোসিয়েশন (বিএফএ) এর কেন্দ্রীয় সভাপতি ও পাবনা জেলার বিশিষ্ট চাষি আলহাজ শাহজাহান আলী বাদশা জানান, চাষিরা বাপ-দাদার আমল থেকে চাষ করে আসা পেঁয়াজের জাতই চাষ করে আসছেন। ফলে বিঘা প্রতি ফলন একই রকম হারে রয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যা বেড়েছে, পেঁয়াজের চাহিদাও বেড়েছে। তাই বিঘা প্রতি ফলন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য অন্যান্য ফসলের মত পেঁয়াজের উফশী (উচ্চ ফলনশীল) জাত সম্প্রসারণ করা দরকার।

পাবনার দোতলা কৃষির উদ্ভাবক কৃষিবিদ জাফর সাদেক জানান, বছরের শেষ দিকে অনেক সময় পেঁয়াজের দাম বাড়ে। তবে সে দাম সাধারণ চাষিরা পান না। কারণ চাষের খরচজনিত দেনার কারণে তাদের মৌসুমের শুরুতেই সিংহভাগ পেঁয়াজ বিক্রি করতে হয়। বাঁধাইকারকরা বেশি দাম ধরতে পারেন। তিনি আরও জানান, পেঁয়াজ চাষে স্বল্প সুদে ঋণ দেয়ার সরকারি ঘোষণা থাকলেও সাধারণ চাষিরা সে সুবিধা পাচ্ছেন না। অনেকেই চড়া সুদে মহাজনী ঋণ নিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

কৃষি বিপণন অধিপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, চাষি ভালো দাম পেলেই সেটাকে নেতিবাচকভাবে না দেখে ইতিবাচক দিকটিও ভাবতে হবে। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করে চাষিদেরও তো লাভবান হতে হবে। তিনি বলেন, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, মানুষের আয় বেড়েছে। তাই সবার ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে।

কৃষি সস্প্রসারণ অধিদপ্তর পাবনার উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান জানান, পাবনাকে পেঁয়াজ উৎপাদনের রাজধানী বলা যায়। দেশের এক চতুর্থাংশের বেশি পেঁয়াজ পাবনা জেলায় জন্মে। তিনি বলেন, পেঁয়াজের ভালো দাম বাজারে। পেঁয়াজ তোলা পর্যন্ত আবহাওয়া ভালো থাকলে চাষিরা লাভবান হবেন বলে তিনি আশাবাদী।

আমিন ইসলাম/এমএমএফ/জিকেএস