সালতামামি

একুশে যেমন ছিল ছাত্রলীগ-যুবলীগ

সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনোকাণ্ডের ক্ষত সারিয়ে মানবিকতায় এগোচ্ছে আওয়ামী লীগের দুই সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও ছাত্রলীগ। সংগঠন দুটির বিরুদ্ধে একসময় নানান অভিযোগে দেশজুড়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও বর্তমান পরিস্থিতি অনেকাংশে বিপরীত। বদনামের কালিমা মুছে সংগঠনে ও জনমনে স্বস্তি ফিরিয়েছে দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গৌরবোজ্জ্বল এবং ঐতিহ্যবাহী এ দুই সংগঠন। ২০২১ সালে বিশেষত করোনাকালে উভয় সংগঠনই আর্তমানবতার সেবার অনন্য নজির স্থাপন করেছে। আর তাতে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডেও ফিরেছে ইতিবাচক ধারা।

Advertisement

মহামারিকালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ সারাদেশে ৭৫ লাখ মানুষকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছে। পাশাপাশি ১২৪ জনকে ঘর করে দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগও মহামারির কঠিন দিনগুলোতে অক্সিজেন সেবা, খাদ্য সহায়তাসহ নানা কাজে এগিয়ে এসেছে। যা সরকারপ্রধানসহ দেশের মানুষের দৃষ্টি কেড়েছে। মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ মিলিয়ে ২০২১ সাল কেমন কাটলো যুবলীগ-ছাত্রলীগের, তা নিয়েই বছরান্তে এ প্রতিবেদন।

একুশে যুবলীগের যত অর্জনপ্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পের আদলে যুবলীগ অসহায়-ভূমিহীন মানুষের মাঝে আশ্রয় কর্মসূচির মাধ্যমে চার ধাপে ১২৪টি ঘর হস্তান্তর করেছে। জনসেবামূলক এ কর্মসূচি এখনো চলমান। এছাড়া করোনাকালে ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় কৃষকদের ২০ হাজার হেক্টর জমির ধান কেটে ঘরে তুলে দিয়ে মানবিক নজির স্থাপন করেছে যুবলীগ।

মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে লেখা চিঠি সংকলন ‘প্রিয় বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থ প্রকাশ করেছে সংগঠনটি। করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানো ছাড়াও পবিত্র মাহে রমজান ও শোকের মাস আগস্টে দেশব্যাপী অসহায় মানুষের মাঝে ইফতার ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে যুবলীগ।

Advertisement

টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি সারাদেশে করোনায় আক্রান্ত মানুষকে ফ্রি অক্সিজেন সেবা এবং রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ১৯০টি বড় অক্সিজেন সিলিন্ডার উপহার দিয়েছে যুবলীগ। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাধারণ মানুষের মাঝে বিতরণ করেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক।

এছাড়া পরিবেশের সুরক্ষায় সারাদেশে যুবলীগ নেতাকর্মীরা এক কোটিরও বেশি বৃক্ষরোপণ করেছে। শীতার্তদের শীতবস্ত্র, বাকপ্রতিবন্ধী, শ্রবণপ্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, অটিজম শিশুদের মাঝে বস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী এবং বিকলাঙ্গদের হুইল চেয়ার, বস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী দিয়েছে বাংলাদেশের প্রথম এ যুব সংগঠনটি।

তরুণীকে পিটিয়ে যুবলীগ নেতা বহিষ্কারঅনেক ইতিবাচক কাজের পাশাপাশি নেতিবাচক কাজেও বছরের নানা সময়ে খবরের শিরোনামে এসেছে যুবলীগ। গত ৯ ডিসেম্বর রাজধানীতে এইচএসসি পরীক্ষার্থী এক তরুণীকে জনসম্মুখে পিটিয়ে রক্তাক্ত করাসহ চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পিকে বহিষ্কার করা হয়।

তাইজুল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তার বিরুদ্ধে সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, বাড়িঘর দখলসহ রয়েছে নানা অভিযোগ। সবশেষ গত ৭ ডিসেম্বর রাতে রূপনগর ২৩ নম্বর রোডের মাথায় তুচ্ছ ঘটনায় জুলিয়া আক্তার নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে বেদম পেটানোর অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী রূপনগর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ (জিডি) দায়ের করেন। অভিযোগ তুলে নিতে ওই তরুণীকে কয়েক দফা হুমকিও দেন বাপ্পি।

Advertisement

সায়েদুল হক সুমন, তাইজুল ইসলাম চৌধুরী বাপ্পি ও ইব্রাহিম হোসেন

ব্যারিস্টার সুমনকে অব্যাহতিএ বছরের ৭ আগস্ট দলীয় এক কর্মসূচিতে সরকারি এক কর্মকর্তার বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দেওয়ার সমালোচনা করেছিলেন যুবলীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন। তারপর তাকে সংগঠন থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের জন্মদিন উপলক্ষে ওই অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও শেখ কামালকে নিয়ে স্লোগান দেন শরীয়তপুরের একজন পুলিশ কর্মকর্তা। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তার কঠোর সমালোচনা করে দলীয় নেতাকর্মীদের পাল্টা সমালোচনার মুখে পড়েন ব্যারিস্টার সুমন। এরপর তাকে যুবলীগের ওই পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও থামেনি ছাত্রলীগকরোনায় দীর্ঘসময় দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও থেমে থাকেনি আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে স্বীকৃত ছাত্রলীগের মানবিক কর্মযজ্ঞ। সংগঠনটির নেতাদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড প্রশংসা কুড়িয়েছে। অবশ্য ভালো কাজের ভিড়ে কিছু কিছু নেতিবাচক কর্মকাণ্ডও যে ছিল না, তা নয়।

করোনাকালীন বছরজুড়ে ৩৫০ শিশুর মাঝে শিশুখাদ্য বিতরণ করেছে ছাত্রলীগ। সাড়ে তিন হাজার শিক্ষার্থীর পাশাপাশি ৩৫০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মাঝেও দিয়েছে খাদ্য সহায়তা। সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এক লাখেরও বেশি মাস্ক বিতরণ ও রমজান মাসে ইফতার আর সেহরিতে প্রতিদিন ৩০০ মানুষের খাবার সরবরাহ করেছে তারা। এর বাইরেও ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী করোনা রোগীদের অক্সিজেন সেবা দিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। করোনা মহামারিতে টিএসসিতে থেকে ভাসমান-অসহায় ১০ হাজার মানুষের খাবারের জোগান দিয়ে সাড়া ফেলেছেন ডাকসু সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতা তানভীর হাসান সৈকত।

আলোচনায় উত্তরের সভাপতির অব্যাহতিইতিবাচক নানা কর্মকাণ্ডের মাঝেও ২০২১ সালের নভেম্বরে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহিম হোসেনকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনা ছিল বেশ আলোচিত। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অভিভাবক ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নির্দেশনায় গত ৩০ নভেম্বর তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব আসতে বয়স গোপন করে ভুয়া পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে জলবায়ু সম্মেলনে গিয়েছিলেন ইব্রাহিম। গত ১৪ নভেম্বর তাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দর এলাকায় অবস্থান নেয় তার সমর্থকরা। এতে বিমানবন্দর সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হলে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কেন্দ্রে পৌঁছাতে বেশ বেগ পোহাতে হয়।

২৫ ছাত্রলীগ নেতার দণ্ডএকটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যা মামলার রায় ২০২১ সালে ছাত্রলীগের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। গত ৮ ডিসেম্বর ঘোষিত রায়ে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন। আসামিদের সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী।

আবরার হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিতদের সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী/ফাইল ছবি

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল, বহিষ্কৃত তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার ওরফে অপু, বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত, বহিষ্কৃত উপ-সমাজসেবাবিষয়ক সম্পাদক ইফতি মোশাররফ সকাল, বহিষ্কৃত ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, বহিষ্কৃত কর্মী মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, মুজাহিদুর রহমান, মনিরুজ্জামান মনির, হোসেন মোহাম্মদ তোহা, মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, এ এস এম নাজমুস সাদাত, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শামসুল আরেফিন রাফাত, মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম, এস এম মাহমুদ সেতু, মুহাম্মদ মোর্শেদ-উজ-জামান মণ্ডল ওরফে জিসান, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও মুজতবা রাফিদ। এদের মধ্যে তিন আসামি জিসান, তানিম ও রাফিদ পলাতক।

যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মুহতামিম ফুয়াদ, মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা, বহিষ্কৃত গ্রন্থ ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, বহিষ্কৃত আইনবিষয়ক উপ-সম্পাদক অমিত সাহা ও আকাশ হোসেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পাশাপাশি এদের প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডাদেশ দেন আদালত।

এসইউজে/এমকেআর/এইচএ/এএসএম